ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

জাদিপাইয়ে মুগ্ধতা! দুরন্ত ত্লাবংয়ের সঙ্গে...

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২২৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৬
জাদিপাইয়ে মুগ্ধতা! দুরন্ত ত্লাবংয়ের সঙ্গে... ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

জাদিপাইয়ের মুগ্ধতায়....

 

পাসিং পাড়া থেকে উঁকি দিলেই চোখে পড়বে জাদিপাই পাড়া। কনান রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটি নেমে গেছে সেটি ধরে এগুলেই জাদিপাই পাড়া।

এ রাস্তায় নামার সময় পায়ের ব্রেক চাপতে হয় মাঝে মাঝে। ব্রেকফেল হলে একেবারে জাদিপাই পাড়ার ঘরগুলোর চালের উপর পড়তে হবে।

ফ্রি ফলের মতো করে নামতে লাগলাম। মিনিট পঁচিশেক বোধহয় লাগলো জাদিপাই পাড়ায় নামতে। মিতু বারবার পিছিয়ে পড়ায় দেরিটুকু হলো। পাড়া থেকে জাদিপাই ঝর্নায় যাবার দুটি রাস্তা আছে। তবে বৃষ্টির কারণে পিচ্ছিল থাকায় পশ্চিমমুখী রাস্তাটায় গেলাম না। এটি বেশ খাড়া, একবার পা পিছলে গেলে হাড়গোর ভাঙা এমনকি জীবন সংশয়ের আশঙ্কা আছে।

উপর থেকে দেখলে জাদিপাই পাড়াকে ছোট্ট মনে হয়। বাস্তবে আসলে এতটা ছোট না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাড়িগুলো নিয়ে এটি মোটামুটি জমজমাট পাড়া। গির্জা চোখে পড়লো একটি। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি। পাড়ায় ঢোকার মুখে এক গাছে দুই পিচ্চি কি যেনো এক ফল পারছিলো। জুয়েল থিওটোনিয়াস তাদের কাছে চাওয়ার পর যা উত্তর এলো তা স্তম্ভিত করার মতো। তারা বলল খ্রিস্টান নই বলে আমাদের ওই ফল দেওয়া যাবে না। পাহাড় চিরশান্তির স্থান হয়েই ছিলো যুগ যুগান্তর ধরে। পরে নিজেদের অধিকারের দাবির পক্ষে বিপক্ষে এক সময় এখানে অস্ত্রের ঝনঝনানিও হয়েছে। হালে পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধু যে সরকারি উৎপাত চলছে ব্যাপারটি কিন্তু একেবারেই তা নয়। বিদেশি এনজিও আর মিশনারিদের আনাগোণা এখানে বেশ লক্ষণীয়। এ ধরনের সাম্প্রদায়িক বক্তব্য সমতলের শহর গ্রাম গঞ্জে অনেক শোনা যায়। দুই পাহাড়ি শিশুর মুখে এ কথা বেশ অবাকই করলো।

যাই হোক জাদিপাই পাড়া ছাড়িয়ে উৎরাই ভেঙে আবারও নামতে লাগলাম। পাড়ার পাশে ঝিরির আওয়াজ অনেক কোলাহল ছাপিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির কল্যাণে ঝিরির আশপাশে জমজমাট অবস্থা। যেখানটায় নেমে এলাম সেটি সমতল এক বিশাল মাঠ। জাদিপাই ঝর্নায় যারা গিয়েছেন তারা জানেন জায়গাটি জোকের স্বর্গ। একটু দাড়ালেই এদের আক্রমণের মুখে পড়তে হবে। পা চালিয়ে যতদ্রুত সম্ভব পার হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। পাহাড়ে প্রথমবারের মতো চোখ পড়লো তামাকের ক্ষেত।

