লাল বেনারসি, কপালে রক্ত ও শ্বেত চন্দনের টিপ, পায়ে আলতা, মাথায় ফুলের মুকুট ও গলায় ফুলের মালা নিয়ে দুর্গাষ্টমীতে ইসলাম ধর্মের শিশু পুজিত হলো কুমারী রূপে। এ আবার নতুন কী কলকাতায়! কিন্তু এ বছর প্রথা ভেঙে অভিনবত্ব হলো কুমারীপূজায়।
দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিনকে বলা হয় ‘দুর্গাষ্টমী’। রোববার (৬ অক্টোবর) চার বছর বয়সী শিশু কুমারী রূপে পুজিতা হলো তার নাম ফতেমা। হ্যাঁ ভুল শুনেননি পাঠক। সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার বার্তাবরণে ইসলাম ধর্মের শিশুকে কুমারী রূপে পূজা করে কলকাতার বাগুইআটির অর্জুনপুরের দত্তবাড়ির পরিবার।
ফতেমাকে দেবী মায়ের রূপে সিংহাসনে বসিয়ে নিয়ম মেনে আরাধনা ও পূজার্চনা করলেন দত্তবাড়ির বধূ মৌসুমী দত্ত ও তার পরিবার। আর ফতেমা হাত তুলে মন ভরে দোয়া করলো দত্ত পরিবারকে। সম্প্রীতির সাক্ষী হতে জড়ো হয়েছিল প্রতিবেশীরাও। শাখ বাজার সঙ্গে সঙ্গে করোজোরে ফতেমা জয় মা বলে উঠলেন।
নিয়ম ভেঙে এক বন্ধনের সম্প্রীতি ধরা দিলো কলকাতার বুকে দুর্গাষ্টমীতে।
পেশায় আইনজীবী মৌসুমী দত্ত বাংলানিউজকে বলেন, ‘যে ধর্মবিদ্বেষ সঞ্চিত করে, ঈশ্বরের অর্ঘ্য থেকে সে বঞ্চিত হয়। আমরা ভগবানের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে চাই না। তাই দুর্গা রূপে বরণ করে নিলাম ফতেমাকে। ’
তিনি বলেন, ‘দত্ত বাড়ির দুর্গাপূজার বয়স খুব বেশিদিনের নয়। এ বছর নিয়ে পূজার বয়স সাত বছর। ২০১২ সালে পাড়ার থিম পূজায় নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর থেকে দুর্গা প্রতিমা আনা হয়। কিন্তু সেই প্রতিমায় পূজা করতে আপত্তি জানান প্রতিবেশীরা। কথা কাটাকাটির জেরে দত্ত বাড়িতে নিয়ে আসা হয় ওই প্রতিমা। প্রথমে চিন্তায় পড়ে যাই, দুর্গাপূজার মতো এত বড় পূজা বাড়িতে কীভাবে সম্পন্ন করব? পাঁচদিন ধরে নানা আয়োজন শেষে অবশেষে মা দুর্গার ইচ্ছায় শুরু হয় দত্তবাড়ির পূজা। ’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রথম থেকেই দত্তবাড়িতে কুমারী পূজার আয়োজন করা হয়। ওই বছর এক ব্রাহ্মণ কন্যাকে পূজা করি, তার পরের বছর অব্রাক্ষণ বাড়ির মেয়ে। ২০১৪ সালে দলিত পরিবারের এক শিশু কন্যা। এভাবেই চলতে থাকে দত্তবাড়ির কুমারী পূজা। এরপর ফের একবার এক ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়েকে কুমারী হিসেবে পূজা করি। এরপর এ বছর বাড়ির সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় দুর্গাপূজায় কোনো ভেদাভেদ রাখবো না আমরা। সেই মোতাবেক এ বছর আমরা ফতেমাকে পূজা করার সিদ্ধান্ত নেই। ’
আইনজীবী মৌসুমী বলেন, ‘কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলেই তো হবে না, কুমারী রূপে যাকে পূজা করা হয় তার কিছু বিশেষ গুণ থাকতে হবে। এরপর চিন্তায় পড়ে যাই, কোনো মুসলিম পরিবার কী রাজি হবেন তাদের মেয়েকে দিতে? খোঁজ করতে শুরু করি, অবশেষে উত্তর ২৪ পরগনার কামারহাটির বাসিন্দা মুহম্মদ ইব্রাহিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার ভাগ্নিকে কুমারী পূজা করার জন্য আমাদের সহযোগিতা করেন। তার ভাগ্নির নাম ফতেমা। তার বয়স চার বছর। ফতেমার বাড়ি উত্তরপ্রদেশের আগরায়।
ধর্ম কাউকে ভেদাভেদ শেখায় না। তাই ফতেমাকেই অষ্টমীর দিন বরণ করে নিলো দত্তবাড়ি।
লাল টুকটুকে বেনারসি, চন্দন, ফুলের মালা গলায় দুর্গাপ্রতিমার সামনে বসলো ফতেমা। বেঁজে উঠলো ঢাক, কাসর, ঘণ্টা, শাখ, উলুধ্বনি। ফতেমা আর কিছুক্ষণ এখন দত্ত বাড়িতে মা দুর্গা রূপে প্রতিষ্ঠিত থাকবেন। স্মিত হাঁসিতে জীবন্ত মা দুর্গার কন্যা রূপিনী ফতেমাকে প্রণাম করে দত্তবাড়ির পরিবারসহ স্থানীয়রা।
ফতেমার মা ও মামা বলেন, ধর্ম ভেদাভেদ শেখায় না এ ভারতে। যারা করে তারা তাদের ধর্ম সম্পর্কে জানে না।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৬, ২০১৯
আরআইএস/