ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প

পোশাক শিল্পের প্রাণ নারী শ্রমিকরা ভালো আছেন তো!

ইয়াসির আরাফাত রিপন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২৪ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০২০
পোশাক শিল্পের প্রাণ নারী শ্রমিকরা ভালো আছেন তো! কারখানায় কর্মরত পোশাক শ্রমিকরা (ফাইল ছবি)

ঢাকা: আমাদের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক শিল্প। অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে এ খাতের অবদান অপরিসীম। এ শিল্পের হাত ধরে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে পেয়েছে নতুন পরিচিতি। পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণের আনুষাঙ্গিক উপকরণ সূতা, প্যাকেজিং শিল্পেরও প্রসার ঘটেছে। বেড়েছে পরিবহন, শিপিং ও ব্যাংকিং সেক্টরের পরিসর।

দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৪ ভাগ আসে পোশাক খাত থেকে। এ খাতে কাজ করেন ৪৫ লাখের বেশি শ্রমিক।

এর মধ্যে ৮০ ভাগের বেশি শ্রমিকই নারী।

পোশাক শিল্পের কল্যাণে দেশের অনেক নারীই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। পাশাপাশি বেড়েছে তাদের ক্ষমতাও। অন্যদিকে বিপরীত চিত্রও আছে। এই শিল্পে কাজ করতে এসে অসংখ্য নারী শ্রমিক অধিকার বঞ্চিত হচ্ছেন। পাচ্ছেন না শ্রমের উপযুক্ত মূল্য। চাকরি হারিয়ে পথে বসছেন অনেকেই।

সরকারি সেক্টরের মতো এই শিল্পে মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই বলে মা হওয়ার আগে তাদের চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। পিরিয়ডের সময়গুলোতেও তাদের পোহাতে হয় ভোগান্তি।

লাকি আক্তার একজন নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য। এক সময় পরিবাবের বোঝা ছিলেন। সয়েছেন নানা নির্যাতন আর বঞ্চনা। গত পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করেন মতিঝিলের একটি পোশাক কারখানায়। দু’হাজার টাকা বেতন থেকে আজ তার বেতন ১২ হাজার টাকা। ‘ওভার ডিউটি’ বাবদও তিনি টাকা পান। মাসে তার আয় ১৬/১৭ হাজার।

লাকি আক্তার জানান, এক সময় তার মা গ্রামে (রংপুরের পীরগঞ্জে) ঝিয়ের (অন্যের বাড়ি) কাজ করতেন। তিনি অসুস্থ হওয়ার পর পরিবারের খরচ চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। বৃদ্ধ বাবা তেমন কোনো কাজ কর্ম আর করতে পারেন না। বাধ্য হয়ে বোনকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। পোশাক কারখানায় চাকরি করেই তিনি এখন মা বাবার খরচের পামাপাশি নিজের সংসারের খরচও চালান। স্বামীর কাছেও রয়েছে লাকির কদর। পরিবারকে সাহায্য করার পাশাপাশি তিনি সন্তানকে লেখা পড়াও করাচ্ছেন।

লাকির মতো তার মতো আরও লাখ লাখ লাকি রয়েছে ঢাকা শহরে। কাজ করে নিজের ভাগ্য গড়েছেন। কিশোরী ও মাঝ বয়সি নারীরা প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসে ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে পোশাক কারখানায় কাজ করছেন। নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের পাশাপাশি দেশের জন্যও তারা শ্রম দিচ্ছেন।

অন্যদিকে হাজার হাজার নারী শ্রমিক রয়েছেন যারা নানা সমস্যায় জর্জরিত। তাদের কর্মক্ষেত্রে নেই স্বাস্থ্য সম্মত টয়লেট, বিশুদ্ধ পানি। পরিশ্রম করার পরও মাস শেষে বেতন পান না ঠিকমতো। কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। মালিক হয়ে যায় লাপাত্তা।