দূর থেকে ভেসে আসছিলো তীব্র গতিতে পানি পরার গর্জন। জায়গাটিই যে জাদিপাই ঝর্না তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই ঝর্নাকে বলা হয় ঝর্নার রানী। দেখা যাক রানী আমাদের জন্য তার কেমন সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে আসে। সমতলে হাটার পর আবার নীচের দিকে নামতে লাগলাম। ঝর্নার আগে আমরা শেষ খাড়াটুকু নামতে শুরু করেছি। জাদিপাইয়ের এই শেষ নামাটুকু নিয়ে বেশ বদনাম আছে। পা হরকালে কিন্তু আর আস্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। জায়গায় জায়গায় গাছ পড়ে ট্রেইল বন্ধ হয়ে আছে। সেসব এড়াতে বেশ কসরত করতে হলো। যত আগাচ্ছিলাম ঝর্নার গর্জন বাড়লো লাগলো। ভাই ব্রাদারদের তোলা ছবির কল্যাণে জাদিপাইয়ের বিশালতা সম্পর্কে আগেই ধারণা ছিলো। এবারের অতি বর্ষণ এর ব্যাপ্তিকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। বেশ দূরে থাকতেই গাছপালার ফাঁকে হঠাৎ এক ঝলক চোখে ঝিলিক মারলো বিশাল এক দুধ ধবল জলধারা। চমকে উঠলাম। যেখান থেকে যে গর্জন ভেসে আসছে তার সঙ্গে মিলে এ দৃশ্য কল্প যেন জাদু বাস্তবতার কোন ক্যানভাস।   ক্যানভাসের পুরোটা যখন চোখের সামনে এলো এক কথায় বলতে গেলে চিন্তা করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। আমি ধপ করে সেখানেই বসে পড়লাম। সংজ্ঞা ফিরলো আরও মিনিটখানেক পর পেছনের অন্যরা সামনের যাওয়ার জন্য তাড়া দিতে। কিন্তু কোথায় যাবো আর তো পা বাড়ানোর জায়গা নেই। সামনের পুরো জায়গা একেবারে ধ্বসে গিয়েছে। এর আগে যতগুলো ছবিতে জাদিপাইকে দেখেছি সবগুলোই সামনে থেকে তোলা। কিন্তু এখন সামনে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। পাহাড়ি ঢলের কারণে বিশাল অংশজুড়ে একেবারের ধ্বসে গিয়েছে। বেশ উপরে থেকে আমরা ছ’জন পলকহীন দৃষ্টিতে গিলতে লাগলাম রানী জাদিপাইকে। আমরা যে রূপে জাদিপাইকে দেখেছি সে মুহূর্তের বর্ণনা দেওয়া আসলেই কঠিন। গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টির কারণে পানির বেগ নিয়েছে বজ্রের শক্তি। নীচে পানি পড়ে বাষ্পাকারে উড়ে যাচ্ছে। বেশ দূরে থেকেও ক্যামেরায় ছবি নেওয়া কঠিন। হঠাৎ এতক্ষণের বাকরুদ্ধ বাস্তবতা ভেঙে কিভাবে যেন চিৎকার করে উঠলাম। রংধনু!!! শহুরে আকাশে রংধনু দেখি কদাচিৎ সেখানে জাদিপাইয়ের নীচে বসেছে রংধনুর সাত রংয়ের বাহারি মেলা।

স্বচ্ছ পানিতে রোদের ঝিলিকে সৃষ্টি হচ্ছে সাত রঙের সুষমা। আমার চিৎকারে ক্যামেরা হাতে মিতু সচকিত হলো। কিন্তু চর্ম চোখে যা দেখলাম তা কি ক্যামেরার লেন্সে ধরা সম্ভব। না হোক আমরা জাদিপাইয়ের সৌন্দর্যেই মজে থাকি। আধঘণ্টা অনেক কম সময় মনে হলো। কোনো কবি এ যৌবনা ঝর্নার সামনে এসে বসলে আস্ত একখানা কবিতার বই তার লিখে ফেলতে পারতেন আমি নিশ্চিত।

