বর্তমানে আমরা যেসব যন্ত্র বা ডিভাইস ব্যবহার করি তা আমাদের বিভিন্ন রকম তথ্য দিয়ে জীবনকে করে তুলেছে আরও সহজ এবং আধুনিক। এমন যদি হতো যে এই ডিভাইসগুলো শুধু আমাদের অর্থাৎ মানুষের কাছেই নয়, তাদের নিজেদের মাঝেও তথ্য আদান-প্রদান করে প্রয়োজনে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করতে পারত? তাহলে দুনিয়া অবশ্যই আরো মজার হতো, তবে এমন কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বুদ্ধির প্রয়োজন যা যন্ত্রের কাছে নেই।
নাকি তাদেরও বুদ্ধি আছে?
আজকের দুনিয়া যেন স্মার্ট ডিভাইসের জাদুতে মুগ্ধ হয়ে আছে। সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে আমাদের স্মার্টফোন। ইমার্কেটারের তথ্যসূত্র অনুযায়ী, গোটা দুনিয়াতে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের সংখ্যা ইতোমধ্যেই ২ বিলিয়ন পার করে ফেলেছে। যদি আমরা ধরে নেই যে এদের মাঝে সকলেই ইন্টারনেট ব্যবহারকারী, তাহলে শুধু স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের মাধ্যমেই বিপুল পরিমাণ তথ্য বা ডাটা আদান প্রদান হচ্ছে।
এই বিপুল পরিমাণ ডাটা আমাদের চারপাশেই উড়ে বেড়াচ্ছে। স্মার্টফোন বা আমাদের কম্পিউটার ছাড়াও আরো অনেক কিছুই ইন্টারনেটে সংযুক্ত হতে পারে। এ সকল ডিভাইস বা ‘বস্তু’ ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিপুল তথ্য আদান-প্রদান করে থাকে। কিন্তু এই ‘স্মার্ট ডিভাইস’ অর্থ কি? কেন সবাই ইদানিং এটা নিয়ে এতো আলোচনা করছে? কেন একে আমাদের ভবিষ্যৎ বলে ধারণা করা হচ্ছে? কেনইবা বিভিন্ন দেশের সরকার আর মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি এই সেক্টরে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে? এ সকল প্রশ্নের উত্তর জানার আগে আসুন আমরা ‘স্মার্ট’ একটি জগত সম্পর্কে জেনে নেই। এমন একটি জগত, যেখানে বস্তুরও ‘অনুভূতি’ রয়েছে!
আসুন আমাদের স্মার্ট দুনিয়ার ইন্টারনেট সম্পর্কে আগে জেনে নেই। ১৯৯৩ সালে প্রথম জনপ্রিয় ওয়েব ব্রাউজার হিসাবে ‘মোজাইক’ এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর থেকে ইন্টারনেটে বিচরণ করা সাধারণ মানুষের জন্য অনেক সহজ হতে থাকে। খুব দ্রুত সময়েই মানুষ ইন্টারনেটকে বিপুল পরিমাণ তথ্যের ভান্ডারে পরিণত করে। আজকে আমাদের অনেকগুলো জনপ্রিয় ব্রাউজার রয়েছে এবং আরো একটি জিনিস রয়েছে যাকে আমরা বলি ‘ক্লাউড’। ক্লাউড হলো বিশাল এক ‘ডাটা সেন্টার’ যেখানে আমরা আমাদের তথ্য বা ডাটা জমা রাখতে পারি এবং Shared Resource এর সাথে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ডাটা নিতে পারি। এই ক্লাউড সিস্টেম আমাদের যোগাযোগ ক্ষেত্রে এক নাটকীয় পরিবর্তন আনতে পেরেছে। ক্লাউডের ফলে আমরা আগের তুলনায় অনেক কম সময়ে আমাদের প্রয়োজনীয় ডাটা পেতে পারি।
শুধু তাই নয়, আমরা অনেক বেশি ডাটা জমাও রাখতে পারি এই ক্লাউডের মাধ্যমেই। এই ‘ক্লাউড’ আমাদেরকে কতটা সাহায্য করছে তা বোঝার উপায় হলো আমরা কি পরিমানে ক্লাউড ব্যবহার করছি তা জানা। আমরা যত বেশি ক্লাউড ব্যবহার করবো, এর পরিমান বা ‘সাইজ’ও ততো বাড়তে থাকবে। ডাটার সাইজ পরিমাপ করার একক হলো বাইট।
ডক্টর জন ব্যারেটের মতে, বর্তমানে ক্লাউডের সাইজ হলো প্রায় ৪০০০ এক্সাবাইট (যেখানে ১ এক্সাবাইট = ১০১৮ বাইট)। আমরা এক্সাবাইটের সাথে পরিচিত নই, তাই শব্দটি শুনলে আমাদের মনে বিশেষ কোন প্রভাব ফেলে না। তাই এক্সাবাইট আসলে কত বড় তা অনুধাবন করার চেষ্টা করি।
TEDxCITএ দেওয়া এক বক্তৃতায় ডক্টর জন ব্যারেট বলেন, আমরা যদি ৪০০০ এক্সাবাইট সংখ্যক বই নিয়ে তা একটার উপর আরেকটা রেখে সাজাই, তাহলে সেই বইয়ের সারি পৃথিবী থেকে প্লুটো গ্রহে যেয়ে আবার সেখান থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারে মোট ৮০ বার! নিঃসন্দেহে এই সংখ্যা এতো বড় যে তা আমাদের কল্পনার বাইরে!
