ঢাকা: গোলপাতার ঝোঁপে কুড়াল দিয়ে কোপ দিচ্ছিলেন মকবুল শেখ। সবে একটামাত্র কোপ পড়েছে, এরই মধ্যে মামা ‘বাঘ আসছে’ বলে ভাগনের গগণবিদারী চিৎকার! ঘাড় ফিরিয়ে ভাগনের দিকে তাকাতেই পেছন দিক থেকে ঘাড়ে বাঘের আক্রমণ! এরপর মকবুল বেহুঁশ! গলায়, কাঁধে, বুকেসহ কয়েক জায়গায় বাঘের থাবার আঘাতে সাতদিন একেবারে বেহুঁশ।
ভয়ার্ত ঘটনাটি আট বছর আগের, সাতক্ষীরা জেলার গাবুরা ইউনিয়নের চাঁদনীমুখা গ্রামের বাসিন্দা মকবুল শেখের।
সকালে সূর্যের আলো ফোটার আগেই নীলডুমুর ঘাট থেকে সুন্দরবন অভিমুখে যাত্রা। পথে পরে আড়পাঙ্গাশিয়া নদী ঘেঁষে সুন্দরবনের ছোট্ট দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা। স্থানীয়রা জানান এ গ্রামের বাঘের আক্রমণ থেকে ফিরে আসা কিছু দুঃসাহসী মানুষের কথা।
ট্রলার গাবুরার চাঁদনীমুখা গ্রামে ভেড়াতেই চোখে পড়ে নারকেল, ক্যাকটাস, আকাশ সমান উঁচু তালগাছবেষ্টিত ইট বিছানো ছোট ছোট সড়ক। এলাকাজুড়ে বেশ কয়েকটি মাছের ঘের। কয়েক বছর আগে হয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় আইলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছিলো এলাকাটি। সরকারি-বেসরকারি নানা প্রকল্পের সাহায্যে ক্ষতিগ্রস্ত গাবুরা আবার মাথা তুলে দাড়িয়েছে। গ্রামে ঢুকতেই প্রথমে কথা হয়ে যায় বাঘের থাবা থেকে ফিরে আসা মকবুল শেখের সঙ্গে। একটি দোকানে বসে তাদের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করে দেন স্থানীয় বাসিন্দা আসাদুল ইসলাম।
মকবুল শেখের সামনে কথা বলার সময় আশ-পাশে জড়ো হয় গ্রামের বেশ কিছু মানুষ। বাঘের আক্রমণের ঘটনা তুলে ধরার সময় কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন মকবুল। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে থাকে। কারণ, বাঘের হামলার পর দুই বছর বিছানায় পড়েছিলেন তিনি।
মকবুল যে জীবন নিয়ে ফিরে আসবেন, এ কথা গ্রামের কেউ কখনো ভাবতেই পারেননি। তবে সবার ধারণা ভুল প্রমাণ করে মুমূর্ষ অবস্থা থেকে ফিরে আসেন তিনি।
সেই দিনের গল্প বলেন মকবুল। বন বিভাগের ‘পাস’ নিয়ে পাচরার কাছাকাছি ভাগনে-বড় ভাইসহ বনে গোলপাতা কাটতে যান তিনি। তবে যেখানে তারা যান, সেটা বাঘের বিচরণ ক্ষেত্র। বনের এই অংশটিতে নিশান (চিহ্ন) দেওয়া রয়েছে। এই নিশানের অর্থ, এ স্থানে বাঘ কাউকে আক্রমণ করেছিল, এটা তার রক্তমাখা কাপড়। যেন এ এলাকায় মানুষ প্রবেশ না করে।
মকবুলের ভাষ্যে, বনে প্রবেশ করলে তাদের চোখে পড়ে বাঘের পায়ের ছাপ। ভাগনে বনে ঢুকতে নিষেধ করেন। কিন্তু নৌকাবোঝাই করার জন্য পাতা কাটতেই হবে। কারণ, মাত্র ১৫ দিনের জন্য পাস দিয়েছে বন বিভাগ। জীবিকার তাড়নায় তাই ঝুঁকি নিয়েই গোলপাতা সংগহ করতে থাকলেন। ভাগনে নদীতে ভেড়ানো নৌকায় বসে রইলেন।