দুরন্ত ত্লাবংয়ের সঙ্গে....
গত কয়েকদিনের মতো আজকের সকাল গোমড়ামুখো না। সেই কোন ভোরে লাল টকটকে পূব আকাশ  জানান দিলো উজ্জ্বল এক ভোরের। সকাল সাড়ে পাঁচটায় ওঠার কথা ছিলো। বরাবরের মতো আজও খানিক দেরি হয়ে গেলো। সকাল সাড়ে ছয়টায় কিছু না খেয়েই রওনা দিলাম ত্লাবং ঝর্না দেখতে। সুংসাং পাড়া  থেকে মোটামুটি এক ঘন্টার মতো লাগে এ ঝর্নায় যেতে। ডবল ফলস নামে শহুরে আঙিনায় এটি বেশ পরিচিত।

ডবল ফলস মূলত রেমাক্রী খালের উৎস। সুংসাং পাড়া থেকে রেমাক্রী খাল পর্যন্ত এ পথে শুধু নামা। রাস্তার আয়তনও বেশ প্রশস্ত। ভোরের আলোয় পথের ঘাসে লেগে থাকা শিশির ছুয়ে আমরা চলেছি ডবল ফলসের পথে। তিন দিনে পাহাড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে শরীর এখন পুরোপুরি ফিট। কোন সমস্যা হচ্ছে না। দূরত্বের কষ্ট না, ভাবাচ্ছে এখন ফেরার চিন্তা। ভারী বর্ষণ এমনিতেই রুমা বাজারে একটা দিন খেয়ে দিয়েছে। আগামী কাল অফিসে যোগদান করার কথা। কিন্তু পথের হিসেব বলছে সে আশায় গুড়ে বালি। নির্ধারিত সময়ের বাইরেও একটা দিন কাটাতে হবে। অফিসে ফোন  করে জানানোরও উপায় নেই, নেটওয়ার্ক থাকলে তো। চিন্তা বাদ দিলাম, যাচ্ছি ডবল ফলস অ্যাডভেঞ্চারে এত ভাবলে কি চলে।

রাস্তা ছেড়ে এবার ঝিরিতে নেমে এলাম। এটি মূলত ডবল ফলসের আপার স্ট্রিম। এখান থেকে নানা পথে পাহাড় ধোয়া পানি এসে ঝর্না হয়ে সৃষ্টি হয়েছে রেমাক্রী খালের। ঝিরি পুরোতে কয়েক জায়গায় বিপদে পড়তে পড়তে বেচে গেলাম। কয়েকদিন এত বৃষ্টি হয়েছে ঝিরিতে ঠাই নাই ঠাই নাই অবস্থা। এক জায়গায় তো ইয়া বিশাল এক লাফ দিয়েও শেষ মুহূর্তে পা হরকাতে হরকাতে বেঁচে গেলাম।   আবার খানিকটা চড়াই ভেঙে জুম ক্ষেতের পথ ধরলাম। কাকতাড়ুয়ার মতো জুম ঘরগুলো ক্ষেত পাহারা দিচ্ছে। ফাঁকা এসব ঘরে থাকার ইচ্ছে বহুদিনের। সামনের কোন সফরে থাকা হবে হয়তো। দূর থেকে শোনা গেলো পানির প্রবল গর্জন। তৌহিদ জানানো ডবল ফলসের কাছাকাছি আমরা।   রূপের আলোয় ঝলমল করছে ঝর্না ধারা। বিশাল পাহাড়ের দুই কোন থেকে আলাদা দুটি ধারা নেমে এসেছে। জিংসিয়াম সাইতারের মতো ঠিক বুনো ভাব নেই। আবার গৃহপালিতও না। এর বিশাল পটভূমিকায় নিজেকে মনে হলো অনেক ক্ষুদ্র। এই আমাদের বাংলাদেশ। এর পথে প্রান্তরে কত না ঐশ্বর্য ছড়ানো আছে, যার খবর আমরা ক’জন জানি। ডবল ফলসকে পেছনে রেখে কিছুক্ষণ চলল ব্যাপক ফটোসেশন। সকালের নাস্তা সারলাম। এবার ফিরতে হবে। রোদ দ্রুত মাথার উপরে উঠছে। বেলা পড়ার আগেই আমাদের থাকতে হবে বগালেকে।

বাংলাদেশ সময়: ২২২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৬
এমজেএফ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