ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ভারত

তিস্তায় কত জল!

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৩৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ৬, ২০১৭
তিস্তায় কত জল! তিস্তার ফাইল ছবি

কলকাতা: বন্ধুপ্রতীম দুই দেশের নজর এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের দিকে। বিশেষ করে কোন কোন বিষয়ে হচ্ছে প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্রের সমঝোতা স্মারক- তা রয়েছে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। সামরিক চুক্তি, ট্রানজিট প্রভৃতি ছাপিয়ে বহুল আলোচিত, প্রতীক্ষিত তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি ঘিরে আগ্রহ সবচেয়ে বেশি সাধারণ মানুষ, দুই দেশের কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের।
 
 

এর আগে একাধিকবার দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, রাজ্য প্রধানদের সফর-ফিরতি সফরে জোর সম্ভাবনা তৈরি হলেও শেষতক আলোর মুখ দেখেনি তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি।
 
বুধবার (৫ এপ্রিল) একেবারে শেষ মুহূর্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মানে দেওয়া রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নৈশভোজে উপস্থিত থাকবেন বলে জানিয়েছেন।

তিস্তা ইস্যুতে আগের চেয়ে নরম সুর মমতার। সব ঠিক থাকলে শেখ হাসিনাকে এবার আর খালি হাতে ফিরতে হবে না বলেই ভাবনা কূটনীতিকদের।

মমতা এ নৈশভোজে যোগ দিতে দিল্লি যাওয়ায় নতুন করে আশার দিগন্ত খুলেছে তিস্তা ইস্যুতে।

বাংলানিউজের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারত-বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ পাহাড়ি নদী ভারতের সিকিম অঞ্চলের হিমালয় অংশের তিস্তা খাংসে হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার ফুলচুরির তিস্তামুখে ব্রহ্মপুত্র নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে তিস্তা।
 
তিস্তার অববাহিকা প্রায় ১২শ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর মধ্যে প্রায় ৮৩ শতাংশ অর্থাৎ, ৯শ ৯৬ কিমি ভারত আর বাকি ১৭ শতাংশ অর্থাৎ, ২০৪ কিমি  বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে প্রবাহমান। তিস্তার ফাইল ছবি

সাধারণভাবে শীতমৌসুমের নভেম্বর মাস থেকে তিস্তার পানি কমতে শুরু করে। পানি কমা অব্যাহত থাকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত। এপ্রিলে পর বৃষ্টি শুরু হওয়ায় ধীরে ধীরে পানি প্রবাহ বাড়তে থাকে তিস্তায়। বিশেষজ্ঞ মত এমনই।

তিস্তা ব্যারেজ যেটা, সেটা নির্মিত ভারত সীমান্তের প্রায় ৯০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে জলপাইগুড়ির গাজলডোবা অঞ্চলে। আবার বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সীমান্তের প্রায় ১৪ কিলোমিটার অন্দরে রয়েছে দাওনি বা ডালিয়া ব্যারেজ। বাংলাদেশ ও ভারতের এই দুটি ব্যারেজই নির্মিত মূলত সেচের পানি সরবরাহের জন্য।

বাংলাদেশের তরফে তিস্তার পানির ৫০ শতাংশ দাবি দীর্ঘদিনের। এই দাবি ১৯৭২ সাল থেকে করে আসছে বাংলাদেশ। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে প্রথম একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে তিস্তার ৩৬ শতাংশ পানি বাংলাদেশ এবং ৩৯ শতাংশ পানি ভারত পাবে বলে ঠিক হয়। বাকি ২৫ শতাংশ পানি থেকে যায় অবণ্টিত অবস্থায়। উঠে এসেছে বাংলানিউজের অনুন্ধানে।

বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই ২৫ শতাংশ পানি বাংলাদেশকে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি প্রকাশ করে আসছে দীর্ঘদিন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যুক্তি অনুযায়ী, সিকিম থেকে আসা গাজলডোবাতে জমা হওয়া অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ পানি বাংলাদেশকে বণ্টন করা হলে রাজ্যের উত্তরদিকের জেলাগুলি চাষের ক্ষেত্রে পানি সমস্যার মুখে পড়বে।

২০১১ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ১৫ বছরের জন্য পানি বণ্টনের একটি প্রস্তাব আবার আলোচনার টেবিলে উত্থাপিত হয়। প্রস্তাবে বলা হয়, কম পানি প্রবাহের সময় গাজলডোবায় ভারত-বাংলাদেশের তরফে যৌথভাবে পানি প্রবাহের জরিপ করা হবে। দোয়ানি ও কাউলিয়া অঞ্চলেও যৌথভাবে প্রবাহের তথ্য সংগ্রহ করে ৯০ শতাংশ পানি বণ্টনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় আলোচিত হয়, যেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়েছিল ৪৫০ কিউসেক পানি আলাদাভাবে পরিবেশগত ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এই ৪৫০ কিউসেক পানি ভারতের অংশে ক্ষুদ্র সেচ, শিল্প ও পানীয় জলের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে। তিস্তা ব্যারেজের ছবি- সংগৃহীত