চিত্র ১ –IoT এর ক্লাউড সিস্টেম– ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত হতে পারে যে কোনো কিছুই। কম্পিউটার থেকে শুরু করে আমাদের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এমনকি গাছপালার মত প্রাকৃতিক জিনিসও!
ব্রাউজার এবং সোশাল মিডিয়া যেমন ফেসবুক বা টুইটার মানুষের মাঝে বন্ধন সৃষ্টি করতে পারে। তবে আমরা সাধারণত এসব নিজেদের যোগাযোগের জন্যই ব্যবহার করি। কেমন হতো যদি ইন্টারনেটের মাধ্যমে দুটি বস্তু বা ডিভাইস একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারত? এক্ষেত্রে প্রথমেই প্রশ্ন আসে যে দুটি বস্তু নিজেদের মাঝে তথ্য আদান-প্রদান করলে লাভ কি? যদি বস্তুদের মাঝে যোগাযোগের মাধ্যমে আমাদের জীবন যাপন সহজ হয়ে যায় বা আমাদের পরিশ্রম কমে যায় তাহলেই আমরা এ থেকে লাভ পাবো।
আধুনিক প্রযুক্তিবলে সহজেই একটি বস্তু অপর একটি বস্তুর সাথে যোগাযোগ করে নিজের বর্তমান অবস্থা জানান দিতে পারে। স্মার্ট সেন্সর ও ইন্টারনেট এবং আরো অনেক মাধ্যমে সহজেই ডিভাইস দ্রুত তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে। এসব ডিভাইসের মাধ্যমে কিভাবে আমাদের জীবন আরো সহজ হয়ে উঠতে পারে তা বোঝার জন্য আমরা কয়েকটি উদাহরন কল্পনা করতে পারি – যেমন ইন্টারনেট অব থিংসের মাধ্যমে সকালে ঘুম থেকে ওঠা, স্মার্ট ক্লাসরুম এবং স্মার্ট বর্ডার সিস্টেম।
সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠা – ইন্টারনেট অব থিংসের সহায়তায়
ধরে নেই যে আমাদের হাতে এক ধরনের ‘স্মার্ট ব্রেসলেট’ রয়েছে যা আমাদের শরীরের রক্তচাপ, হার্টবিটসহ বিভিন্ন জিনিস সারাক্ষণ পর্যবেক্ষণ করছে। এই ব্রেসলেট তার পর্যবেক্ষণ গুণের জন্য ‘স্মার্ট’ নয় বরং সে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘরের অন্যান্য জিনিষের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে তাই একে স্মার্ট বলা হবে। কল্পনা করি যে আমরা এই ব্রেসলেট পরে রাতের বেলা ঘুমাতে গেলাম এবং বিছানার পাশে অ্যালার্ম ঘড়িতে ভোর ৬টায় অ্যালার্ম দিলাম। যেহেতু আমাদের কল্পনার এই দুনিয়া IoTএর দুনিয়া তাই আমাদের অন্যান্য ডিভাইস যেমন অ্যালার্ম ঘড়ি, লাইট, ফ্যান বা গ্যাসের চুলার সুইচও একে অপরের সাথে প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারবে।
ভোর ৬টায় যখন অ্যালার্ম বেজে ওঠার সময় হবে তখন অ্যালার্ম ঘড়ি বিকট শব্দ না করে শুধু আমাদের হাতের ব্রেসলেটকে একটা সিগন্যাল দিবে। সেই সিগন্যাল পাওয়ার সাথে সাথেই ব্রেসলেট মৃদুভাবে ভাইব্রেট বা কম্পন করে আমাদের হাতকে নাড়াবে যার ফলে আমাদের সকালের ঘুম সঠিক সময়ে ভেঙ্গে যাবে। যাক অন্তত অ্যালার্মের তীক্ষ্ণ শব্দ থেকে তো বাঁচা গেল! তারপর যখন আমরা অপর হাত দিয়ে ব্রেসলেটের ভাইব্রেশন বন্ধ করার জন্য তার সুইচ চাপবো তখন ব্রেসলেট নিশ্চিত হবে যে আমরা ঘুম থেকে জেগে উঠেছি। সেই সময় ব্রেসলেট সিগন্যাল পাঠাবে ঘরের লাইটিং সিস্টেমে যা সেই সিগন্যাল পেয়ে আমার শোবার ঘরের বাতি আপনা থেকেই জ্বালিয়ে দেবে! শুনতে সাইন্স ফিকশন বলে মনে হলেও IoTএর মাধ্যমে এটি খুবই বাস্তব।
স্মার্ট ক্লাসরুম
