প্রস্তাবিত টেলিযোগাযোগ নীতিমালার মাধ্যমে আইসিএক্স বাতিল করে বিদেশি কোম্পানি এবং মোবাইল অপারেটরদের লাইসেন্স দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত সব পক্ষকেই ক্ষতির মুখে ঠেলে দেবে বলে শঙ্কার কথা জানিয়েছে আইসিএক্স অপারেটরদের সংগঠন- অ্যাসোসিয়েশন অব আইসিএক্স অপারেটস অব বাংলাদেশ।
তারা বলছে, এতে একদিকে সরকার বছরে ৩০০ কোটি টাকার রাজস্ব হারাবে।
বৃহস্পতিবার (২৯ মে) রাজধানীর রাওয়া ক্লাবে টিআরএনবি আয়োজিত ‘টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ও লাইসেন্সিং নীতিমালা: কোন পথে এনটিটিএনের ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক সেমিনারে এমন আশঙ্কার কথা তুলে ধরা হয়।
সেমিনারে জানানো হয়, সম্প্রতি টেলিযোগাযোগ নীতিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এই নীতিমালায় মোবাইল অপারেটরদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা এবং বিদেশি কোম্পানিকে লাইসেন্স দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে আইআইজি, আইসিএক্স এবং এনটিটিএন- সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রস্তাবিত নীতিমালার কারণে ছোট অপারেটর এবং বড় অপারেটরের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আইসিএক্স সরকারের একটি স্থায়ী ও নির্ভরযোগ্য রাজস্ব উৎস জানিয়ে সেমিনারে বলা হয়, আইসিএক্স থেকে গত ১২ বছরে সরকারের রাজস্ব আয় প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক এসএমএস অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে যা আরও বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এখন উন্মুক্ত পথে পরিচালিত হচ্ছে এবং এ কারণে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে আইসিএক্স-এর আয় স্থানান্তরিত হয়ে মোবাইল অপারেটরদের আয়ে যোগ হবে এবং আইসিএক্স তাদের গ্রস রেভিনিউয়ের ৫০ শতাংশ বিটিআরসিকে পরিশোধ করে রেভিনিউ শেয়ার হিসাবে, অথচ মোবাইল অপারেটর পরিশোধ করে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ; কাজেই সরকারি রাজস্ব কমে যাবে।
সেমিনারে বলা হয়, যেখানে অন্যান্য অনেক লাইসেন্স স্তরে সরকারের বিপুল পরিমাণ বকেয়া পাওনা রয়েছে, সেখানে আইসিএক্সের মত কার্যকরী ও নিশ্চিত রাজস্ব উৎসকে বাদ দেওয়া হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এই ধরনের সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের রাজস্ব স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ।
আইসিএক্স লাইসেন্সের ফলে ডেটা সেন্টারসহ ঢাকার বাইরে গড়ে ওঠা অনেক ডেটা সেন্টারের কার্যক্রমের প্রধান সেবাগ্রহীতা আইসিএক্স প্রতিষ্ঠান। আইসিএক্স বন্ধ হলে এসব প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে পড়বে, ফলে বৃহৎ পরিসরে কর্মসংস্থান কমবে। সুতরাং, আইসিএক্স না থাকলে ৫০০-৬০০ জন প্রকৌশলী, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকের ভবিষ্যৎ অবধারিতভাবেই অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
আইসিএক্স বাতিল হলে নিরাপত্তা ঝুঁকিও বৃদ্ধি পাবে জানিয়ে বলা হয়, মনিটরিং কাঠামো দুর্বল হলে অবধারিতভাবে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়বে, বিশেষ করে অবৈধ ভিওআইপি, ক্লোনিং, নম্বর মাস্কিংয়ের মতো অপরাধ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। পাশাপাশি দেশের বাজারে বড় মোবাইল অপারেটরদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়ে গ্রাহক সেবার মান ও খরচ উভয়ই আরও খারাপ হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে।
আইসিএক্সের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশে একটি সাশ্রয়ী, স্মার্ট এবং টেকসই আন্তঃসংযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যার মাধ্যমে সকল অপারেটর উপকৃত হচ্ছে। সুতরাং, এমন একটি সুগঠিত অবকাঠামো না থাকলে কম-বেশি সকল অপারেটর অসুবিধার সম্মুখীন হবে। ছোট অপারেটররা গুরুতর ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
