কলকাতা: ভারতের নিরিখে এক নজিরবিহীন আন্দোলন কলকাতায় ৬০০ দিন পার করলো। চাকরির দাবিতে একইস্থানে বসে টানা ৬০০ দিন ধরনা প্রতিবাদ এ এক নজিরবিহীন দৃশ্য।
কলকাতার গান্ধী মূর্তির পাদদেশে চাকরির দাবিতে ধরনা শনিবার (৫ নভেম্বর) ৬০১তম দিন পার করছে। তবুও যেন গাছাড়া মনোভাব রাজ্যের শাসক দলের।
৬০১ দিন ধরে কলকাতার এক প্রান্তের সড়কে বসে আছেন ধরনাকারীরা। রেডরোড আর মেওয়া রোডের ক্রসিং সংলগ্ন কলকাতা প্রেসক্লাব লাগোয়া গান্ধী মূর্তি পাদদেশ, সেখানেই ‘অধিকার’ মঞ্চের ব্যানারে রাজ্যের শতাধিক নবম থেকে দ্বাদশের হবু শিক্ষক-শিক্ষিকা পদপ্রার্থীরা ধরনায় রয়েছেন। তাদের দাবি, পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি) কর্তৃপক্ষের অবৈধভাবে শিক্ষক নিয়োগের কারণে মেধা তালিকাভুক্ত সামনের দিকে থাকা যোগ্য প্রার্থীরা চাকরিতে নিয়োগপত্র পাননি। তারা তাদের ন্যায্য চাকরি ফিররে পেতে মরণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এই দাবিতেই ৬০০ দিন পার করলেন তারা।
ধরনায় বসা কেউ গ্রাম থেকে, কেউ শহরতলী থেকে এসেছেন। কেউ আবার কলকাতা শহরেরই বাসিন্দা। মাসের পর মাস ঘরছাড়া, পরিবার ছাড়া তারা। কেউ সন্তান কোলে, কেউ স্বামী-কেউ বাবাকে হারিয়েও দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছেন ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর পায়ের নীচে। প্রতিবাদ মঞ্চে। এ শহর নানান ইস্যুতে ‘হোক প্রতিবাদ’ কিংবা ‘হোক কলবর’ আওয়াজ তুলেছে। কিন্তু চাকরির দাবিতে এতদিন ধরে চলা ‘প্রতিবাদ’ কস্মিনকালেও কেউ দেখেনি। তাই পথ চলতি অনেকেই তাদের দেখছে। তাদের ছবি তুলছে আবার নীরবে চলে যাচ্ছেন। এই নীরবতাই আগামীতে কোনো অন্ধকার নামিয়ে আনবে কিনা তা তো সময় বলবে!
তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে রাজ্যের বিরোধী রাজনৈতিক দল, সমাজসেবী, শিক্ষকমহল, বিদগ্ধজন সবাই। চাকরিপ্রার্থীদের আকুতি আদালত পর্যন্ত পৌঁছেছে। মধ্যে শাসকদলের নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী প্রার্থীদের সঙ্গে বৈঠক করলেও বরফ গলেনি। তাই এখনও চলছে আন্দোলন। তবে ধরনাকারীরা নিজেদের ভবিষ্যত না জানতে পারলেও আলোর সন্ধান পাচ্ছেন। কিন্তু কিভাবে? তবে তার আগে জানতে হবে কেনো তাদের এই দাবি?
