ঢাকা, রবিবার, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৯ রবিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

‘ঐতিহ্য’ হারাচ্ছে পাইকগাছার ‘কিংবদন্তির’ সরল খাঁ দিঘী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৬
‘ঐতিহ্য’ হারাচ্ছে পাইকগাছার ‘কিংবদন্তির’ সরল খাঁ দিঘী পাইকগাছার সরল খাঁ দিঘী হতে পারে অন্যতম সেরা পর্যটন কেন্দ্র। ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সরল খাঁ দিঘী (পাইকগাছা, খুলনা) ঘুরে: পিচঢালা সড়কঘেঁষে দিঘীটার এক কোণে গড়ে উঠেছে কামার ঘরসহ বেশ ক’টি দোকানপাট, আরেক কোণে মাদরাসা। সড়ক সংলগ্ন পাড় ছাড়া বাকি তিন পাড়েই দেখা গেল গোসল এবং বাসন-কোসন পরিষ্কারের ঘাট। দু’পাড়ে দেখা গেলো লাউ চাষের দু’চারটা মাচাও। চার পাড়ে পলিথিন, বিস্কুট-চিপসের ছড়ানো-ছিটানো প্যাকেট। ফেলে রাখা হয়েছে বালুর স্তূপ। কয়েকটি জায়গায় স্তূপ করে ফেলা হয়েছে আবর্জনাও। পানি এখনও পুরোপুরি দূষিত না হলেও দূষণের সব ‘ব্যবস্থা’ দৃশ্যমান।

দশাটা অন্য ৮-১০টা পুকুর-দিঘী চেয়েও বেহাল। অথচ খুলনার পাইকগাছার ঐতিহাসিক এ সরল খাঁ দিঘীটা হতে পারে এ জেলার অন্যতম সেরা পর্যটন কেন্দ্র।

অন্তত ১৬ বিঘার এই দিঘী নিয়ে যে লোককথা আছে, তার টানেও মানুষ ছুটে আসতে পারে পাইকগাছায়। মূল উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরত্বের এই দিঘীকে দিনাজপুরের রামসাগর, কুমিল্লার ধর্মসাগর দিঘীর মতোই পর্যটনকেন্দ্র বানানো যায় অনায়াসে। দিঘীর এক কোণে গড়ে উঠেছে কামার ঘরসহ বেশ ক’টি দোকানপাট।  ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমপাইকগাছার লোনা পানি কেন্দ্র থেকে খুলনা ফেরার পথে মোটরবাইক থামলো সরল খাঁ দিঘীর পাড়ে। খুলনা নগরে সরল খাঁর দিঘী নাম শুনে মনে হয়েছিল সাজানো-গোছানো পরিপাটি কোনো পর্যটন স্পটই হবে। কিন্তু এখানে নেমে লোকজনকে জিজ্ঞেস করতেই ভুল ভেঙে গেলো। সামনের এই ‘অর্ধ-দূষিত’, দখলকৃত জলাশয়টাই নাকি সেই ঐতিহাসিক দিঘী। এ নিয়ে স্থানীয়দেরই অসচেতনতা বা অজ্ঞতার প্রমাণ মিললো ক্যামেরায় ছবি তোলার সময়। কপাল কুঁচকে একজন তো বলেও ফেললেন, ‘এইটার আবার ছবি তোলার কী হইলো?’

স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, এ দিঘীর কর্তৃত্ব নিয়ে কয়েক বছর ধরে পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। পৌরসভা দাবি করছে, তারা এলাকার সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে এবং উন্নয়নের লক্ষ্যে দিঘীটি সংস্কার ও পুকুরের পাড়ে একটি মার্কেট গড়তে চায়। আর উপজেলা পরিষদ আশঙ্কা করছে সরকারি দিঘীটি দখল হয়ে যাওয়ার এবং পরিবেশ দূষিত হওয়ার। এই লম্বা সময়ের দ্বন্দ্বে দখল হয়ে যাচ্ছে দিঘীটার আশপাশ। দিঘীর কয়েক জায়গায় স্তূপ করে ফেলা হয়েছে আবর্জনাও।  ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমস্থানীয়রা জানান, দিঘীটাকে ঘিরে এখনও কোনো উদ্যোগ দেখা না গেলেও নানা বিশ্বাস-লোককথার ভিত্তিতে এখানে দেশের নানা অঞ্চল থেকে মানুষ ঘুরতে আসেন কম-বেশি। তুলনামূলকভাবে ছুটির দিনে থাকে বেশি সমাগম।

দিঘী ঘেঁষে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল পাইকগাছার গোপালপুরের বাসিন্দা আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে। স্থানীয়ভাবে বাউলশিল্পী বলে পরিচিত তিনি। আব্দুস সাত্তার দিঘীর ইতিহাস সম্পর্কে বলেন, “মুরুব্বিদের কাছে যেটা শুনেছি, এটা ছয়শ’ বছর আগে হযরত খান জাহান পীরের আমলে তার অনুসারী সরল খাঁ নামে এক পীর খনন করেছিলেন এ এলাকায় মিঠেপানির জন্য। ”