এর অর্থ দাঁড়ায়, পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে গাজলডোবায় জমা হওয়া ২৫ শতাংশ পানি থেকে পানি ছেড়ে দিতে হবে। এই শর্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকার মানতে নারাজ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে দাবি করা হয়, ২৫ শতাংশ পানি গাজলডোবায় জমা হওয়ার যে তথ্য দেওয়া হচ্ছে সেটি সঠিক নয়।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দাবি, এমন অনেক বছর গেছে যখন গাজলডোবায় ২৫ শতাংশ পানি জমা হয়নি। সেক্ষেত্রে তারা জানিয়ে দেয় গাজলডোবায় জমা হওয়া পানি ছেড়ে দিলে পশ্চিমবঙ্গে তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমন তথ্য রয়েছে বাংলানিউজের কাছে।

বলে রাখা ভালো, তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প। এর উপর প্রায় ৯ দশমিক ২২ লাখ হেক্টর জমির সেচের পানি নির্ভর করে। আর বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ৬৭.৫ মেগাওয়াট।  

পশ্চিমবঙ্গ সরকার এসব কারণ দেখিয়েই পানি বণ্টনে আপত্তি তুলে আসছে। ফলে ২০১১ সালে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং ২০১৫ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়নি।  

বাংলানিউজ প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, আলোচনায় বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে সিকিম প্রসঙ্গ। সিকিমে তিস্তার উপর একাধিক ব্যারেজ রয়েছে। যেগুলি মূলত জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। এক অংশের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যদি ওই ব্যারেজগুলি থেকে পানি ছাড়া সম্ভব হয় তবে পশ্চিমবঙ্গের অংশে পানির প্রবাহ বেড়ে যাবে। বিশেষ করে নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত, যে সময়ে নদীতে সাধারণত পানি কম থাকে। সেক্ষেত্রে গাজলডোবা থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার পানি ছাড়লেও চাষের জন্য সেচের পানির সমস্যা অনেকটাই কমে যাবে।

এ বিষয়ে ২০১৩ সালে প্রকাশিত এশিয়া ফাউন্ডেশন রিপোর্টে বলা হয়,তিস্তার উপর প্রায় ৩০টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়েছে। যার থেকে ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পারে। রিপোর্ট অনুযায়ী, এরই মধ্যে সিকিমে ৬টি বাঁধ নির্মাণ হয়ে গেছে। আর পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলায় আরও দু’টি ছোট মাপের বাঁধের পরিকল্পনা রয়েছে।

ভারতের নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র তিস্তা সমস্যার কথা বলতে গিয়ে 'নদীর ক্ষয় রোগ'-এর কথা তুলে এনেছিলেন। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তত্ত্বাবধানে গঠন করা কল্যাণ রুদ্র কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ্যে না এলেও যেটা জানা যায়, কল্যাণ রুদ্র সিকিমের বাঁধগুলির পক্ষে তার রায় দেননি। এশিয়া ফাউন্ডেশনের গবেষকসহ অনেকেই মনে করেন গাজলডোবায় যথেষ্ট পরিমাণে পানি না আসার একটি কারণ সিকিমের বাঁধগুলি।

সমস্যার মূল অংশের দিকে যদি নজর দেওয়া যায় তাহলে বোঝা যাবে সমস্যা অনেকটাই দাঁড়িয়ে আছে ঠিক কতো পরিমাণে পানি গাজলডোবায় জমা হয় তার উপর। এক্ষেত্রে ভারত-বাংলাদেশ যুগ্ম নদী কমিটির (যে আর সি) সংগৃহীত তথ্য এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু সেখানেও রয়েছে একটি পাল্টা যুক্তি। সংশ্লিষ্ট মহলের অনেকের মতেই পানির প্রবাহ নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার দেওয়া তথ্যের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে যৌথ সম্মতিক্রমে একটি অভিন্ন নীতি গ্রহণ করা যায় সেক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্থার তথ্যের মধ্যে পার্থক্যের যে সমস্যা সামনে এসেছে সেটি সমাধান করা সম্ভব।

জানা যায়, তিস্তা পানি বণ্টনের বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে একটি বিশেষ মন্তব্যের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। তিনি বলেছেন,বাংলাদেশ তার প্রিয়, কিন্তু তিনি পশ্চিমবঙ্গের চাষিদের সমস্যার মুখে ঠেলে দিতে পারেন না।

আবার বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও আশপাশের উচ্চভূমি এ নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল। এসব অঞ্চলের খাদ্যশস্য উৎপাদনে তিস্তার পানির বিকল্প নেই। শুষ্ক মৌসুমে যদি বাংলাদেশ এ পানি পায় তাহলে দেশের খাদ্য উৎপাদনের চিত্রও অনেকংশে বদলে যাবে।

বাংলানিউজের তথ্যানুসন্ধানে তিস্তার পানি নিয়ে বহু আলোচিত ইস্যুগুলির চিত্র এখন ঠিক এরকম।
 
সব বিবেচনায় এমন পরিস্থিতিতে ৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে সমাধানের রাস্তা বেরোনোর ক্ষেত্রে আলো দেখা যাচ্ছে। সেই আলোর দিকে চোখ রেখে আশা করাই যায় পানি বণ্টনের সমাধানের মধ্যে দিয়ে নতুন উচ্চতা ছোঁবে বাংলাদেশ-ভারতের মৈত্রীর সম্পর্ক।
 
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ৬, ২০১৭
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।