আমাদের সকলের পরিচিত স্কুলের ক্লাসরুম নিয়েই চিন্তা করি। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে আমেরিকার স্কুলে প্রতি ৫ মিনিটের মাঝে ১ মিনিট নস্ট হয় পড়ালেখার বাইরের বিভিন্ন কাজে। এই কাজগুলোর মাঝে পড়ে রোল ডাকা, কাগজ আদান-প্রদান করাসহ অন্যান্য ব্যাপার। আরো একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ক্লাসের তাপমাত্রা, আদ্রতা, শিক্ষকের গলার স্বরের তারতম্যনা ঘটা – এইসব জিনিসও শিক্ষার্থীদের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। ইন্টারনেট অব থিংস কিভাবে এর সমাধান দিতে পারে তার একটি উদাহরণ এমন হতে পারে- ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসের সিটে বসার সাথে সাথেই তাদের উপস্থিতি চলে যাবে কম্পিউটারে! এটি করা যেতে পারে Nymi এর মত হাতে পড়ার উপযোগী ‘স্মার্টব্যান্ড’ এর মাধ্যমে।
এই স্মার্টব্যান্ড ECG pattern এর মাধ্যমে কোন ব্যক্তি এটি পড়ে আছে তা জানান দিতে সক্ষম। শিক্ষার্থীরা সিটে বসলেই এটি সিগন্যাল পাঠিয়ে দেবে, যার ফলে সেই শিক্ষার্থীর উপস্থিতি আপনা থেকেই হয়ে যাবে। EEG টেকনোলজি ব্যবহার করা নিউরো সেন্সরের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মনিটর করা হবে, ফলে শিক্ষক সেন্সরের রেজাল্ট দেখেই বুঝতে পারবে কোন শিক্ষার্থী তার মাথা বেশি খাটাচ্ছে। এর ফলে শিক্ষক সহজেই বুঝতে পারবেন যে কোন শিক্ষার্থীর পড়া বুঝতে কষ্ট হচ্ছে, ফলে তিনি সেসব শিক্ষার্থীদেরকে বেশি সময় দিতে পারবেন।
অনেক দুর্বল শিক্ষার্থী সবার সামনে নিজের প্রশ্নটা বলতে পারে না, তাই তাদের জন্য এই প্রযুক্তি খুবই উপকারী। শিক্ষার্থীদের মনোযোগ নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন শিক্ষক? ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে কথা বলছে? সবার সামনে তাদেরকে ধমক না দিয়ে তাদের হাতে পরা ব্যান্ড বা সামনে থাকা ট্যাবলেটে ‘হ্যাপটিক’ ভাইব্রেশন পাঠাতে পারবেন শিক্ষক – যা অনেকটা আমাদের মোবাইলে নোটিফিকেশন আসার মত মৃদু। ইন্টারনেটের মাধ্যমে একে অপরের সাথে সংযুক্ত ডিভাইসের যথাযথ ব্যবহার করে আমরা আমাদের ক্লাসরুমের অনেক কাজ সহজ করে ফেলতে পারি।
স্মার্ট বর্ডার
দেশের সীমান্ত রক্ষার ভবিষ্যৎ দৃশ্য বললে আমরা অনেকেই কল্পনা করবো আধুনিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত দক্ষ সীমান্তপ্রহরী। নজরদারির জন্য উন্নত ক্যামেরা ব্যবহার করা। এই ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখে প্রহরীরা সতর্ক হতে পারবে। কিন্তু পর্যবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত এই ক্যামেরা যদি অন্য কোন ডিভাইসের কাছে তার তথ্য পাঠাতে পারতো তাহলে দৃশ্যটা কেমন হতো? দৃশ্যটা এমন হতে পারতো যে ক্যামেরা অবৈধভাবে সীমান্তের বেড়া টপকে কেউ আসতে গেলেই তা বুঝতে পারবে এবং অ্যালার্মেরকাছে সিগন্যাল পাঠাবে।
যার ফলে অ্যালার্ম বেজে উঠবে এবং প্রহরীরা সতর্ক হয়ে উঠবে। একে চাইলে আরো উন্নত করা যায়। বর্ডার অতিক্রম করলেই ক্যামেরা আর সেন্সরের মাধ্যমে অনুপ্রবেশকারীর অবস্থান বুঝে সেই তথ্য অনুযায়ী অন্যান্য ডিভাইসের মাধ্যমে সেই লোককে আটক করা যেতে পারে, এমনকি প্রয়োজনে বন্দুকের মাধ্যমে গুলি করেও তার চলার পথ বন্ধ করা যেতে পারে!
