ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তথ্যপ্রযুক্তি

অনলাইন সাম্রাজ্যবাদ ও নতুন মহারণের পদধ্বনি!

জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৪
অনলাইন সাম্রাজ্যবাদ ও নতুন মহারণের পদধ্বনি!

এক সময় ছিল অনেক সাম্রাজ্য ও সাম্রাজ্যবাদ; ব্রিটিশ, রুশ, অটোমান,পারস্য, রোমান, গ্রিক, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য সহ আরো কতো না সাম্রাজ্য কায়েম ছিল দুনিয়াজুড়ে! দুনিয়ার উপর শতাব্দির পর শতাব্দি ছড়ি ঘুরিয়েছে এরা। গোটা দুনিয়া ছিল এদের অধীন, পদানত।

সেদিন হয়েছে বাসী। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ ও এনিয়ে লড়াই কি তবে চুকেবুকে গেছে? না, তা হয়নি মোটেও; মাথা চাড়া দিয়েছে অন্য এক সাম্রাজ্যবাদ।

এক ভার্চুয়াল সাম্রাজ্যবাদের কবলে চলে গেছে আজকের গোটা দুনিয়া। আরিস্তোতল যেমনটা বলেছিলেন: “Nature abhors a vacuum.” –প্রকৃতি কোনো শূন্যতা সহ্য করে না। এর মানে, সাম্রাজ্যবাদের অবসান হয়নি আসলে; পুরনো সাম্রাজ্যের জায়গায় আজ চোখ রাঙাচ্ছে নতুন এক সাম্রাজ্যবাদ; টেলিকম, ইন্টারনেট, মিডিয়া-- বিশেষত ইলেকট্রনিক মিডিয়া-- পুরনো সাম্রাজ্যবাদের স্থান দখল করে নিয়েছে ও নিচ্ছে। দিনে দিনে নতুন সেই অনলাইন সাম্রাজ্যের মোগল-পাঠানদের চেহারা-অবয়বও স্পষ্ট হচ্ছে।

শুধু কি তা-ই?  Rediff.com-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী অজিত বালাকৃষ্ণণ (Ajit Balakrishnan) গত ৩০ ডিসেম্বর The Great War, online শিরোনামের এক নিবন্ধে বলেছেন এই নতুন সাম্রাজ্যবাদ ও এর বিরুদ্ধে ক্রমশ ঘনিয়ে আসা নতুন এক অনলাইন মহারণের অশনিসংকেতের কথা।

এই মহারণকে তিনি গত শতাব্দির প্রথম মহাযুদ্ধের সাথে তুলনা করতে ভোলেননি। নিবন্ধের শুরটা তিনি করেছেন এভাবে: It is possible that we will all look back a year from now and say that Airtel's decision to charge a higher tariff for their subscribers who use Skype and Skype-like services was an act like the one that happened exactly a 100 years and six months ago, when a young Serbian nationalist challenged the existing European state system by assassinating the heir to the throne of the Austro-Hungarian empire.’’

বালাকৃষ্ণণের দাবি, তিনি মোটেই বাড়িয়ে বলছেন না। তার মতে, টেলিকম, ইন্টারনেট এবং মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি এমনভাবে সংগঠিত হচ্ছে যার সাথে ১৯১৪ সালে মহাযুদ্ধকালে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর একজোট হওয়ার সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

ওই সময়কার পরাশক্তি বলতে ছিল ব্রিটেন, রাশিয়া ও ফ্রান্স। আর এখন সে-স্থান দখলে নিয়ে নতুন পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে গুগল, ফেসবুক, অ্যামাজন ও মাইক্রোসফট। অতীতে পরাশক্তিগুলো যেমন প্রতিটি দেশকে অধীন ও পদানত করে রেখেছিল, ঠিক তেম্নি এখন সারা দুনিয়াকে শাসন করছে এই অনলাইন জায়ান্টরা। অবশ্য এক্ষেত্রে তিনি চীনকে রেখেছেন ব্যতিক্রমের তালিকায়। মানে চীনের ওপরই কেবল ছড়ি ঘোরাতে পারছে না এরা। .

