ঢাকা, রবিবার, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

মারমেইডের সফলতার পেছনের গল্প

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৫৭ ঘণ্টা, মার্চ ৬, ২০১৭
মারমেইডের সফলতার পেছনের গল্প মাহফুজুর রহমান-ছবি: আসিফ আজিজ

কক্সবাজার থেকে: যুক্তরাজ্যের প্রধান সারির প্রভাবশালী দ্য গার্ডিয়ানের জরিপে মনোনয়ন পাওয়া একমাত্র বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান মারমেইড ইকো রিসোর্ট।

পর্যটন বিষয়ক প্রভাবশালী ওয়েবসাইট ‘ট্রিপ অ্যাডভাইজর’ দিয়েছে ‘এক্সেলেন্স’ সনদ। ‘লোনলি প্লানেটে’ও সেরাদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে মারমেইড।

দেশীয় এই প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে থিসিস হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি)। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে যাদের কর্ম নিয়ে থিসিস হচ্ছে, যাদের কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে এতো সব প্রাপ্তি, তারা কেউই আগে থেকে দক্ষ ছিলেন না।

এখানে এসে দীক্ষা নিয়েছেন, আর সেই দীক্ষা দিয়েই শিখরে পৌঁছে দিয়েছেন স্বপ্নচারী আনিসুল হক চৌধুরীর ভাবনাকে।

দক্ষ লোক পাওয়া যায়নি বলে অদক্ষ লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে- এমন কথা বলাও কিন্তু ঠিক হবে না। ক্ষেত্রবিশেষে দক্ষ লোক পাওয়া গেলেও অদক্ষদেরকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। কথাটি শুনে বেশ চমকে যেতে হলো। মারমেইডের ফুল-ছবি: আসিফ আজিজচাকরির বাজারে সবাই যখন অভিজ্ঞদের পেছনে ছুটছে, মারমেইড পুরো উল্টো দিকে হেঁটেছে-হাঁটছে। আবার যিনি সেকেন্ডম্যান হিসেবে সার্বক্ষণিক তদারকি করেন সেই জেনারেল ম্যানেজার মাহফুজুর রহমানও হোটেল ম্যানেজমেন্ট কিংবা ট্যুরিজম লাইনের লোক নন। তার পড়াশোনা ডিপ্লোমেটিক হিস্টোরি বা কূটনৈতিক ইতিহাসে। তিনিও এখানে শিখেছেন-শিখছেন প্রতিনিয়ত।

মাহফুজুর রহমান এটাকে ‘নোবেল জব’ মনে করেন। সে কারণে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরির অফার ছেড়ে মারমেইডকে বেছে নিয়েছেন। ডাক্তার কিংবা নার্স না হয়েও এখানে মানুষের সেবা করা যায় বলে মনে করেন তিনি।

এতো সাফল্যের উৎস কী- প্রশ্ন ছিল মাহফুজুর রহমানের কাছে। সরল উত্তর যেনো আগে থেকেই ছিল সদালাপি এই কর্মকর্তার কাছে। বললেন, আমাদের এমডির (আনিসুল হক চৌধুরী) বক্তব্য ছিল, আমরা ব্যতিক্রমী কিছু করবো, তাই দক্ষ লোক না নিয়ে অদক্ষ লোকদের নিয়োগ দেবো। আমরা যেভাবে চাই তাদের সেভাবে শিখিয়ে নেবো, এতে সুবিধা হবে। মারমেইড রিসোর্টটি প্রতিনিয়ত নতুন রূপে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে-ছবি: আসিফ আজিজআমরা যেভাবে বলেছি তারা সেভাবেই করেছে। কেউ কিন্তু বলেনি আমরা অমুক রিসোর্টে বা রেস্টুরেন্টে এভাবে হতে দেখেছি। দক্ষ লোক নিয়োগ দিলেই মনে হয় সমস্যা হতো।

কর্মীদের একাগ্রতা ও ভালোবাসার ফসল এই অর্জন। এখানে ক্লিনার থেকে বস পর্যন্ত একটি পরিবার। সবাইকে এমডি ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। এমনকি তাদের পরিবার সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন। পারিবারিক অনুষ্ঠানাদিতে উপস্থিত হন সদলবলে।

সাধারণ রেস্টুরেন্টে কোনো কিছু ভেঙে ফেললে গালমন্দ হজম ও জরিমানা গুণতে হয় স্টাফদের। কিন্তু মারমেইডে রেস্টুরেন্টের বয়দের হাত থেকে পড়ে কিছু ভেঙে গেলো, তাকে কোনোভাবেই গালমন্দ করা হয় না। বরং তাকে অভয় দিয়ে বলা হয়, তোমার আসলে ভেঙে ফেলারই কথা ছিল। তুমি কোনো ভুল করনি। তবে এখান থেকে তোমাকে শিক্ষা নিতে হবে। যেন আর কখনো এমন না হয়। মারমেইডের বিচ-ছবি: আসিফ আজিজস্টাফদের জন্য মৌসুমভিত্তিক থাকে নানারকম খেলাধুলার আয়োজন। আর এসব কারণে মুগ্ধ কর্মীরাও আপন করে নিয়েছে মারমেইডকে। তাদের আন্তরিক শ্রমে বিশ্ব দরবারে ঠাঁই করে নিয়েছে দেশীয় এই ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠানটি।