ধরনাকারীদের অভিযোগ, বর্তমান রাজ্য সরকার টাকা দিয়ে অযোগ্যদের কাছে চাকরি বিক্রি করছে। যোগ্যরা চাকরি পাচ্ছে না, টাকা নিয়ে অযোগ্যদের চাকরিতে ঢোকানো হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির যে জাল তৈরি হয়েছে তা ছিড়ে ফেলতে হবে। তা না হলে কোনো যোগ্য মানুষ নিয়োগ পাবে না। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্র অযোগ্যদের হাতে চলে যাবে। শিক্ষা ব্যবস্থা ভঙ্গুর হয়ে পড়বে।
এসব বলার কারণ? শুরুটা হয়েছিল ২০১৪ সালে, মধ্যে কিছুটা আন্দোলন তারপর স্থিতিশীল। ২০১৬ সালে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পান পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ২০১৭ সালে চাকরির পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণদের, মেধা তালিকায় নাম আছে। তবু চাকরি পেলো না। যারা শুধু উত্তীর্ণ হলো অথচ মেধা তালিকায় নাম নেই। অভিযোগ, অর্থের বিনিময় তারা চাকরি পেতে শুরু করে। জানাজানি হতেই সরকারি মদতপুষ্টরা গোপনে ধামাচাপা দেওয়া শুরু করে। আর তাতেই নড়ে গেল সিস্টেম।
মামলা গড়ালো কলকাতা হাইকোর্টে। নেতৃত্ব দিলেন বামনেতা খ্যাতনামা আইনজীবি বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য়্যর মতো ব্যক্তিত্বরা। নজরে এলো হাইকোর্টে প্রধান বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের। তার নির্দেশ অনুযায়ী তল্লাশি। ধরা পড়ল রাজ্যের সাময়িক বহিষ্কৃত শিল্পমন্ত্রী তথা সাবেক মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অর্পিতা মুখোপাধ্যায়, বিধায়ক তথা শিক্ষা পর্ষদের মানিক ভট্টাচার্য্য, কল্যাণময় বন্দোপাধ্যায়সহ অনেকে।
পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক দুর্নীতি যখন একদিকে এই পরিস্থিতি তখন, অন্যদিকে বিচারপতির নির্দেশে ধরপাকড় শুরু অযোগ্য শিক্ষকদের। সেখানেও কেঁচো খুড়তে কেউটে বের হতে শুরু করল। রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশচন্দ্র অধিকারীর কন্যা অঙ্কিতাকে শিক্ষিকার চাকরি থেকে বরখাস্ত করলেন কলকাতা হাইকোর্ট।
জানা যায়, ২০১৮ সালে এসএসসির মাধ্যমে শিক্ষিকার চাকরি পান অঙ্কিতা অধিকারী। চাকরি প্রার্থীদের তালিকায় তার নাম না থাকা সত্ত্বেও অঙ্কিতা চাকরি পেয়েছিলেন। মামলাকারী ববিতা বিশ্বাস অর্থাৎ যার নাম বাদ দিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর কন্যা অঙ্কিার চাকরি হয়েছিল সেই ববিতার দাবি, ‘স্টেস লেভেল সিলেকশন’এ তিনি ৭৭ নম্বর পেয়েও চাকরির জন্য যোগ্য বলে রাজ্য সরকারের কাছে বিবেচিত হননি।
কিন্তু অঙ্কিতা অধিকারী ৬১ নম্বর পেয়েই চাকরি পেয়েছেন। এক দুমাস নয়, ৪১ মাস ধরে চাকরি করেছেন অঙ্কিতা। পরবর্তীতে হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী, ৪১ মাসের বেতন এবং ইন্দিরা গার্লস হাইস্কুলে চাকরি দুটোই পান ববিতা। বর্তমানে সিবিআই তল্লাশি চালাচ্ছে বীরভুমের দাপুটে নেতা অনুব্রত মন্ডলের কন্যা সুকন্যা মন্ডলের ওপর। অঙ্কিতার মতো তার বিরুদ্ধেও অবৈধ চাকরি করার অভিযোগ আছে। সুকন্যার দোষ এখনও প্রমাণ হয়নি, তবে তার বাবা এখন জেলে। এরকম অনেক অঙ্কিতার চাকরি হয়েছে ববিতাদের না জানিয়ে।
আদালতের এমন নির্দেশে আলোর সন্ধান পাচ্ছেন ববিতার মতো চাকরি প্রার্থী ধরনাকারীরা। পাশে পাচ্ছেন বাম-ডান-বিজেপির মতো রাজনীতিবিদ থেকে বহু বিদগ্ধজন ও শিক্ষকদের। নীরব পথ চলতিরাও এক বুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুদিনের আসায় আছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ ঘণ্টা, ০৫ নভেম্বর, ২০২২
ভিএস/এসএ