ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

ভারত

গঙ্গার ঘাটে ঘাটে বাঁধা কলকাতার ইতিহাস

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০২০
গঙ্গার ঘাটে ঘাটে বাঁধা কলকাতার ইতিহাস ছবি: বাংলানিউজ

কলকাতা: ভারতের সাংস্কৃতিক পীঠস্থান বলা হয় কলকাতাকে। আর শহর কলকাতা গড়ে উঠেছে গঙ্গা নদী ঘিরে।

নদী ঘিরেই গড়ে উঠেছে বিশ্বের বহু দেশের সভ্য, সংস্কৃতি। কলকাতার ক্ষেত্রেও ঘটেছে এটা। গোটা শহরের শেষ থেকে শুরু একপাশ বরাবর গা ঘেঁষে বয়ে চলেছে গঙ্গা। চলার পথে তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকটি ঘাট। যে ঘাটগুলির সঙ্গে জড়িয়ে আছে কলকাতার নানান সময়ের ইতিহাস।

সতীদাহ প্রথা থেকে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি হয়ে ব্রিটিশ শাসনের রাজধানী এই কলকাতা। সাহেব আর বাঙালির মিশ্রণে এই কলকাতাতেই তৈরি হয় বাবু কালচার। কিংবা রানি রাসমণির গঙ্গা পাড়ের ইতিহাস থেকে আধুনিক কলকাতার কংক্রিটের ধকল, সবকিছুরই সাক্ষী গঙ্গা। তাই গঙ্গা নদী ও কলকাতার নবজাগরণ অনেকটা রেললাইনের মতো সমান্তরাল। একে অপরের পাশাপাশি বিরাজ করছে প্রায় তিনশ বছরের বেশি সময় ধরে।

সে সময় নদীপথই ছিল সহজ পথ। এই গঙ্গার পথ ধরেই কলকাতায় এসেছিলেন জব চার্নক। সৃষ্টি হয় কলকাতার। গড়ে ওঠে নদীকেন্দ্রিক নগর সভ্যতা। ফলে কলকাতাকে কেন্দ্র করে তৈরি হতে থাকে গঙ্গার ঘাটগুলো। আর প্রতিটা ঘাটের নামের সঙ্গে জুড়ে যায় ইতিহাস। সেসব ইতিহাস কোথাও রূপকথা তো, কোথাও আবার বিষাদের সুর।

১৮ শতকের দিকে কলকাতায় একদিকে যেমন শহরে পরিণত হচ্ছিল তেমনই গঙ্গার পাড়ে তৈরি হচ্ছিল নানান ঘাট। এসব ঘাট নির্মিত হচ্ছিল কোথাও ব্রিটিশ সরকারের ব্যয়ে, কোথাও আবার বিত্তশালী বাবুদের অর্থায়নে।

শহরের ব্যবসা বাণিজ্য ছাড়াও এই ঘাটগুলো ছিল গঙ্গাস্নানের জন্য। আর সে কারণে কলকাতার নগরায়ণ হয়েছে গঙ্গাপাড়ের এই ঘাটগুলো থেকে। কারণ শহরের ইমারতের দ্রব্যগুলো নিয়ে আসা হতো নদীপথ ধরে। নামতো এই ঘাটগুলোতে।
 
ব্যবসার কারণে তৈরি হওয়া ঘাটগুলিতে শুধু দেশি ব্যবসায়ীরা নয়, সাহেবরাও ব্যবসার কারণে ব্যবহার করতো। তবে ছোট ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত কোনো ঘাট ছিল না, তাদের জন্য ঘাটগুলি ভাড়া দেওয়া হতো। এসব ঘাটের ঠিকা নিতো মাঝিরা, এদের বলা হতো ঘাটমাঝি।

গঙ্গার কয়েকটি বিখ্যাত ঘাট
বাবুঘাট: অনেকের ধারণা বাবুদের জন্য বরাদ্দ ছিল ঘাটটা। আসলে তা নয়। রানি রাসমণির স্বামী বাবু রাজচন্দ্র ১৮৩০ সালে গঙ্গাস্নানের জন্য ঘাটটি তৈরি করেন। সেই থেকে এই ঘাট বাবুঘাট নামে পরিচিত।

আর্মেনিয়ান ঘাট: ব্রিটিশদের আগে কলকাতায় এই ঘাট ধরে এসেছিলেন আর্মেনিয়ানরা। ইতিহাস বলছে, আলেকজান্ডার যখন আর্মেনিয়া হয়ে ভারতে এসেছিলেন তখন কিছু আর্মেনিয়ান সেনা আলেকজান্ডার সৈন্যবাহিনী যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীসময়ে আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সময় ভারতে এসেছেন। তারাই ছিলেন প্রথম বিদেশি ব্যবসায়ী। পরে তারা কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিলেন। তাদের ব্যবসার জন্য এই ঘাট ব্যবহার হতো বলে ঘাটের নাম হয় আর্মেনিয়ান ঘাট।

নিমতলা ঘাট: গঙ্গার ঘাটে ছিল শ্মশান। ১৮২৮ সালে বাবু রাজচন্দ্র এখানে একটি ঘর করে দেন, মূলত যাদের মৃত্যু হয়নি তবে মৃত্যু আসন্ন, তাদের সেই সময় গঙ্গার ঘাটে এনে রাখা হতো। হিন্দুরীতি অনুযায়ী মৃত্যুর পর অস্থি বিলীন করতে হয় ‘মা গঙ্গার’ কোলে। যাতে আত্মার স্বর্গে গমন হয়। গঙ্গাপ্রাপ্তির জন্য এই ঘাট নির্মাণ করেন বাবু রাজচন্দ্র। পরবর্তীকালে নিমতলা ঘাটে আধুনিক শ্মশান তৈরি হয়।
 
