কলকাতা: ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে মঙ্গলবার (১১ জুলাই) থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে রুপির ব্যবহারের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছে। এদিন দুপুরে ঢাকার একটি বিলাসবহুল হোটেলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ভারতীয় হাইকমিশনের যৌথ আয়োজনে বাণিজ্যে রুপির ব্যবহার শুরুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
ধারনা করা হচ্ছে, এতে বাংলাদেশের বছরে সাশ্রয় হবে ২০০ কোটির বেশি ডলার। অপরদিকে, একইভাবে ডলার এড়িয়ে আগামী সেপ্টেম্বর থেকে টাকা-রুপির ডেবিট কার্ড চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই কার্ড দিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে টাকা দিয়ে যেমন কেনাকাটা এবং বিভিন্ন বিল পরিশোধ করা যাবে, তেমন ভারতে ভ্রমণে রুপিতে খরচ করার সুবিধাও থাকছে।
এ বিষয়ে, ১৮ জুন নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন একটি ডেবিট কার্ড নিয়ে আসছে। এই পে-কার্ড ভারতের রুপির সঙ্গে যুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। এর জেরে বাংলাদেশিদের ডলার খরচ অনেকখানি কমবে। আর এ উদ্যোগে খুশি বর্তমানে কলকাতায় অবস্থানরত বাংলাদেশিরা। তাদের অভিমত, এতে যেমন ব্যবসায়িক কাজে আগের চেয়ে অনেকটাই সুবিধা আসবে, তেমনি ভারতে ভ্রমণ এবং চিকিৎসায় কলকাতার মানি এক্সচেঞ্জেদের হয়রানি পোহাতে হবে না।
কিছুটা দেরিতে ঈদের ছুটি পেয়েছেন ঢাকাবাসী তানজির। বর্তমানে বন্ধুদের সঙ্গে ছুটির মেজাজে কলকতার নিউমার্কেটে শপিংয়ে মজে আছেন তিনি। তার অভিমত, ডেবিট কার্ড চালু হলে আমাদের জন্য খুবই ভালো হয়। কারণ আমরা যখন কলকাতার মানি এক্সচেঞ্জগুলোয় টাকা চেঞ্জ করতে যাই তখন কেউ ৫০ পয়সা কম দিচ্ছে, কেউ ১ রুপি তো কেউ দেড় রুপি কম বলে। ফলে টাকার পরিমাণ কমে যাচ্ছে। তাই বাণিজ্যের পাশাপাশি টাকা-রুপির ডেবিট কার্ড চালু হলে আমরা যারা বাংলাদেশি তাদের সবচেয়ে সুবিধা হবে। খুব সহজেই আমরা কার্ড সুইপ করে কেনাকাটা করতে পারবো। পাশপাশি প্রয়োজন অনুয়ায়ী, এটিএম থেকে রুপি তুলতে পারবো। অযথা কলকাতার মানি এক্সচেঞ্জের হয়রানি পোহাতে হবে না।
নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছেন সুনীত দাস। তার মতে, ডেবিট কার্ড চালু হলে অনেকখানি সুবিধা হবে। বিশেষ করে যারা ভ্রমণ এবং চিকিৎসার জন্য কলকাতায় আসছেন। আমারা টাকা ভাঙাতে গিয়ে অনেকক্ষেত্রে বিড়ম্বনায় পড়ি। বিশেষ করে রাতের কলকাতায় যেসব মানি এক্সচেঞ্জ খোলা থাকে তাদের কাছে বেশি প্রতারিত হতে হয়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, মানি এক্সচেঞ্জ শপগুলো পাশাপাশি থাকলেও কারও সাথে কারোর রেটের মিল নেই। ফলে টাকার সঠিক রেট পেতে কলকাতার সবগুলো মানি এক্সচেঞ্জ ঘুরে দেখা বড় বিড়ম্বনার কাজ। এর থেকে মুক্তি দিতে পারে একমাত্র টাকা-রুপির ডেবিট কার্ড। আমরা চাই এটা দ্রুত কার্যকর হোক।
চিকিৎসার জন্য আসা ঢাকাবাসী ব্যাংককর্মী ইউসুফ বলেন, এখানে হাসপাতল, মেডিসিন শপ এবং দোকানগুলোয় টাকা সুইপ করার মেশিন আছে। মানি এক্সচেঞ্জের বিড়ম্বনা থেকে বাঁচতে আমি কলকাতায় ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করি। যদিও সেসব কার্ড ডলার নির্ভরশীল। তাতে হিসেবে অনেকটাই গোলমাল হয়। সরাসরি টাকা-রুপির কার্ড আমাদের অনেকটাই সাশ্রয় দেবে।