এমনই এক নারী শ্রমিক শরিফা। আশুলিয়ায় একটি সাব কন্ট্রাক্ট কারখানায় কাজ করেন তিনি। শরিফা জানালেন, কাজ শেষে বেতন পেলে কাজে আগ্রহ বেড়ে যায়। তিন মাস কাজ করার পর এক মাসের বেতন পেয়েছি। এখনও দুই মাসের বাকি। ঘরভাড়া দিতে পারছি না, দোকন থেকে বাকিতে কিনতে হচ্ছে চাল ডাল।

এই সেক্টরের একটি অংশ দীর্ঘকাল নারীদের সঙ্গে আমানবিক আচরণ করে এলেও এর কোনো প্রতিকার নেই। বড় কারখানার মালিকরা ছোট কারখানায় কাজ না করার উপদেশ দিলেও দিন শেষে তারাই ছোট কারখানাগুলো থেকে কাজ করিয়ে নেন। কিন্তু শ্রমিকদের কথা ভাবেন না।

পোশাক শিল্পে নারীরা কেমন আছেন সে বিষয়ে মতামত জানতে প্রশ্ন করা হলে গ্রীণ বাংলা ওয়াকার্স ফেডারেশনের নারী বিষয়ক সম্পাদক মাকসুদা আক্তার ইতি বলেন, দীর্ঘ ও অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নারীসমাজ ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। নাগরিক হিসেবে পুরুষের সমান অধিকার থাকা সত্ত্বেও নারীরা অনেক ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছেন। নারীর নিরাপত্তার অবস্থা অনেক সময় হতাশাব্যঞ্জক, তখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ নানা ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে এটা সার্বিক বিবেচনায় কতটা অগ্রগতি তা ভেবে দেখার বিষয়। তাছাড়া অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের বৈষম্য এখনো রয়ে গেছে।

এ শ্রমিক নেত্রীর মতে, সরকারি সেক্টরের মতো অন্যান্য সেক্টরেও মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাস ঘোষণা করতে হবে। সকল নারী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য-সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কর্মস্থলে নারী শ্রমিকদের জন্য স্যানেটারী ন্যাপকিনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া নারীর সামাজিক মর্যাদা ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি প্রত্যেক কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টারের ব্যবস্থা করতে। এটাই হোক নারী দিবসের অঙ্গিকার।

পাপিয়া দীর্ঘ দিন স্বামীর সঙ্গে গার্মেন্টসে শ্রমিক হিসেবে কাজ করলেও এখন তিনি নিজেই ছোট পরিসরে কারখানা গড়েছেন। চুক্তিভিত্তিতে বড় কারখানা থেকে কাজের অর্ডার নেন। তিনি বলেন, এখাতে শ্রমিকেরা কাজ করবে কিন্তু মজুরি পাবে না এটা হয় না। মাস শেষে নারীর বেতন তাকে কাজের স্পৃহা আরও বাড়িয়ে দেয়। তবে অনেক কারখানা অর্থাভাবে উৎপাদনে যেতে পারছে না। তারা শ্রমিকের মজুরি ঠকিয়ে কারখানা বন্ধ করে চলে যায়।

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও এফবিসিসিআইএর সহ-সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আমাদের শ্রমিক ভাই-বোনদের কারণেই আমাদের শিল্পের বিকাশ, বিশেষ করে মেয়েরা এগিয়ে নিয়েছেন এ খাত। ক্রেতা-শ্রমিক-উদ্যোক্তা মিলেই আমরা এ দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে কাজ করছি। দেশের তৈরি পোশাক খাত শৃংখলার মধ্যে এসেছে। শ্রমিকের বেতন বেড়েছে, আবার এ শিল্পে চ্যালেঞ্জও যোগ হয়েছে। বিশ্ব বাজারে তৈরি পোশাক শিল্পের দর কমে যাওয়ায় অনেক ছোট কারখানা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। তারা বাধ্য হচ্ছেন বন্ধ করে দিতে। তবে সাবকন্ট্রাক্টে যারা কাজ করে তাদের সমস্যা থাকলেও বিজিএমইএ সদস্যভুক্তরা শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি দিয়ে থাকেন।

বাংলাদেশ সময়: ২১২৪ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০২০
ইএআর/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।