হঠাৎ মকবুলের ওপর হামলে পড়ে বাঘ। তার গলায়, কাঁধে ও বুকে আঘাত করতে থাকে সে। মকবুলের ডান পাশে ছিলেন তার বড় ভাই আবুল হোসেন। বাঘ মকবুলের ওপর আক্রমণ করলে তিনি পড়ে যান। রক্তের ছোট ভাইকে বাঘ আক্রমণ করেছে– তাই পণ করে যেভাবেই হোক ভাইকে বাঁচাতেই হবে। সেজন্য পড়ে থাকা মকবুলের দিকে বাঘ ফের মুখ দিতে চাইলে গায়ের জোরে কোপ দেন আবুল। আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে বাঘ দৌড়ে পালিয়ে যায়। আর মকবুলকে নিয়ে বন বিভাগের সহায়তা সাতক্ষীরায় চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসেন।
এরপর থেকে মকবুল আর কখনো বনের মধ্যে গোলপাতা কাটতে যাননি। গ্রামে পান-সুপারি ফেরি করে জীবন চালান।
এই গ্রামে থাকেন আরেকজন ‘বাঘ-লড়াকু’ আইয়ুব আলী গাজি। গোলপাতার ছাউনি দেওয়া ঘরের বারান্দায় বসে যৌবনকালে বাঘের সঙ্গে লড়াইয়ের কাহিনী শোনান তিনি। যুবক বয়স থেকে বাঘ বশ করার একটু-আধটু ‘মন্ত্র’ জানতেন সত্তরোর্ধ্ব এই বৃদ্ধ।
১৯৭২ সাল, দিনটা ছিল শুক্রবার। তার ওপর আমাবশ্যার রাত। ভাইকে নিয়ে গোলপাতা কাটতে তালপটিয়া খালে গেলেন আইয়ুব আলী। বাঘ অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় বন বিভাগ আগেই সতর্ক করে। এরপরও নিজেদের সুরক্ষার জন্য বনে প্রবেশ ‘পাস’ দিলো। বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ঝাঁড়ফুক করার পর নিজের জন্য গোলপাতা কাটতে গেলেন। দেখা যায়, সেখানে তিনটা নিশান (চিহ্ন)।
তখনেই ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় আইয়ুবের, ‘আল্লাহ তোমার নামে, তুমি রহমান, তুমি গফুর- আমরা গরিব মানুষ। ভালোভাবে কাজটা সমাধান করতে দাও’ বলে দোয়া পড়তে থাকেন।
অমাবশ্যা হওয়ায় তার ‘যাদু-মন্ত্র’ও কাজে দিচ্ছে না তার। যেই কুড়াল গাছে কোপ দেন ওমনি হুরুম হুরম হুরম শব্দে বন কাঁপিয়ে সামনে এসে হাজির। ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলেন আইয়ুব। এরপরও সাহস রেখে, বাঘের সামনে দাঁড়ান। নাক বরাবর কুড়াল দিয়ে কোপ দেন। কুড়ালের কোপে এক পাশের চোখ নষ্ট হয়ে যায় বাঘটির। আঘাত খাওয়ার পরও বাঘটি তার পায়ে থাবা মারে। ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় পা। মনে জোর রেখে গলা বরাবর কোপ মারেন বাঘটিকে।
পরে আইয়ুবকে বন বিভাগের সহায়তায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর ভালো হয়, তবে ৪৪ বছর পরও সেই ক্ষত স্থান অক্ষত রয়েছে।
গাবুরা গ্রামের মকবুল, আইয়ুব গাজির মতো আরও অনেকেই বাঘের আক্রমণ থেকে জীবন নিয়ে বেঁচে ফিরে এসেছেন। বাঘের ঘটনার পর থেকে এদের কেউ আর বনে কাজ-কর্ম করেন না।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০১৬
এমসি/এইচএ/
আরও পড়ুন
** খুলনার হার্ডবোর্ড মিল এখন জঙ্গলবাড়ি!
** সন্ধ্যাটা কাটুক রূপসা সেতুর বর্ণিল আলোয়!
** খুলনার স্পন্দন রুপসার ঘাট!
** হিম শীতে ডাকাতিয়া বিলে
** বাগেরহাটের পালপাড়ার বাসনকোসন সারাদেশে
** সপ্তদশ শতকের বিস্ময় ‘অযোধ্যা মঠ’
** ‘এখানে বড়-ছোট নাই, যাই করেন দশ টাকা’!
** বিমানবন্দর রেলস্টেশনে অকেজো মাইক!