আব্দুস সাত্তার মনে করেন, এই দিঘী থেকে দুই মিনিটের দূরত্বে খুলনা ফেরার সড়কের ডান দিকেই চাউল ধোয়া নামে  যে আরেকটি পুকুর আছে, সেটা সরল খাঁর অনুসারীরা খনন করেছিলেন। সেখানে তারা ভাত রান্নার জন্য চাল ধৌত করতেন বলে সেসময় এটি চাউল ধোয়া পুকুর নামে পরিচিতি লাভ করে। সেই পুকুরটি আনুমানিক ৮ বিঘা জমির ওপর। দু’পাড়ে দেখা গেলো লাউ চাষের দু’চারটা মাচাও।  ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমতবে, সাত্তার যে জনশ্রুতি শোনালেন তার চেয়ে আলাদা কথা বললেন বান্দিকাটি গ্রামের ইউনুস আলী গাজী। তিনি মনে করেন, এই দিঘী অষ্টাদশ শতাব্দীতে বার ভূইয়াদের আমলে সরল খাঁ নামে এক বিখ্যাত জমিদার খনন করেছিলেন।

এই দিঘী নিয়ে খুলনা অঞ্চলে এমন বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, জমিদার সরল খাঁ ছিলেন জেদি প্রকৃতির মানুষ। একবার জমির মামলা সংক্রান্ত কাজে তিনি যশোর যান, সঙ্গে নিয়ে যান একটা পোষা কবুতর। সেসময় পরিবারের লোকজনকে বলে যান, তিনি যদি মামলায় হেরে যান, তবে আর বাড়ি ফিরবেন না। সেক্ষেত্রে কবুতর ছেড়ে দেবেন, আর পাখিটি বাড়ি চলে আসবে। কিন্তু মামলায় সরল খাঁ জিতে যান এবং আনন্দে তার হাত থেকে কবুতর ছুটে যায়। পোষা পাখিটি তখন উড়ে বাড়ি চলে আসে। কবুতর দেখে সরল খাঁর স্ত্রী মনে করেন মামলায় তার স্বামী হেরে গেছেন, অর্থাৎ তিনি আর বাড়ি ফিরবেন না। এই দুঃখে তিনি পরিবারের সব স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে এই পুকুরে আত্মবিসর্জন দেন। আর সরল খাঁ বাড়ি ফিসে এসে দেখেন তার সব শেষ। তিনি নিজের ভুলে পুড়তে থাকেন এবং একসময় ঝাঁপিয়ে পড়েন পুকুরে। ইউনুস ও সাত্তাররা মনে করেন, এই দিঘীর ঐতিহ্য ধরে রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ দরকার।  ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমইউনুস আলী ও আব্দুস সাত্তার দু’জনেই জানান, এ দিঘী থেকে নাকি একসময় মাঝেমধ্যে স্বর্ণালঙ্কার ভেসে উঠতো। কিন্তু একদিন স্বর্ণালঙ্কার উঠলে কেউ একজন একটি ঝিনুক চুরি করে ফেলে। তারপর থেকে আর কিছু ভেসে উঠতে দেখা যায়নি। তবে সেই বিশ্বাস থেকে এখনও মাঝেমধ্যে অনেকে এসে এখানে গরু-খাসি জবাই করে এতিম-মিসকিনদের খাওয়ান।

ইউনুস আলী ও আব্দুস সাত্তারের মতোই স্থানীয়রা মনে করেন, এই দিঘীর ঐতিহ্য ধরে রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ দরকার। চারপাশের অবৈধ স্থাপনা স্থানান্তর বা উচ্ছেদ করে দিঘীর চারপাশ সংস্কার করে এটিকে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণা করলে পাইকগাছার মানুষই উপকৃত হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৬
এইচএ/

আরও পড়ুন
** মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের মুখে, ভয়ে জ্বর ওঠে সাইদুলের
** লোনা পানির সুন্দরবনে ঘরে ঘরে ‘মেটে’
** প্রথম সুন্দরবন যাত্রায় শুশুকের অভ্যর্থনা
** ফুলতলার গামছাশিল্প বাঁচাবে কে!
**ফুলতলার দেশসেরা গামছা
**সবচেয়ে বড় এক গম্বুজের মসজিদ বাগেরহাটে

**বাগেরহাটে মধ্যযুগীয় সড়কের পথ ধরে
**ফের জাগছে খান জাহানের খলিফাতাবাদ নগর!
**শতভাগ বৃক্ষশোভিত বেতাগার সবুজছায়
**রিয়েলাইজেশন অব ডিজিটালাইজেশন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