ভেষজ বাগান (লাউয়াছড়া) ঘুরে: যেনো রোগ বাসা বেঁধেছে আরোগ্য কুঞ্জের ভাঁজে ভাঁজে। বৃক্ষ আর গুল্মলতার নাম লেখা সাইনবোর্ডের চটা উঠেছে এখানে সেখানে।
এটি যে দেশের প্রথম ভেষজ বাগান তা বলে না দিলে কারো বুঝে ওঠারই জো নেই। এমনকি কাছাকাছি যারা থাকেন তারাও সচেতন নন অমূল্য এই বাগান সম্পর্কে।
শ্রীমঙ্গল থেকে লাউয়াছড়ার ভেতর দিয়ে এগুলো শ্যামলী পর্যটন এলাকা পার হয়ে ফুলবাড়ি পয়েন্টে এই ওষুধী বাগান পড়বে হাতের ডান পাশে। এর পাশ দিয়ে চলে গেছে মাগুরছড়ার রাস্তা। উল্টোদিকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে প্রবেশের পরিত্যক্ত টিকিট কাউন্টার।
উদ্বোধনী স্তম্ভ ও ওষুধী গাছের নাম লেখা সাইনবোর্ডের মাঝ দিয়ে ঘাসবন মাড়িয়ে ক’কদম এগুতে যে টিলা পাওয়া গেলো তার শরীর জুড়েই আসলে এই ভেষজ কুঞ্জ। রাস্তার পাশে ঘাস থাকলেও টিলার গায়ে ঘাস নেই বললেই চলে।
এখানে সাড়ে ৪ একর জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা টিলার গায়ে যেসব বৃক্ষ আর গুল্ম লতা দেখা গেলো সেগুলোর সবই ওষুধি গাছ হওয়ার কথা। কিন্তু কোনো গাছেই কিছু লেখা না থাকায় কোনটি কি গাছ তা চিনে ওঠা মুশকিলই হলো বটে। তবে চিরচেনা বাসক আর বিষকাটালের ঝোপ বুঝিয়ে দিলো, এটি আসলে ওষুধি গাছেরই এলাকা বটে।
২০০২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর যৌথভাবে এই ভেষজ কুঞ্জ উদ্বোধন করেন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার নজরুল ইসলাম, সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি এমএ হানিফ, সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এম আতিকুল ইসলাম, মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক এম মোখলেস উর রহমান ও পুলিশ সুপার রওশন আরা বেগম।
তাদের মহতি এই কাজের স্মৃতিস্বরূপ ‘বনজ ও ফলজ এর সঙ্গে ওষুধী চারাও রোপন করুন, সুস্থ সুন্দর থাকুন’ স্লোগানটি এখনো শোভা পাচ্ছে রাস্তার পাশের সাইনবোর্ডের নিচে।
বন বিভাগের হিসেবে এখানে থাকার কথা- অশোক, অর্জুন, আমলকি, কামেলা, চাল মুগরা, চালতা, ছাতিয়ান, জয়ত্রী, তেঁতুল, পলাশ, রক্তচন্দন, রিঠা, শিমুল, শ্বেত চন্দন, সোনালু, সিভিট, হরিতকী, হিজল, খয়ের, কাঁঠাল, ইউক্যালিপটাস, বট, গামার, কামরাঙ্গা, পেয়ারা, খাসী, চম্পা, আন, যজ্ঞ ডুমুর, মহুয়া ও বহেরাসহ অন্তত ৩৮ প্রকারের ওষুধি বৃক্ষ।
ওষুধি গুল্মের মধ্যে থাকার কথা মেহেদী, পাথর কুচি, বাসক, কাল ধুতরা, আকন্দ, সাদা ভেরেন্ডা, শিউলি, ঘৃতকুমারি, উলট কমল, তুলসী, তুকমা ও মনকাঁটা। আর লতার জাতীয়-আপাং, ঈশ্বর মূল, কালো মেঘ, মধুলতা, গোল মরিচ, থানকুনি, পুদিনা, বিচুটি, শতমুলী, সর্পগন্ধা, লজ্জাবতী ও পান।
সব মিলিয়ে এই সংখ্যাটা হওয়ার কথা ৬৯। কিন্তু এখন কি আছে আর কি নেই তা জানা নেই বনবিভাগসহ কোনো পক্ষেরই। অর্থ বরাদ্দের অভাবে অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে এর দেখভাল পর্ব। রাতের আঁধারে মূল্যবান বৃক্ষ আর গুল্ম-লতা কেটে নিয়ে গেছে অসাধু কবিরাজরা। সৃজনের মাত্র এক যুগ পেরুতে না পেরুতেই তাই আরোগ্য কুঞ্জ যৌবন হারিয়ে ধুঁকছে। বাগানটিকে দেখেও এখন অকাল বৃদ্ধ বলেই মনে হয়।
কিন্তু এখানে যেসব গা ও লতা-গুল্ম পাওয়া যায় সেগুলোর ছাল, ফল, ফুল, মূল, পাতা, শিকড়, বীজ, কষ, নির্যাস দিয়ে তৈরি ভেষজ ওষুধে স্ত্রী রোগ, জ্বর, পেটের পীড়া, জণ্ডিস, গলাফোলা, হূদরোগ, অর্শ্ব, বিভিন্ন ধরনের চর্ম রোগ, কুষ্ট, ম্যালেরিয়া, পিত্তশূল, শান্ডু, বহুমূত্র, বাতজ্বর, আমাশয়, দুর্বলতা, রক্তশূন্যতা, ডিপথেরিয়া, হাঁপানি, যক্ষা, গ্যাস্ট্রিক আলসার, গোদ, ফোঁড়া ও স্নায়ুরোগসহ অর্ধ শতাধিক রোগের চিকিৎসা করা যায। এই ভেষজ চিকিৎসার খরচ যেমন কম, তেমনি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে।
উপরন্তু এখানকার ওষুধি গাছগুলোর অধিকাংশই বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্তির পথে। তাই এখনো সুযোগ আছে এই বাগানটিকে মডেল হিসেবে গড়ে সারা দেশে আরো অনেক ভেষজ বাগান গড়ার।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩২ ঘণ্টা, আগস্ট ৮, ২০১৬
জেডএম/