কলকাতা: বহু বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগের কোনো পরীক্ষা হয় না। শেষ পরীক্ষা হয়েছে বাম শাসনের আমলে।
২০০৯ সালের টেট (প্রাইমারি শিক্ষক) নিয়োগ পরীক্ষা এবং ২০১৪ ও ২০১৭ সালের এসএসসির (নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি) শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের দুর্নীতির পর সম্প্রতি সামনে এসছে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের (এমএসসি) দুর্নীতি। তারা সংখ্যায় কম হলেও সরগরম বাংলার শিক্ষামহল। দুর্নীতির তদন্তে ইতোমধ্যে মাঠে নামছে সিবিআই। প্রসঙ্গত, স্কুলে নিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন স্কুল সার্ভিস কমিশন রয়েছে, তেমনই মাদ্রাসায় নিয়োগের জন্য বাম আমলে ২০০৮ সালে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন তৈরি হয়।
টেট দুর্নীতি মামলায় ইতোমধ্যেই ২৭০ জনকে চাকরি থেকে বরখাস্তের নির্দেশ দিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। এই পরিস্থিতিতে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনেও দুর্নীতির খোঁজ পেতেই তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায় বিচারপতিকে। নতুন করে আর কোনো দুর্নীতির খোঁজ পেলে প্রয়োজনে মাদ্রাসা কমিশন তুলে দেওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন তিনি। যা নিয়ে রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে।
মাদ্রাসা কমিশনে নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ তুলে আদলতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন ৮ জন চাকরিপ্রার্থী। তাদের অভিযোগ, উপযুক্ত প্রার্থীদের অগ্রাধিকার না দিয়ে কম মেধার প্রার্থীদের নিয়োগের সুপারিশ করেছে কমিশন। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতেই কম মেধার প্রার্থীরা চাকরি পেয়েছেন। তারপরেই আদালতের দ্বারস্থ হন আবদুল হানিফ, আকমল হোসেনসহ ৮ চাকরিপ্রার্থী।
প্রসঙ্গত, এক মামলাকারী আবদুল হানিফের উত্তরপত্র ভুল থাকার কারণ দেখিয়ে বাতিল করে দেয় মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন। কিন্তু, মামলাকারীর অভিযোগ ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। উত্তরপত্রে কারসাজি করে তার খাতা বাতিল করে দেওয়ার অভিযোগ তোলেন মামলাকারী। তিনি জানিয়েছেন, তার দেওয়া পরীক্ষার উত্তরপত্রে অন্য কেউ কলম চালিয়েছে। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় মামলার সমস্ত দলিল দেখে উত্তরপত্র এবং কলমের কালি ফরেন্সিক টেস্ট করতে কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিকে নির্দেশ দেন।
জানা যায়, ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা হয়। ফলপ্রকাশ হয় সেই বছরেরই ১১ আগস্ট। উত্তরপত্রে ভুল থাকার কারণে বাতিল করা হয় মামলাকারীর খাতা। এমনই দাবি করে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন। আদালতে হামিদ জানিয়েছেন, ‘এ’ ‘বি’ ‘সি’ ‘ডি’—এই চার ধরনের প্রশ্ন ছিল। তিনি ‘এ’ এবং ‘বি’-তে টিক মার্ক দিয়েছিলেন। কিন্তু ‘সি’ বা ‘ডি’-তে তিনি কোনো টিক মার্ক দেননি।
নির্দিষ্ট প্রশ্নে উত্তরগুলো দুটোর বেশি তিনটিতে টিক দিলে তা ভুল বলে ধরা হবে। হামিদের কথা মতো, তিনি সমস্ত প্রশ্নের উত্তর সঠিক দিয়েছিলেন। ভুল উত্তরগুলোতে অন্য কালির কলম ব্যবহার করা হয়েছে।
এরপরই বিচারপতি হামিদকে জিজ্ঞেস করেন, যে কলম দিয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন, তা আছে কিনা? হামিদ সম্মতি দেন, আছে। হামিদ সেই কলম জমা দেন আদালতে। হামিদের দাবি ছিল, তার তথ্য যদি মিথ্যে প্রমাণ হয় তাহলে তিনি জরিমানা দিতেও প্রস্তুত।
এরপরই ওই কলম ফরেন্সিকের জন্য পাঠাতে নির্দেশ দেন আদালত। ওই কলমের কালি ও উত্তরপত্রের কালি মিলিয়ে দেখা হবে বলে জানান আদালত। এরপরই দেখা যায় উত্তরপত্রে দুই রকম কালি ব্যবহার করা হয়েছে। যে কলম হামিদ ব্যবহার করেছেন তার উত্তর সঠিক ছিল। ভুলগুলোয় অন্য কলমের কালি ব্যবহার করা হয়েছে। কোন কলম ব্যবহার করা হয়েছে এবং কে করেছে তার তদন্ত করার নির্দেশ দেন আদালত। তবে কোন কেন্দ্রীয় সংস্থা তদন্ত করবে তা ঠিক হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে সিবিআইয়ের কাছেই যাবে।
বিচারপতির নির্দেশ হামিদের মতো মেধাবীকে সমাজ হারাচ্ছে। মাদ্রাসা কমিশনকে বিচারপতি নির্দেশ দিয়েছেন, হামিদের ইন্টারভিউ নিয়ে নিয়োগ দিতে এবং সম্পূর্ণ ইন্টারভিউ ভিডিও করে রাখতে। ইতোমধ্যে হামিদের ইন্টারভিউ শেষ হয়েছে। তবে আগামীতে হামিদ চাকরি পাচ্ছেন কিনা তা জানা যায়নি।
এ মালারই রায় দিতে গিয়ে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় মাদ্রাসা কমিশন তুলে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। আদালতের নির্দেশে ৭০ হাজার রুপির জরিমানা করা হয়েছে মাদ্রাসা কমিশনকে। মামলাকারী ওই ৮ চাকরিপ্রত্যাশীর মধ্যে তা ভাগ করে দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি।
পাশাপাশি পরবর্তীতে চাকরির বিজ্ঞপ্তি হলে যাতে প্রত্যাশীরা কোনোভাবে বঞ্চিত না হন তাও বিশেষভাবে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি। যা নিয়েই শোরগোল পড়ে গিয়েছে শিক্ষামহলের অন্দরে। তবে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় টেট, এসএসসি এবং এমএসসি নিয়ে যেভাবে একের পর যুগান্তকারী রায় দিয়ে চলেছেন, তাতে ইতোমধ্যেই অলিখিত রবিনহুডের তকমা পেয়েছেন সমাজের একটা বড় অংশের কাছে। অপরদিকে চক্ষুশূল হয়েছেন শাসক শিবিরের কাছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০২২
ভিএস/এমজেএফ