লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে ফিরে: চাপালিশ, কাঁঠালসহ নানা প্রজাতির গাছ দেখতে অবিকল সুপারি গাছের মতো। ডগায় কিছু ছাড়া কাণ্ডে কোথাও ডালপালা নেই।
এ অবস্থা লাউড়াছড়া জাতীয় উদ্যানের মাগুরছড়া পুঞ্জি (খাসিয়া পল্লী) এলাকার। কিন্তু এখান থেকে বনের ভেতরদিকে এক কিলোমিটার গেলে ভিন্ন চিত্র দেখা যাবে। এখানকার গাছগুলোতে শেকড় থেকে শীর্ষ পর্যন্ত কোথাও কাণ্ডের দেখা মিলবে না।
আবার লাউড়াছড়া খাসিয়া পল্লী এলাকার চারিদিকেও একই অবস্থা। এখানেও গাছগুলোতে ডগা ছাড়া ডাল-পালা নেই। ডাল-পালাহীন বন এলাকায় নীচেও কোন ঝোপ ঝাড় নেই। খানিকটা সমতল ভূমির অ্যাগ্রো ফরেস্টের মতো।
অ্যাগ্রো ফরেস্টে গাছ ফাঁকে ফাঁকে চাষাবাদ করা হয়। সে কারণে আগাছা জন্মান্তে দেওয়া হওয়া না। কিন্তু লাউড়াছড়ার এই রূপ বড়ই উদ্বেগের বলে জানালেন বন বিভাগের লোকজন। এখন নাকি উজাড় হয়ে যাচ্ছে প্রকৃত ওয়াইল্ড লাইফ। আর সম্প্রসারিত হচ্ছে অ্যাগ্রো ফরেস্ট।
লাউয়াছড়া কাগজে কলমে ১২৫০ একর হলেও প্রকৃত বন বড়জোর ৩’শ একর হবে। আর বাঁকিটা অ্যাগ্রো ফরেস্টে পরিণত হয়েছে। দিন দিন বাড়ছে অ্যাগ্রো ফরেস্টের আয়তন।
শনিবার (২৩ জুলাই) প্রত্যুষে ঘুরে দেখার সময়ও বাড়ন্ত অ্যাগ্রো ফরেস্টের চাক্ষুশ প্রমাণ পাওয়া গেলো। মাগুরছড়া পুঞ্জি থেকে উত্তর-পূর্বে আধা কিলোমিটার দূরে (রেলওয়ের ২৯৬/৯ পিলারের কাছে) একটি টিলার বিঘা খানেক জায়গার গাছের ডালপালা ঝেটে পরিষ্কার করা হয়েছে। সঙ্গে নিচের আগাছাও।
তখনও কাঁঠাল গাছের ডালগুলো থেকে আঠা ঝরছিল। রাতে যে কাটা হয়েছে সতেজ পাতা সে সাক্ষ্যই দিচ্ছে। অথচ এই বনের গাছের ডাল ভাঙা তো দূরের কথা, ঘাসও ছেঁড়ার কোনো অনুমতি নেই।
মৌলভীবাজার বণ্যপ্রাণি রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক তবিবুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, ২০১২ সালের ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশন আইনে এসব কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গাছের ডাল থাকল দূরের কথা, একটি ঘাঁসের পাতাও ছেড়ার কোন সুযোগ নেই। এমনকি কোন গাছ মারা গেলেও সেটি সরিয়ে নেওয়া যাবে না। পঁচে সেখানে কীটের জন্ম হবে। সেই কীট উপজীব্য করে বেঁচে থাকবে অন্য প্রজাতির প্রাণী।
মাগুরছড়া খাসিয়া পল্লী এলাকায় বেশ কিছু বড় বড় গাছের ডালপালার পাশাপাশি ডগাও ছেটে দেওয়া দেখা গেছে। সেই গাছগুলোকে দেখতে অনেকটা তার বিহীন বিদ্যুতের খুঁটির মতো লাগছে। কারা, কেন গাছের ডাল ও ডগা ছেটে দিচ্ছে।
বিষয়টি খুব গোপনীয় নয়, ওপেন সিক্রেট। শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবার জানা। তারা জানালেন, এখানে ৬৩ পরিবার খাসিয়া রয়েছে। তারা গাছগুলোর ডালপালা ছেটে পান লাগাচ্ছে। ডালপালা থাকলে পান ফলন ভালো হয় না, সে কারণে নিয়মিত ডালপালা ছেঁটে দেয় তারা। ডগাও নাকি একই কারণে কেটে ছোট করে দেওয়া হচ্ছে। গাছ বেশি বড় হলে পুরো ছায়া পড়ে। আর তখন পানের ফলন ভালো হয় না তাই সূর্যের আলো প্রবেশে বাঁধা দূর করতে কিছু গাছের মাথা ছেটে দেওয়া হয়।
তাদের এই বক্তব্যের প্রমাণও পাওয়া গেলো হাতে নাতে। ডালাপালা হীন গাছগুলোতে খাসিয়া পান শোভা পাচ্ছে। কয়েকজনকে দেখা গেলো পান সংগ্রহ করতে। তখন আর ডাল-পালা ছেটে দেওয়ার কারণ খুঁজতে অভিধান খুঁজতে হয় না।
ডাল-পালা ছেটে দেওয়ার পাশাপাশি পানগাছগুলোতে নিয়মিত কীটনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। যা ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনছে জীব বৈচিত্র্যে। প্রথমে মারা পড়ছে কীট, তারপর সেই কীট খেয়ে মারা পড়ছে পাখি ও সরীসৃপ।
বন উজাড় হলেও খাসিয়ারা রয়েছে মহাধুমধামে। জীবিকার জন্য সীমিত আকারের পান চাষের কথা থাকলেও তারা নেমেছে এখন পান রপ্তানিতে। সেই অর্থে হাঁকাচ্ছে বিলাসবহুল পাজেরো জীব। আর গাড়ির জন্য বন কেটে গ্যারেজ নির্মাণ করা হয়েছে।
বিপন্ন প্রাণী, কীট-পতঙ্গ, পাখ-পাখালি, গাছ-গাছালি সমৃদ্ধ ১২৫০ একরের সংরক্ষিত বন লাউয়াছড়া। ব্রিটিশদের রোপিত গাছ থেকে শুরু হওয়া এ বন পরে প্রকৃতি দখল করেছে তার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়। ১২০ বছরে বন হয়ে উঠেছে বন্যপ্রাণী আর গাছ-লতার জীবন্ত সংগ্রহশালা। কিন্তু দিন দিন উজাড় হয়ে যাচ্ছে সেই সংগ্রহশালা।
বাংলাদেশ সময়: ০৭০০ ঘণ্টা, জুলাই
এসআই/