প্রিন্সেপ ঘাট: এক সময় প্রিন্সেপ ঘাট ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা, সাপ, শেয়ালের রাজত্ব। তবে এখন প্রাতঃ বা সান্ধ্যভ্রমনের জন্য বিখ্যাত। বর্তমানে প্রিন্সেপ ঘাট থেকে বাবুঘাট নানা রঙের আলোতে মোড়া। সন্ধ্যার পর জ্বলে ওঠে বাতি। রয়েছে নানা প্রজাতির ফুল। কলকাতায় যে ঘাটগুলিতে বেড়ানোর জন্য ভিড় হয় তার মধ্যে অন্যতম প্রিন্সেপ ঘাট।

এখানেই আবার আলাদা নামের ঘাট আছে, যার না জাজেস ঘাট। গঙ্গাবক্ষে নৌবিহারের জন্য এই ঘাটে প্রতিদিন বহু মানুষ হাজির হন। এক সময়ের জঙ্গলের প্রতীক হয়ে এই ঘাটগুলোয় দাঁড়িয়ে আছে ঝুরিওয়ালা শ শ বছরের একাধিক বট ও অশ্বত্থ গাছ।

জগন্নাথ ঘাট: সে সময় কলকাতা থেকে উড়িষ্যা যাওয়ার রেললাইন চালু হয়নি। রথ উৎসব ছাড়াও পুরীর মন্দিরে জগন্নাথ দর্শনের জন্য যাত্রীরা এই ঘাট থেকে ব্রিটিশদের জাহাজে উঠতেন। এই পথ দিয়েই দেব দর্শনে যেতেন বলে ঘাটের নাম হয় জগন্নাথ ঘাট।

অন্নপূর্ণা ঘাট: এই ঘাটে চালের ব্যবসা হতো বেশি। চালের অপর নাম অন্ন। দেবী অন্নপূর্ণা অন্নেরই প্রতীক। বাগবাজারের বিষ্ণুরাম চক্রবর্তীকে বিলেতে যাওয়ার সময় লর্ড হেস্টিংস মন্দিরের জন্য ৫২ বিঘা জমি দান করেন। ওই জমিতে অন্নপূর্ণা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিষ্ণুরাম। মন্দির লাগোয়া ঘাট থাকায় ঘাটটির নাম হয় অন্নপূর্ণা ঘাট।

কুমোরটুলি ঘাট: ১৮ শতকের মাঝামাঝি বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কলকাতায় ব্যবসার কারণে মৃৎশিল্পী কুমোররা বাস করতে শুরু করেন কুমোরটুলিতে। যেখানে প্রায় সারাবছর সব প্রতিমা গড়ার পাশাপাশি মাটির বাসন কোসন তৈরি হতো। এই কুমোরটুলির সামনে অবস্থিত ঘাটটি নাম পায় কুমোরটুলি ঘাট। গঙ্গাপথে প্রতিমা থেকে মাটির নানা সরঞ্জাম নিয়ে আসা যাওয়ার জন্য এই ঘাট ব্যবহার করা হতো।

বাগবাজার ঘাট: এই ঘাট হলো কলকাতার আদি ও প্রাচীন ঘাট। এই ঘাটটি রঘু মিত্র ঘাট নামে পরিচিত ছিল। কলকাতার নগরয়াণে অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই ঘাট সে সময় অনেকখানি ভূমিকা রেখেছিল। ব্রিটিশ শাসনকালে বাগবাজারের এই ঘাটের মাধ্যেমেই ব্যবসায়িক পণ্য আসা-যওয়া হতো। এছাড়া এই ঘাটকে পূণ্য ঘাট হিসেবেও মনে করেন হিন্দুরা। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য এই ঘাট সবচেয়ে বেশি প্রধান্য পায়। তৎকালীন ব্রিটিশরা সরকারি অর্থায়নে এই ঘাট নির্মাণ করেছিলেন।

বলরাম বসু ঘাট: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের পাড়াতে এই গঙ্গার ঘাট। কলকাতার সনাতন ধর্মের প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপূজা ১৯১০ সালে এখানেই শুরু হয়। এখানে বাহ্যিক জাঁকজমকের চেয়ে সনতনী মতে পূজা হয়। কারণ এই ঘাটেই একসময় সতীদাহ প্রথার চল ছিল। সতীদাহের স্মৃতিচিহ্ন কিছু না থাকলেও লোকমুখে কিছু চর্চা শোনা যাবেই। এই ঘাটেই দুই আভিজাত ব্রাহ্মণ বিধবার সতীদাহ হয়েছিল। তারও ফলক ছিল এই ঘাটে। মুখ্যমন্ত্রী ঘাট সংস্কারের সময় ফলকটি আসল জায়গা থেকে সরিয়ে মিউজিয়ামে স্থানন্তারিত করেন।

এছাড়া কালীঘাট, টালাঘাটসহ কলকাতায় আরও একাধিক ঘাট আছে। এবং প্রতিটি ঘাটের সঙ্গে জুড়ে আছে ইতিহাসের বিভিন্ন দলিল। যা আজও কোথাও স্পষ্ট, কোথাও আবার অস্পষ্ট।

পুরনো কলকাতার ইতিহাস ঘাটলে গঙ্গা নদীর অবদান সবচেয়ে বেশি নজরে পড়বে। যা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না।  

বাংলাদেশ সময়: ১২০৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০২০
ভিএস/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।