তবে দেশের চামড়া শিল্পের অন্যতম বৃহত্তম কাঁচামালের যোগানদাতা হিসেবে নাটোর দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও অবদান রেখে চলেছে। যা অনেকটাই অজানা দেশবাসীর কাছে।
নাটোর শহরের প্রায় একমাথায় রেলস্টেশন। রেলস্টেশনের পাশেই বাজার। বাজারের পরে একটি রেলগেট। এই রেলগেটের ব্যস্ততম সড়কটি ধরে জেলা পরিষদ কার্যালয়ের দিকে এগুতেই নাকে লাগে পরিচিত এক বোটকা গন্ধ। হ্যাঁ, এটাই নাটোরের বিখ্যাত চামড়ার হাট।
রেলগেট থেকে জেলা পরিষদ ভবন পর্যন্ত প্রায় অর্ধকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই হাটকে বৃহত্তর উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় চামড়ার হাট ও আড়ৎ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত চামড়া শিল্পের কাঁচামালের অন্যতম যোগানদার নাটোরের এই চামড়ার হাট।
নাটোরের চামড়াপট্টিতে শুক্রবার ছিলো হাটের দিন। এই হাটে বেচাকেনা জমে ওঠে সকাল থেকেই। তবে বেলা দশটার দিকে চামড়াপট্টি ঘুরে খুব একটা প্রাণ খুঁজে পাওয়া গেল না এদিন। অথচ এ সময়টাতেই ফড়িয়া, ব্যাপারী আর পাইকারদের পদচারণায় মুখর থাকার কথা ছিলো পুরো হাট এলাকা। রেলগেট থেকে জেলাপরিষদ কার্যালয় পর্যন্ত সড়কের দুই ধারে চামড়ার বড় বড় সব আড়ৎ। হাটের কয়েকটি আড়তের সামনে বিকিকিনির জটলা দেখা গেলেও ফাঁকাই পড়ে ছিলো বেশির ভাগ আড়ৎ। আড়ৎগুলোর গদিতে বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন মহাজন ও ম্যানেজাররা। কোনো কোনো আড়তে আগের কেনা চামড়ায় লবণ লাগাচ্ছেন কর্মচারীরা। জানা গেল, একটি গরুর চামড়ায় লবণ লাগে প্রায় দশ কেজি। আর ছাগলে লাগে পৌনে এককেজি থেকে এক কেজি।
রেলগেটের পরেই একটি মোটামুটি বড় চামড়ার আড়ৎ। রানা ট্রেডার্স। মালিক বদরুদ্দিন কোরায়শি। ম্যানেজার বীরেন চৌহান। বসেছিলেন গদিতেই।
জানালেন, চামড়ার বাজারে এখন চলছে স্মরণকালের মন্দা। ট্যানারি মালিকরা চামড়া কিনছেন না বললেই চলে। গরু-খাসির চামড়ার দাম নেমে এসেছে পূর্বের দামের তিনভাগের একভাগে। বাজারে আমদানিও কম। আবার ট্যানারি মালিকরা চামড়া কিনছেনও না, সেই সঙ্গে আড়ৎদারদের পুরনো বকেয়াও পরিশোধ করছেন না। ট্যানারি মালিকদের কাছে নাটোরের চামড়ার হাটের এক একজন আড়ৎদারের কোটি কোটি টাকা আটকা পড়ে আছে।
কবে এই দুর্দিনের শুরু? জিজ্ঞেস করত জানা গেলে, হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে ট্যানারি স্থানান্তর কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই মূলত আরম্ভ হয়েছে এ সঙ্কট।
হাজারীবাগের অধিকাংশ ট্যানারিই সাভারে এখনও ঠিকভাবে কাজ শুরু করেনি। একই সঙ্গে হাজারীবাগেও বন্ধ আছে চামড়ার সব শিল্প কারখানা। আবার হেমায়েতপুরে যে সব ট্যানারি ইতোমধ্যে স্থানান্তরিত হয়েছে সেগুলোর বেশির ভাগই গ্যাস,বিদ্যুৎ ইত্যাদি নানা সমস্যায় জর্জরিত। এ অবস্থায় ট্যানারি মালিকরা নতুন করে উৎপাদনে যেতে পারছেন না। ফলে বন্ধ রেখেছেন কাঁচা চামড়া কেনা। মূলত এরই ধাক্কা লেগেছে নাটোরের চামড়াপট্টিসহ সারাদেশের কাঁচা চামড়ার বাজারে।
যে ছাগলের চামড়া আগে বিক্রি হতো ৭৫ থেকে ১শ’ টাকা স্কয়ার ফুট। তার দাম এখন নেমে এসেছে ২০ থেকে ২৫ টাকা স্কয়ার ফুটে। একই অবস্থা গরু-ভেড়ার চামড়ার দামেও।
একই কথা জানালেন, পাশের চামড়া আড়তের মালিক বয়োবৃদ্ধ হাজী আমিনুল্লাহ। স্বাধীনতার পর থেকেই এই আড়তে চামড়ার ব্যবসা করছেন তিনি। জানালেন, ট্যানারি মালিকদের কাছে তার পাওনা প্রায় কোটি টাকা। তারা টাকাও দিচ্ছে না, চামড়াও কিনছেন না। মাঝখানে থেকে ফেঁসে গেছেন তার মত নাটোরের চামড়া পট্টির আড়ৎদাররা।
পরিস্থিতির অবসানে দ্রুত হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্প নগরীকে পরিপূর্ণভাবে উৎপাদনে যাওয়ার উপরে জোর দিলেন নাটোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হালিম সিদ্দিকিও।
তার মতে, যতদিন হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্প নগরী পুরোদমে চালু না হবে, ততদিন এ অবস্থা চলতেই থাকবে। এছাড়া আগামী কোরবানি ঈদের আগেই যদি হেমায়েতপুরে ট্যানারিগুলো পুরোদমে উৎপাদনে যেতে না পারে তবে নাটোর তথা সারা দেশের কাঁচা চামড়ার বাজারে বিপর্যয় নেমে আসবে।
হালিম সিদ্দিকি জানালেন, পরিস্থিতি এখন যা দাঁড়িয়েছে তাতে একমাত্র সরকারই পারে তাদের এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে। আগামী কোরবানির ঈদেও যদি ট্যানারি মালিকরা তাদের কাছ থেকে চামড়া না কেনেন, তাহলে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়বেন এই চামড়ার হাটের শতাধিক আড়ৎদার। এমনসটাই জানালেন হালিম সিদ্দিক।
বাংলাদেশ সময়: ১১১৫ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০১৭
জেডএম/