ঢাকা: দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে স্থিতিশীলতা ও সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিত এবং নতুন বিনিয়োগের জন্য সিগনিফিক্যান্ট মার্কেট পাওয়ার (এসএমপি) গাইডলাইনের কার্যকর বাস্তবায়নের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন এখাতের সংশ্লিষ্টরা।
মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে টেলিকম রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ (টিআরএনবি) আয়োজিত ‘টেলিযোগাযোগ খাত: বিনিয়োগে ধীরগতি ও অসম প্রতিযোগিতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ আহ্বান জানানো হয়।
বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন, এসএমপি গাইডলাইন সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে ছোট অপারেটরদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। একইসঙ্গে অবকাঠামো শেয়ারে উৎসাহ বাড়বে এবং এই খাতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে।
টিআরএনবির সভাপতি সমীর কুমার দের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে স্বাগত বক্তব্য দেন টিআরএনবির সাধারণ সম্পাদক মাসুদুজ্জামান রবিন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টিআরএনবির সাংগঠনিক সম্পাদক আল আমিন দেওয়ান।
গোলটেবিল বৈঠকে জানানো হয়, মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের ধারাবাহিক বিনিয়োগ সত্ত্বেও প্রতিবছর গ্রাহকপ্রতি গড় আয় কমে যাচ্ছে। ২০০৯ সালে যে গড় আয় ছিল ৩ মার্কিন ডলার, তা বিগত বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্যহারে কমে গিয়ে বর্তমানে ১.৩ মার্কিন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। কমতে থাকা এই আয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচ্চ করের বোঝা এই খাতের প্রবৃদ্ধিকে গতিহীন করছে। উচ্চ কর ও তীব্র প্রতিযোগিতা ছোট অপারেটরদের প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে; ফলে খাতটির সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির হার ১১ শতাংশ হলেও টেলিকম খাতের রাজস্ব ২০২০ সালের ৬.৩৯ শতাংশ থেকে কমে ২০২৪ সালে ৪.৪০ শতাংশে এসে নেমেছে। গত পাঁচ বছরে এই খাতের রাজস্ব প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এসব সমস্যার অনেকগুলোই এসএমপি নীতিমালা বাস্তবায়নে শিথিলতার কারণে দেখা দিচ্ছে। এসএমপি অপারেটরটি বর্তমানে বাজার হিস্যার ৯০ শতাংশেরও বেশি লাভ করছে। রাজস্ব বাজারের ৫০ শতাংশের মতো বাজার তাদের দখলে; এমনকি, শেয়ারযোগ্য অবকাঠামোর ৫০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করলেও তারা তা শেয়ার করতে অনাগ্রহী। এতে করে এই খাতে কেবল নতুন বিনিয়োগকারীরাই নিরুৎসাহিত হচ্ছে না; বরং বাজারে থাকা পক্ষগুলোও নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে।
বৈঠকে উল্লেখ করা হয়, ২০১৮ সালে এসএমপি গাইডলাইন চালু করলেও এর গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো কার্যকরভাবে পর্যালোচনা বা বাস্তবায়ন করেনি। এসএমপি নীতিমালার ধারা ৭(১১)-তে বার্ষিক পর্যালোচনার নির্দেশনা থাকলেও তা উপেক্ষিত হয়েছে।
বৈঠকে বক্তারা অস্ট্রেলিয়া, ভারত, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো আন্তর্জাতিক উদাহরণ তুলে ধরে দেখান যে, এসএমপি নীতিমালার কঠোর বাস্তবায়ন বাজারের ন্যায্যতা ও গ্রাহকের সুবিধা নিশ্চিত করছে।
গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী এই খাতের অংশীজনদের মাঝে আরও বেশি সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে বলেন, নিয়ন্ত্রক হিসেবে বিটিআরসির নিজের কোনো ক্ষমতা নেই; তাদের সরকারের কাছ থেকে পূর্ব অনুমোদন নিতে হয়। এটি অসম প্রতিযোগিতার পেছনে মূল সমস্যা। বিভিন্ন আইনে ও নীতিমালায় আকস্মিক পরিবর্তন আরেকটি সমস্যা। তবে, এসএমপি প্লেয়ারের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এখন আপনাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। খাত সংশ্লিষ্টদের মাঝে সহযোগিতা বা অংশীদারিত্বের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। টেলিকম খাতের উচিত হবে গ্রাহকদের ক্ষমতায়নে আরও মনোনিবেশ করা। সেবার মান বাড়াতে ব্যবসাকে সমর্থন করা হবে। আসুন আমরা সকলে জাতীয় অগ্রগতির জন্য একসঙ্গে কাজ করি।