ঢাকা থেকে সোমবার (১০ জুলাই) সন্ধ্যায় কলকাতার চিকিৎসার কারণে এসেছেন আবু আলী। তিনি বলেন, আজ (১১ জুলাই) সকাল থেকেই বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জ ঘুরে দেখি ১০০ টাকার মান কোথাও বলে ৭৩ রুপি ৮০ পয়সা, কোথাও ৭৪ রুপি। ১৭টা মানি এক্সচেঞ্চ ঘুরে ৭৪ রুপি ৫০ পয়সা রেট পেয়েছি। আর একটু ঘুরলে হয়তো কোথাও আরও একটু বেশি পেতাম। হাসপাতালে সিরিয়াল দেওয়া আছে। এখন আমি টাকার মান খুঁজব নাকি চিকিৎসকের কাছে যাবো? এ ধরনের কথাবার্তায় আমরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ি। কোনটা সঠিক বুঝে উঠতে পারি না। এই মানি এক্সচেঞ্জের হিসাবের জন্য, অনেক সময় আমরা হিসেবে করে যে টাকা আনি সেই হিসেবে কাজ শেষ করতে পারি না। আমরা চাই গোটা কলকাতায় হয় একটাই রেট থাকুক নতুবা টাকা-রুপির ডেবিট কার্ডই এর বিকল্প হতে পারে।
এ বিষয়ে আরেক ঢাকাবাসী মো. জামিল হোসেন বলেন, বাস্তবেই এই টাকার মান নিয়ে কলকাতার মানি এক্সচেঞ্জে সমস্যার মুখে পড়তে হয়। যেমন আমিও গতকাল রাতে এসেছি। গতকাল রাত থেকেই খুঁজছি, কোথায় আমাদের টাকার মান একটু বেশি পাওয়া যেতে পারে। এরকম খুঁজতে বেরোলেই তো দিন শেষ!
একইভাবে বাংলাদেশ সরকারের এই চিন্তাকে সাধুবাদ জানিয়েছে কলকাতার হাসপাতালগুলো। তাদের অভিমত, ব্যবসায়িক লেনদেনের পাশাপাশি ডলার সমস্যা মিটলে চিকিৎসায় আর্থিক জটিলতা থেকে অনেকখানি মুক্তি পাবে বাংলাদেশিরা। কারণ, হাসপাতালে রোগীকে ভর্তি করার পর, রোগীর পরিজনদের প্রথম কাজ থাকে ডলার ভাঙ্গানো। ডেবিট কার্ড হলে এই সমস্যা থেকে অনেকটাই মুক্তি পাবে তারা। সরাসরি সব কাজ হাসপাতালেই করতে পারবেন তারা।
প্রসঙ্গত, কলকাতার নিউমার্কেট টু মারকুইস্ট্রিট সংলগ্ন এলাকায় বৈধ এবং অবৈধ মিলিয়ে কমপক্ষে আড়াইশোর মত বৈদেশিক মুদ্রা চেঞ্জ করার স্থান রয়েছে। তারা নানাভাবে নানা অছিলায় টাকার সাথে রুপির বিনিময় হেরফের করে থাকে। এ বিষয়ে বৈধ্য মানি এক্সচেঞ্জার সঞ্জীব হালদার বলেন, এ বিষয়ে বহুবার আমরা বহু অভিযোগ পেয়েছি। স্থানীয় প্রশাসনকেও সজাগ করেছি। তাও দেখছি থামছে না। এখন সবারই তো ব্যবসা। কাকে, কে বারণ করবে? ডেবিট কার্ড চালু হলে আমাদের সমস্যা হবে। তবে সমস্যা কাটবে বাংলাদেশিদের। প্রয়োজনে সুইপ করতে পারবেন আবার এটিএম থেকে ক্যাশ তুলতে পারবেন।
তবে তিনি যাই বলুক না কেনও ডেবিট কার্ড প্রচলনের সিদ্ধান্তে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন কলকাতার মানি এক্সচেঞ্জগুলো। অন্যদের অভিমত, ডেবিট কার্ড চালু হয়ে গেলে জীবিকায় এখনই এর প্রভাব না পড়লেও আগামীতে বড়ভাবে প্রভাব পড়তে চলেছে। তারা মনে করছেন, বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন বিশেষ করে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতীয় মুদ্রার লেনদেন একেবারে কমে যাবে। ফলে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বে তারা। কারণ, মারকুইস্ট্রিট হল বাংলাদেশ নির্ভরশীল অঞ্চল। সেখানে এ ধরনের ডেবিট কার্ড চালু হলে আদতেই বড় সমস্যার মুখে পড়তে হবে। তবে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা যায় না। এমনই মনে করছেন কলকাতার মানি এক্সচেঞ্জার রনি। তার অভিমত, এখন দেখা যাক কপালে যা আছে তা-ই হবে।
এখন দেখার বাণিজ্যের পাশপাশি ডেবিট কার্ডের মত সুচিন্তার কতটা সুবিধা নিতে পারে বাংলাদেশিরা। কারণ, এ ধরনের উদ্যোগে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশির সুবিধা হবে। বিশেষ করে যারা ভ্রমণ, চিকিৎসা এবং ব্যবসাসহ জন্য বিভিন্ন কাজে প্রতিবছর ভারতে আসেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১৪০ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০২৩
ভিএস/নিউজ ডেস্ক