ফেসবুকের আছে WhatsApp  আর  মাইক্রোসফটের মালিকানায় আছে Skype। এই দুটি অনলাইন সেবাই এখন "net neutrality battle".নামের নতুন এই মহারণের কেন্দ্রবিন্দু ।  

১৯১৪ সালের দিকে প্রতিটি দেশকে যেমন পরাশক্তিগুলোর বশ্যতা স্বীকার করে তাদের গুণকীর্তন করতে হতো, তেম্নি আজকের ইন্টারনেট দুনিয়ায় সবাইকে নানা অনলাইন সেবা পেতে বা দুনিয়ার সাথে সংযুক্ত হতে এই নব মোগলদের ‘ফি’, খাজনা বা নজরানা দিতে হবে অথবা দিতে হবে নানা বিকল্প ‘ফ্রি অ্যাকসেস’।

আর এই নেট মোগলদের আচরণও পুরনো সাম্রাজ্যবাদীদের মতোই। এরা ইন্টারনেট ইকোনমির আয়ের সিংহভাগটাই নিজেদের পকেটে পুরে নিচ্ছে। এদের একচেটিয়া মুনাফাবাজি দিনকে দিন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আর এটা বিশ্বব্যাপী জন্ম দিচ্ছে নতুন ক্রোধের।

এসবের মধ্যে আছে News Corp, Time Warner, Disney and Bertelsmann-এর মতো মিডিয়া কংগ্লোমারেটরা। চাইলে এই তালিকায় বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালী সংবাদপত্র ও টিভি কোম্পানির নামও যুক্ত করতে পারেন আপনি।    

ইন্টারনেট চালু হওয়ার শুরুর দিনগুলোতে Time Warner কিনে নিলো AOL । আর সেটা তারা করেছিল ইন্টারনেটকে ডমিনেট করবার কুমতলবে। আর ওদের সাথে এসে হাত মিলায় দুনিয়ার প্রভাবশালী তাবৎ ম্যাগাজিন ও প্রথম সারির ইন্টারন্টে অ্যাকসেস প্রোভাইডাররা। এরপর একই কুমতলবে News Corp কিনে নেয় MySpace।   বালাকৃষ্ণণের ভাষায়, ইন্টারনেটকে ডমিনেট করার জন্য এদের এহেন উদ্যোগ ছিল "sure-shot" ডিল।  

এরপর আসে টেলিকম অ্যাকসেস প্রোভাইডারদের কথা। এদের নিয়ন্ত্রণ এখন দুনিয়ার প্রতিটি দেশের উপর। কোনো কোনোটির শক্তি ও ক্ষমতা এতোই বিস্তৃত
যে গোটা দুনিয়াই এখন এদের প্রভাবের কব্জায়। পুরনো পরাশক্তির পেতাত্মার উপর দাঁড়িয়ে এরাই এখন নতুন সাম্রাজ্যের ধ্বজা ওড়াচ্ছে।

এদের কেউ কেউ অপারেট করছে ল্যান্ডলাইন-বেজড ভয়েস ও ইন্টারনেট সার্ভিস, কেউবা অপারেট করছে ওয়ারলেস ভার্সন অথবা যুগপৎ দুটোই। কিন্তু এরা Skype and WhatsApp-এর মতো ফ্রি রাইডারদের উপর মহা খাপ্পা। কেননা এরা লোকজনকে নিখরচায় বা প্রায় নিখরচায় কথা বলার, বার্তা আদান-প্রদানের সুযোগ করে দিয়েছে। এজন্য অবকাঠামো খাতে করতে হচ্ছে না কোনো খরচ, দিতে হচ্ছে না কোনো লাইসেন্স ফি। আর তাই মুনাফালোভী টেলিকম কোম্পানিগুলো চাচ্ছে তাতে বাগড়া দিকে। তারা তাদের গ্রাহকদের উপর এসেবের জন্য বিশেষ টোল ধার্য করার পাঁয়তারায় মেতেছে।  

