ঢাকা, বুধবার, ২৪ আশ্বিন ১৪৩১, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৫ রবিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

এ পাড়াতেও ঈশ্বর নেই!

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৬
এ পাড়াতেও ঈশ্বর নেই! পানখালী চুনা জেলেপাড়ায় অসহায় জেলে পরিবার। ছবি: মানজারুল ইসলাম

রাতের আঁধারে কুঁচা ধরতে গিয়ে খলুই ভর্তি ঢোঁড়া সাপ ধরে এনেছিলেন মনীন্দ্র। ওই গল্প নিয়েই হরদম খুনসুটি চলছে পানখালি চুনা জেলেপাড়ায়। মনীন্দ্রকে অবশ্য পাওয়া গেলো না। তবে তার স্ত্রী বিন্দা দাসীর নোনা বাতাসে পোড় খাওয়া মুখটা যেনো লজ্জায় একটু রক্তিম বর্ণ নিলো।

জেলেপাড়া (মুন্সীগঞ্জ, শ্যামনগর) ঘুরে: রাতের আঁধারে কুঁচা ধরতে গিয়ে খলুই ভর্তি ঢোঁড়া সাপ ধরে এনেছিলেন মনীন্দ্র। ওই গল্প নিয়েই হরদম খুনসুটি চলছে পানখালি চুনা জেলেপাড়ায়।

মনীন্দ্রকে অবশ্য পাওয়া গেলো না। তবে তার স্ত্রী বিন্দা দাসীর নোনা বাতাসে পোড় খাওয়া মুখটা যেনো লজ্জায় একটু রক্তিম বর্ণ নিলো। যদিও শিগগিরই সেই লজ্জার আভা চাপা পড়লো অনিশ্চয়তার শঙ্কায়।

স্বামীর এমন হাস্যকাণ্ডে পাড়া জুড়ে হাসির খোরাক জুটলেও তাদের কপাল তো আজ ওই বনের খালেই পুড়েছে। দাম পড়ে গেলেও প্রতি কেজি কুচা অন্তত ৫০টাকায় বিকোনো যেতো বাজারে। কেজি পাঁচেকে তো ২শ’ থেকে আড়াইশ’ টাকা আসতোই। কিন্তু সে আশায় গুঁড়েবালি। বাড়তি জুটেছে প্রতিবেশীদের হাসি-তামাশা।

মুখে আঁচল চেপে বিন্দা দাসী তাই সেঁধিয়ে গেলেন খুপড়ির মতো কাঁচা ঘরটায়। ভাগ্যিস নিজেও কিছু কুঁচে ধরে এনেছিলেন মাছের ঘের থেকে। একটু পরই খলুইটা নিয়ে বাজারে ছুটবেন তিনি।      পানখালী চুনা জেলেপাড়ায় শীতের জন্য কাঁথা সেলাই।  ছবি: মানজারুল ইসলাম

এদিকে এর আগেই বাঁধের পাশে গড়া পাকা ঘরটার সামনের দিক ঘিরে রাখা জাল সরিয়ে সুন্দরবনের দেব-দেবীদের উন্মুক্ত করে দিয়েছেন শিবপদ সানা। সত্তর বয়সী এই জেলেকে জীবিকার টানে এ বযসেও ছুটতে হয় বাদাবনে। সুন্দরবনকে এ নামেই ডাকে ওরা। সেখানে মাছ ধরে, কাঁকড়া ধরে। বাঘের সঙ্গে লড়াই করে। প্রতিনিয়ত লড়াই করে খাবার জোটে তাদের।

শিবপদ’র কথাতেও তাই অনিশ্চয়তার ছাযা। উদাস কণ্ঠে বলেন, বন বাদাড়ে যাবো। চোর ডাকাতের ভয়ে যেতি পারি না। সরকারও বন বন্ধ করে দিয়েছে। বাদাবন না যেতি পারলি বাঁচবো কেমুনে।