মাহফুজুর রহমান বলেন, প্রতিদিন প্রত্যেক অতিথিকে একই প্রশ্ন করি, কেমন লাগছে, কোনো সমস্যা নেইতো। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন উত্তর পাই। একজন গেস্টও কোনো বিষয়ে সুপারিশ দিলে আমরা সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করি।

একজন অতিথি বলেছিলেন, রেস্টুরেন্টের পাশে একটি কিডস্ প্লে জোন থাকলে ভালো হতো। বাবা-মা যখন আয়েশ করে খাবার নেবেন। সন্তানরা তখন কিডস্ জোনে খেলাধুলা করতে পারবে। বিষয়টি উপভোগ্য হবে। আমরা কিন্তু সেটাই করেছি। রেস্টুরেন্ট ও জুস বারের ঠিক মাঝামাঝি কিডস্ প্লে জোন করেছি।

একজন সিনিয়র অতিথি এসে জাউভাত খুঁজেছিলেন। আমরা পরদিন থেকে জাউভাত রাখা শুরু করেছি। এভাবে গ্রাহকের চাহিদা ও সুপারিশের ভিত্তিতে খাবারের মেন্যুতে ৯৯টি আইটেম যুক্ত হয়েছে। ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে।

মাহফুজুর রহমান বলেন, আমাদের এখানে একবার এক নবদম্পতি এসেছিলেন। আমরা সেই ভিলাটিকে সেই নারীর নামে নামকরণ করেছিলাম। তিনি তো দেখে আপ্লুত হয়ে পড়েন। ফোনে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে আবেগে কেঁদে ফেলেন।

আমাদের এখানে একজন অতিথি এসেছিলেন টমটম থেকে নামতে কষ্ট হয়েছিল। আমরা তাকে পিঁড়ি এনে দিয়েছিলাম। তিনি তাতেই অভিভূত। ফোন করে তার প্রবাসী মেয়েকে সেই গল্প বলেছিলেন। অতিথিরা কিন্তু খুব অল্পতেই তুষ্ট হন। সকাল বেলা রুমের সামনে একটি ফুল রেখে এলাম। সেটাকেও তারা দারুণভাবে উপভোগ করেন। ইয়োগা সেন্টার-ছবি: আসিফ আজিজমাহফুজুর রহমান আরও একটি অবাক করার মতো তথ্য দিলেন। যারা মারমেইডকে টেনে শীর্ষে নিয়ে গেছেন তারা নাকি কেউ মাছ ধরতেন, কেউ রাস্তায় ফুল বিক্রি করতেন। যারা স্বপ্নেও কখনও চাকরি করার কথা ভাবেননি। তারাই এখন দক্ষ কর্মী।

দরিদ্র পরিবারগুলো মারমেইডের সংস্পর্শে পেয়েছে স্বচ্ছলতা। এমনকি গ্রামের যে নারীটি স্বামীর আয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতেন, সেই নারীটি কলা-পেঁপে-আনারস-পেয়ারা-লেবু মারমেইডে সরবরাহ দিয়ে হাজার হাজার টাকা রোজগার করছেন।

আর ভোক্তারা পাচ্ছেন সতেজ ও নির্ভেজাল সব খাবার। বলা চলে, মারমেইডের ছোঁয়ায় নির্বাসিত পেঁচারদ্বীপের দারিদ্র্য। এখানে এলে আপনার সামনে বিশাল সমুদ্রের গর্জন, পেছনে পাহাড়। গহীনের নির্জনতা একান্তে উপভোগ, আবার রাতভর জোছনা, কিংবা সূর্যাস্ত উপভোগ সবকিছুই সম্ভব বিছানায় গা এলিয়েই। আবার নারিকেল গাছের নিচে পাতানো বিছানায় শুয়েই রাত পার করে দিতে পারেন নিশ্চিন্তে।

বিশ্বসেরা এই রিসোর্টটি প্রতিনিয়ত নতুন রূপে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে। এক বছর আগে যিনি ঘুরে গেছেন, আবার এলে পুরোপুরি নতুন মারমেইডকে দেখতে পাবেন।

**মুগ্ধতা ছড়ানো রাতের মারমেইড

**অতিথি আপ্যায়নের মারমেইড স্টাইল

বাংলাদেশ সময়: ০৬৫৬ ঘণ্টা, মার্চ ০৬, ২০১৭/আপডেট ১০২১ ঘণ্টা
এসআই/এএটি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