কিন্তু সেটাও তো লোকে এতো সহজে মেনে নেবে না। এ-কারণে যখনই টেলিকম কোম্পানিগুলো নতুন টোল বসাবার পাঁয়তারা করছে তখনই ‘‘নেট-নিরপেক্ষতা’’ লংঘনের অভিযোগে এদের বিরুদ্ধে জোর আওয়াজ উঠছে চারদিক থেকে। নেট নিরপেক্ষতাকে ঘিরে শুরু হওয়া এই যে নতুন যুদ্ধ, একে বলা হচ্ছে  ‘shadow boxing’ বা সরল বাংলায়, ‘ছায়ার সাথে কুস্তি লড়া’।   MIT Technology Review সে ব্যাপারটাই তুলে ধরেছে বিশদরূপে (www.technologyreview.com/news/523736/around-the-world-net-neutrality-is-not-a-reality/).

গুগল ও ফেসবুক আফ্রিকার কেনিয়া থেকে শুরু করে এশিয়ার ফিলিপাইন পর্যন্ত নানাদেশের মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করেছে। এর সুবাদে সারা দুনিয়ার মানুষ এখন ফেসবুক ও জি-মেইলের মতো সেবা নিচ্ছেন নিখরচায়।

স্বাভাবিকভাবেই দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষ এই সুযোগটাকে লুফে নেবে তাতে আর বিচিত্র কি! কেননা এসব দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের দেশে ইন্টারনেট অ্যাকসেস চার্জ মানুষের আয়ের তুলনায় অনেক অনেক বেশি। .

এই লড়াইয়ের বাইরে আছে আরো এক অস্তিত্বের সংগ্রাম। এই সংগ্রামটা সংস্কৃতি জগতের ("cultural industries")--- টিকে থাকার সংগ্রাম এটা। এরা হচ্ছে তারা যারা টেক্সট-এর জন্ম দেয়, গান বাঁধে, চলচ্চিত্র নির্মাণ করে, টিভি চালায়, বই প্রকাশ করে আর বিজ্ঞাপন তৈরির মতো নানা সৃজনশীল কাজ করে।

এদের প্রডাক্টের সুবাদে যে আয়, সেই আয়ের সিংহভাগটাই লুটে নিচ্ছে বিভিন্ন টেলিকম ফার্ম, অ্যাকসেস প্রোভাইডার, ওয়েব প্রেয়ার ও বিভিন্ন সফটওয়্যার কোম্পানি। যার জিনিস তার ঘরে লাভ যাচ্ছে না; তা চলে যাচ্ছে উড়ে-এসে-জুড়ে-বসা ‘নেপোদের’ পকেটে। সোজা বাংলায় যাকে বলে:‘‘নেপোয় মারে দই’’!ফ্রান্সের স্তাঁদাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (Stendhal University) অধ্যাপক Bernand Miege একথা এক দশক আগেই বলেছিলেন যে, এমনটা হচ্ছে এবং হতেই থাকবে। তার কথা ফলতে শুরু করেছে অক্ষরে অক্ষরে।

বার্নার্দ মেইজ তখন বলেছিলেন এসবের কারণে বিপুল সংখ্যক শিল্পী, লেখক, গায়ক, চিত্রকর, ডিজাইনার ও প্রডিউসারের জীবন-জীবিকার উপর বিরূপ প্রভাবের কথা। এইসব সৃজনশীল মানুষের পেটে লাথি পড়বার কথা। এখন সেটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। আর পুরো কালচারাল ইন্ডাস্ট্রিতে জ্বলতে শুরু করেছে লালবাতি।