তার এই কথার প্রতিধ্বণি যেনো ছড়িয়ে পড়ে দেওয়ালে দেওয়াল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জেলেপাড়ার ঘরে ঘরে। বাঁধ পেরিয়ে ওপাড়ের মাছের ঘেরেও যেনো ছুটে যায় বুক থেকে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস। যে শ্বাসের বিষে পুড়ছে এই জেলে পাড়ার ৩৫ ঘর। পানখালী জেলেপাড়ায় এক জেলেশিশু।  ছবি: মানজারুল ইসলাম

মধ্যবয়সী খাটুরে কৌশলা রায়ের কথাতেও তাই হতাশার আক্ষেপ। দিনের পর দিন নোনা পানিতে থেকে হাত-পায়ের কুঁচকে যাওয়া চামড়া দেখিয়ে তিনি বলেন, খেটি খেটি হাত পা নেই আর। তাতে কিইবা এইসে যায়। বাদাবনে তো যেতিই হয়। এই তো এখন যাবো। কুইচে ধরবো। তা না হলে কি করবো। কি খাবো।

আসলেই তো কি করবে ওরা। মাছ ধরা ছাড়া আর কিছু শেখেনি কখনো। আর কিছু পারবে না ভেবে ওদের কাজেও নিতে চায় না কেউ। তাই কাজ জোটে না কামলারও। মাছ ধরলে খাবার জোটে, না ধরলে না। এমনকি, টাকা সহায়তা পেলে কি করবে তারও কোনো ধারণা নেই তাদের।

উপকূলীয় জেলেদের সহায়তায় শ্যামনগর ‌উপজেলায় আসা ৯ কোটি টাকার প্রকল্প তাই ফেরত যাচ্ছে এবার। যাদের বয়স আছে তারা হয়তো রোদ-বৃষ্টি সয়ে তবু যেতে পারে বাদাবনে। কিন্তু বয়ষ্কদের বেলায় তো সে সুযোগও নেই। ৯০ বছর বয়সী অনীল মন্ডলকে (৯০) দেখিয়ে তাই কৌশলার কথা,  বাদা বনে চোখের দরকার। কানের দরকার। ওনার তো এখন ওসব আর নেই। ২ ছেলেকে ছেড়ে এয়েছেন বাঘের মুখে। এখন অপরের দয়ায় জীবন চলে তার। জেলেপাড়ায় রোদে বসে আহার।  ছবি: মানজারুল ইসলাম

পাড়ার আর একটু ভেতরে ঢুকতেই নশমনিকে দেখা গেলো পুরনো কাঁথার সেলাই খুলছেন। সাবিত্রী নামে আর এক জেলেনি বসে পাশেই। এই কাঁথা যেমন ঘরের শীতে কাজে লাগে, তেমনি দরকার হয় বনের ভেতর শীত তাড়াতেও। কিন্তু নোনা পানি ভেজা বাতাসে ২/৩ বছরের বেশী টেকে না কোনা কাঁথা। পুরনো সেলাই খুলে তখন নতুন কাপড় আর সেলাই চড়াতে হয় সেগুলোতে। নমশনি এখন ঠিক সে কাজটাই করছেন।  

ওদিকে এক চালার কাঁচা ঘরের সামনে মাটি তুলে গড়া বারান্দায় উপুড় হয়ে শুয়ে কি দেখছে ৪ বছরের বিপ্লব? চোখে তার অপার বিস্ময় নয়, কেমন যেনো নিস্পৃহ নজর। মা বিজয়া রাণী সরদার অবশ্য অনবরত হাসছেন। তার স্বামী বিকাশ সরদার সেই সাত সকালেই কোথায় বেরিয়েছে কে জানে।
 
বিজয়া বলেন, এলাকার লোক কাজে নেয় না। বনে না গেলে তো না খেয়ি মরবো। এ সময়টায় মাছ, কাকড়া কম। তবু তো যেতি হবে। ওখানে দস্যুতে ধইরে বলে, বাড়িতে কতা কও। নইলে বস্তায় ভইরে জলে ফেইলে দেবো। কিন্তু বাদাবনে না যেয়ি আর উপায় কি?জেলেপাড়ায় সন্তানকোলে এক মায়ের রান্না।  ছবি: মানজারুল ইসলাম