প্রতিযোগিতা কমিশনের সাবেক পরিচালক মো. খালেদ আবু নাসের কমিশনকে আরও কার্যকর করার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ১৫ অক্টোবর থেকে প্রতিযোগিতা কমিশন অকার্যকর। এদিকে, বিটিআরসির সঙ্গে কমিশনের তেমন কোনো লিয়াজোঁ নেই। ফলে, অলিগোপলি (একচেটিয়া) বাজার তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় পুরো টেলিকম খাতের পরিবর্তন প্রয়োজন।
ফরেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নির্বাহী পরিচালক ও সিইও টিআইএম নুরুল কবির বলেন, কাউকে রাজনৈতিক সুবিধা না দিয়ে বরং ভাবতে হবে আমাদের একীভূত লাইসেন্স মডেল প্রয়োজন কি না। তবে এই খাতের উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বিটিআরসির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা উচিত। পাশাপাশি আরও বেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য আইন ও নীতিমালার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এমটবের সেক্রেটারি জেনারেল লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মো. জুলফিকার বলেন, টেলিযোগাযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। এই খাতে অনেকেই বিনিয়োগ করেছে। আরও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এই খাতের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে পুরো খাতকে সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতির মধ্য থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
রবির হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স সাহেদুল আলম বলেন, ন্যায্য বাজার প্রতিযোগিতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু বাস্তবতা হলো টেলিকম খাতে সুস্থ প্রতিযোগিতার কোনো পরিবেশ নেই। একটি অপারেটর প্রতি বছর বিপুল মুনাফা অর্জন করছে। এর কারণ হলো টেলিকম বিধিমালা বৃহৎ অপারেটরদের সুবিধা দিচ্ছে, অন্যদিকে ছোট অপারেটরদের প্রবৃদ্ধি ব্যাহত করছে।
বাংলালিংকের হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স তাইমুর রহমান বলেন, ইতোমধ্যে যেসব নিয়মনীতি আছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। অপারেটরদের মধ্যে অবকাঠামো ভাগাভাগি করার প্রক্রিয়া তরান্বিত করতে বিদ্যমান বা নতুন আইনে এ সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতা রাখতে হবে। সামনে যেহেতু এআই এর মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আসছে, আমাদেরকে বাজারে প্রতিযোগিতা কীভাবে আরও বাড়ানো যাবে সে বিষয়ে মনোনিবেশ করতে হবে।
বাংলালিংকের কোম্পানি সেক্রেটারি জহরত আদিব চৌধুরী বলেন, মোবাইল অপারেটররা ডিজিটাল বিভাজন দূর করতে ভূমিকা রাখছে। কিন্তু বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কারণে অপারেটররা আরও বিনিয়োগ করতে পারছে না। এ পরিস্থিতির উন্নয়নে কোনো নির্দিষ্ট অপারেটরকে সুবিধা না দিয়ে খাত-বান্ধব আইন ও নিয়মাবলী, বিশেষ করে সিগনিফিক্যান্ট মার্কেট পাওয়ার (এসএমপি) গাইডলাইনের বাস্তবায়ন করা দরকার।
টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল মাবুদ চৌধুরী বলেন, অসম প্রতিযোগিতার এতটাই খারাপ অবস্থা যে, এইটা নিয়ে বলার পরিস্থিতিই নেই। অসুস্থ প্রতিযোগিতা বিদ্যমান; এই প্রতিযোগিতার মাঝে টেলিটক কষ্ট করে টিকে আছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম বলেন, টেলিযোগাযোগ খাতে সুস্থ প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করতে এবং বিদ্যমান বিনিয়োগ ধরে রাখতে প্রতিযোগিতা আইন নিয়ে কথা বলতে হবে। সিগনিফিক্যান্ট মার্কেট পাওয়ার (এসএমপি) গাইডলাইনে ২০টি ধারা আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন করা হয়েছে মাত্র তিনটি, যা বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠায় তেমন ভূমিকা রাখেনি। বিটিআরসিকে আইনে ক্ষমতা দেওয়া আছে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সেই ক্ষমতার কার্যকর ব্যবহার করা হচ্ছে না।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২৪
এমআইএইচ/এইচএ/