অ্যাসোসিয়েশন অব আইসিএক্স অপারেটস অব বাংলাদেশের সভাপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা প্রযুক্তির মানুষ। আমরা দাবির জন্য রাস্তায় বা শাহবাগে দাঁড়াতে পারি না। আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে দাবি আদায় করতে চাই। আমাদের দাবি দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেলু অ্যাডেড করতে দেন। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা থ্রি জিরো তত্ত্বের কথা বলেছেন, সেখানে কর্মসংস্থানের একটা বিষয় আছে। এই পলিসি বাস্তবায়িত হলে অনেকে চাকরি হারাবেন।
অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ ও জীভন ধারা সল্যুশন্স লিমিটেডের গ্রুপ সিইও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. খুরশীদ আলম বলেন, আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। প্রস্তাবিত পলিসি বাস্তবায়িত হলে ৭০০ লোক চাকরি হারাবে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়ার যে প্রভিশন রাখা হয়েছে। আমার কেন যেন মনে হয়, আমরা আর একটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের পথে।
অগ্নি সিস্টেমস লিমিটেডের হেড অব আইসিএক্স অপারেশন আহমেদ উর রহমান রোমেল বলেন, প্রস্তাবিত নীতিমালা বাস্তবায়নের ফলে আইসিএক্স বন্ধ হলে সরকার বছরে ৩০০ কোটি টাকা রাজস্ব হারাবে। আইসিএক্স অপারেটরের পরিবর্তে মোবাইল অপারেটরদের দিলে ১৬-১৭ কোটি টাকা পাবে। আর আন্তর্জাতিক এসএমএস অন্তর্ভুক্তি না থাকায় বছরে ৮৫ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। আইসিএক্স অপারেটরদের এসএমএস সুবিধা দিলে ৮০-৮৫ কোটি টাকা রাজস্ব দিতে পারবে।
আইসিএক্স অপারেটরগুলো স্মার্ট সার্ভিস দিতে পারছেন না বলে যে অভিযোগ সে বিষয়ে তিনি বলেন, টেলিকম সেক্টরে আমাদের মতো মেধাবী ছেলে নেই। আমাদের ছেলেরা মেধা, দক্ষতা ও জ্ঞানে যে পরিমাণ এগিয়ে এবং আমাদের ইনফ্রাস্ট্রাকচার যতটা এগিয়ে; মোবাইল অপারেটররা তার ধারের কাছেও নেই। মোবাইল অপারেটরদের লোকদের হয়তো ড্রেসআপ এবং অফিস স্মার্ট। কিন্তু আমাদের নিজেদের ছেলেরা কাজ করে। তারা নিজেরা সক্ষমতা অর্জন করেছে।
ভয়েস টেল লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার মুস্তাফা মাহমুদ হোসেন বলেন, আইসিএক্স ১ মিনিটে ১ পয়সা রাজস্ব পায়। এটা দিতে কী সমস্যা? মনে হচ্ছে আমরা বাংলাদেশের লোক বলে আমাদেরকেই বাসা ভাড়া দেবে না! প্রস্তাবিত পলিসিতে মোবাইল অপারেটরদের প্রত্যেক লেয়ারে থাকার সুবিধা রাখা হয়েছে যেমন- সাবমেরিন ক্যাবল, স্যাটেলাইট কার্যক্রমে তারা থাকতে পারবেন। এতে সর্বাধিক গ্রাহক সংখ্যায় এগিয়ে থাকা মোবাইল অপারেটর ছাড়া আর কেউ টিকে থাকতে পারবে না।
আমাদের প্রস্তাবনা
সেমিনারে আইসিএক্স অপারেটরদের পক্ষ থেকে প্রস্তাবনা তুলে ধরে বলা হয়, বাংলাদেশের টেলিকম খাত আজ একটি গুরুতর সন্ধিক্ষণে। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, বাজারের চাহিদা ও বৈশ্বিক প্রবণতা বিবেচনায় নীতিমালা সংস্কার প্রয়োজন হলেও আমাদের দেশের বাস্তবতা অনুযায়ী প্রয়োজন সচেতন, তথ্যনির্ভর ও ধাপে ধাপে সংস্কার-যা নিরাপত্তা, স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।
১. ভয়েস নেটওয়ার্কে বড় পরিবর্তনের আগে পাইলট প্রকল্প ও তথ্যনির্ভর বিশ্লেষণ প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক এসএমএস খাতটিকে পরীক্ষামূলকভাবে সীমিত পরিসরে আইসিএক্স এর কাঠামোবদ্ধ মডেলে চালু করে ফলাফল পর্যালোচনা করা যেতে পারে যা বর্তমানে উন্মুক্ত বা অনিয়ন্ত্রিত।
২. আইসিএক্স লাইসেন্সধারীর সংখ্যা কিছুটা বেশি হলেও কার্যকরী ব্যবস্থাপনা ও সুবিধার জন্য দেশব্যাপী আইসিএক্স কার্যক্রমকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বগুড়া এবং সিলেটের নির্দিষ্ট পয়েন্ট অব ইন্টারকানেকশনে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে। এর ফলে আইসিএক্স নেটওয়ার্কটি বাস্তবিক অর্থেই একটি সমন্বিত ও একক কাঠামোতে বিদ্যমান প্ল্যাটফর্মের রূপ নিয়েছে। এতে করে অপারেটরদের কারিগরি দিক থেকে জটিলতা এমন পর্যায়ে কমেছে যে একটি মাত্র আইসিএক্স থাকলে যেভাবে কাজ করত, কার্যত এখন সেটিই হচ্ছে। তারপরেও, কাজের সুবিধার্থে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনাতে আরো পরিমার্জন কিংবা পরিবর্তন করে কাজ করা যেতে পারে।
৩. এই খাতের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা, দেশের স্বার্থ নিশ্চিত করণ এবং কর্মসংস্থান রক্ষা এখন সময়ের দাবি।
এমআইএইচ/এসএএইচ