একই হতাশা সত্তোরোর্ধ খগেন আর ননি কুণ্ডুর। বয়স হয়ে গেছে বলে এখন ‍আর বাদাবনে শরীর কুলায় না তাদের। তারওপর জমিদারি আমলে পাওয়া জমি সব কৌশলে লিখিয়ে নিচ্ছে প্রভাবশালীরা। মুন্ডাদের অবিক্রিযোগ্য জমি তারা লিখিয়ে নিচ্ছে সানা, সরদার, মন্ডল ইত্যাদি ‍উপাধি জুড়ে হিন্দু বানিয়ে।

উপকূলীয় এনজিও কর্মী পিযূষ পিন্টুর ভাষায়, এখানে সুষ্ঠূ বণ্টন ব্যবস্থা নেই। তাই এরা রেশন থেকে বঞ্চিত। ঘরের জন্যও টাকা দিয়ে লাইন পেতে হয়। কিন্তু প্রভাবশালীদের নামে কারো কাছে কিছু বলার ক্ষমতা রাখে না এরা। আর প্রভাবশালীরাও নিজেরা সরাসরি না জড়িয়ে কৌশলী চামচা নিয়োগ করে।

খোলা দাওয়ায় বসে কুয়াশ‍ার আড়াল থেকে উঁকি দেওয়া সুর্যের নরম আলো পোহাতে পোহাতে এতোক্ষণ ভাত খাচ্ছিলেন হরেন মন্ডল (৬০)। ডাল-সবজি দ্রুত পেটে চালান করে তিনি বলেন, চালের কেজি ৩৫ টাকা। কিন্তু সব কার্ড পাচ্ছে গেরস্থ। জেলেপাড়ার বাঁধের রাস্তায় শুকাতে দেওয়া জাল।  ছবি: মানজারুল ইসলাম

পাশের বারান্দায় তখন চুলায় লাকড়ি ঠেলছেন পূর্ণিমা মন্ডল। তার কোলে চুপচাপ শুয়ে উঁকি মারছে যে কৌতুহলী শিশু, মহাভারতের চরিত্র অনুসরণে তার নাম রাখা হয়েছে অভিমন্যু। মহাভারতে এই চরিত্র মৎস্য রাজকন্যা উত্তরার স্বামী আর অর্জুন-সুভদ্রার পুত্র হিসেবে অমিত তেজের অধিকারী হলেও এই জেলেপাড়ায় ‍তার জীবন সব সময়ই ঝুঁকির ভেতরে ঘুরপাক খায়। মা ‍পানি নিতে গেলেও তাই বাচ্চার পা বেঁধে রেখে যেতে হয় দাড়ি দিয়ে। চারিদিকে পানি থাকায় পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার বেশী এদিকটায়। অবুঝ অভিমন্যুকে তাই কোলে নিয়ে রান্নার কাজটা চালিয়ে নিতে হচ্ছে মা পূর্ণিমাকে।

মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস পদ্মা নদীর মাঝির মতোই এখানে ওদের সঙ্গে ঈশ্বর থাকেন না। ঈশ্বর থাকেন ওদের ঘিরে রাখা ঘের মালিকদের ভদ্র পল্লীতে। পার্থক্য কেবল এই যে, মানিকের সেই জেলে পল্লী ছিলো পদ্মার পাড়ে। আর এই জেলে পল্লীটার কাছের নদীটার নাম মালঞ্চ। ওটা পেরুলেই সুন্দরবন।

আরো পড়ুন
** প্রাণ যায় যায় প্রাণসায়রে
** কুমির ফোটে করমজলে
** সুন্দরী বেয়ে বাঘ-কুমিরের কটকায়
** হিরণ পয়েন্টে হৃৎকম্পন
** ঘুম সাগরে জল অভিযান
** চাঁদের সাথেই মাছের প্রেম
** দুবলার সৈকতে মৃতদের মিছিল!
** সাগরের বুকে ভাসমান রাত
** জলে ভাসা রকেট কাহিনী
**
দ্বিতীয়ার চাঁদে মেঘনার হাসি
** সুন্দরী ছুঁয়ে পশুরে ভাসে গাঙচিল

বাংলাদেশ সময়: ১২১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৬
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