অ্যাপলই নতুন এই বিরূপ বাস্তবতার জন্মদাতা। মেইজের ভাষায়, অ্যাপল তাদের আইপড মিউজিক প্লেয়ার ও আইটোন সার্ভিসের (iPod music player ও iTunes service) মতো টেকনিক্যাল টুলের সাথে মিউজিক কনটেন্ট ও এ-সংশ্লিষ্ট সার্ভিস জুড়ে দিয়ে কাণ্ডটির সূচনা ঘটায়।  
অ্যাপল, হার্ডওয়্যার ও টেলিকম কোম্পানিগুলো মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির লাভের বড় অংশটাই হাতিয়ে নিচ্ছে অন্যায়ভাবে। অথচ মিউজিক সৃষ্টির পেছনে কোনো ভূমিকাই নেই এদের।   .

এ-প্রসঙ্গে বালাকৃষ্ণণ ১৯১৪ সালে পরাশক্তিগুলোর যুদ্ধংদেহী তৎপরতার নজির টেনেছেন। ১৯১৪-র পূ্র্ববর্তী পুরো একটা , দশকজুড়ে এসব পরাশক্তি ব্যস্ত ছিল নিজেদের মধ্যে মৈত্রীজোট সৃষ্টিতে; এরা যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থেকেছে ইউরোপের বাইরে তৃতীয় বিশ্বে নিজেদের কলোনি-উপনিবেশ ও নিজ মহাদেশ ইউরোপের বিরোধপূর্ণ এলাকার দখল বজায় রাখতে। কে না জানে যে, তখনকার অনেক ইউরোপীয় নেতা ‘‘জোর যার মুল্লুক তার’’ নীতিতে ছিলেন অটল।

বালাকৃষ্ণণ একে বলেছেন ‘‘ সোশাল ডারউইনিজম’’। এই নীতির মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, যোগ্যতমেরাই কেবল টিকে থাকবে। দুর্বল যারা তাদের টিকে থাকার অধিকার নেই। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আজকের বেনিয়াকূলের কর্মকাণ্ডে এই নীতিটাই প্রকট হয়ে উঠেছে। যেনতেপ্রকারেণ অন্যেরটা কেড়ে নাও, অন্যের সম্পদে, অন্যের কীর্তিতে ভাগ বসাও। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, এটা বিনা চালেঞ্জে মেনে নেবে না পৃথিবী। ফলে লড়াই অনিবার্য। যেমনটা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর মধ্য দিয়ে।   

ওই সময়কার অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য (যা গঠিত হয়েছিল আজকের দিনের অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র ও যুগোস্লাভিয়ার অংশবিশেষ নিয়ে) ও অটোমান সাম্রাজ্য (যা যা গঠিত হয়েছিল আজকের দিনের সার্বিয়া, বসনিয়া, রোমানিয়া, গ্রিস, উক্রাইন, ইরাক, সিরিয়া, ইসরায়েল মিশর ও আলজেরিয়া নিয়ে) স্বাধীনতাকামী উদীয়মান  জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলোর সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছিল।

প্রথম মহাযুদ্ধের পর এই দুই সাম্রাজ্যের চির অবসান ঘটে এবং শাসিত-পদানত দেশগুলো স্বাধীন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। এভাবেই প্রথম মহাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ফয়সালা ঘটে সাম্রাজ্যবাদের ঘৃণ্য অপশাসনের।

.ইন্টারনেট নিরপেক্ষতার জন্য ক্রমশ জমে ওঠা লড়াইও কি ইন্টারনেট বিশ্ব-ব্যবস্থায় তেমনই কোনো চূড়ান্ত ফয়সালার সূচনা করবে? অবসান ঘটাবে মুনাফাখোর মুষ্ঠিমেয়ের নেপোগিরির? অজিত বালাকৃষ্ণণের মতো এই প্রশ্নটা এখন আমাদের সবারই।

বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।