এই সবকিছুই ঘটবে মানুষের কোন প্রকার নির্দেশ ছাড়াই – যার ফলে সীমান্তের নিরাপত্তা আরো জোরদার হবে। ডিভাইসগুলো নিজেদের মাঝে কথা বলার জন্য চাই একটি মাধ্যম। সেই মাধ্যমটি হলো ইন্টারনেট। এই ডিভাইসগুলো ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত থাকলেই তারা নিজেদের তথ্য একে অপরের সাথে আদান-প্রদান করতে পারবে, যার ফলে খুঁটিনাটি বিষয়ে মানুষের সার্বক্ষণিক নজরদারির প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে এবং আমরা অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বেশি সময় দিতে পারব। ইন্টারনেটের মাধ্যমে ডিভাইস বা যন্ত্রদের এমন যোগাযোগের ব্যাপারকে বলা হয় “ইন্টারনেট অব থিংস” বা বস্তুদের ইন্টারনেট।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত উপরে উল্লেখিত পদ্ধতিতে তাদের বর্ডার সিস্টেমকে ‘স্মার্ট বর্ডার’ বানানোর ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে। আমাদের দেশের সীমান্তের বেশিরভাগ অংশ ভারতের সাথে সংযুক্ত, তাই এই ব্যাপারে আমাদের আরো বেশি জানার প্রয়োজন আছে।
IoTবা Internet of Things বলতে বোঝায় বিভিন্ন বস্তু বা ‘Things’ এর মাঝে যোগাযোগ ঘটা অর্থাৎ Internetworking হওয়া। এখানে Things বলতে আমরা কল্পনা করতে পারি এমন যে কোন বস্তুকে বোঝানো হচ্ছে – ঘরের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে এমনকি বাগানের গাছের চারা পর্যন্ত। IoTকে বলা হয় information society এর পরিকাঠামো। উপরে উল্লেখ করা উদাহরণ থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, IoTএর মাধ্যমে আমরা দূর থেকেও বিভিন্ন বস্তুকে ‘অনুভব’ করতে পারি এবং বর্তমানে উপস্থিত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতেও সক্ষম। আমাদের দেশের ডিজিটালাইজেশনের পরবর্তী ধাপ নিঃসন্দেহে IoTএবং এর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আধুনিক বা Smart City.
Internet of Things এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
IoT কে বিজ্ঞানের নতুন চমক বলে ধারণা করেন অনেকেই, যদিও এই ধারনাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। IoT এর স্বপ্ন ও ধারণা বহু বছর ধরেই বিজ্ঞানীদের মাঝে ছিল। তবে এটা সত্যি যে IoT এর প্রতি সাধারন মানুষের আগ্রহ এবং কৌতূহল গত কয়েক বছরেই খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধির অন্যতম প্রমান হলো Google Trend. জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন গুগলে কোন সালে মানুষ কোন জিনিস নিয়ে বেশি সার্চ করেছে তা আমরা জানতে পারি গুগল ট্রেন্ডের মাধ্যমে। গত কয়েক বছরে Internet of Things নিয়ে মানুষের সার্চের পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে তা আমরা গুগল ট্রেন্ডের এই গ্রাফ দেখলে বুঝতে পারি।
চিত্র ২ - Internet of Things কি-ওয়ার্ডের এর গুগল ট্রেন্ড, ২০০৪ থেকে ২০১৭ এর জানুয়ারি(আংশিক)পর্যন্ত
১৯৮৫ সালে “Internet of Things” শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন পিটার লুইস। তবে বিভিন্ন বস্তু বা ডিভাইসের নেটওয়ার্কের ধারণাটি আরো পুরনো। ১৮৪৪ সালে যখন স্যামুয়েল মোর্স যখন টেলিগ্রাফ আবিষ্কার করে প্রথমবারের মত মোর্স কোড পাবলিক টেলিগ্রাফ ওয়াশিংটন ডিসি থেকে বাল্টিমোরে পাঠাতে সক্ষম হন, বিজ্ঞানীরা এমন এক দুনিয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন যেখানে দূরত্ব কোন সমস্যা নয়। এমন এক নেটওয়ার্কের লক্ষে অনেকেই কাজ করে গেলেও সফলতার মুখ দেখা কঠিন হচ্ছিল। ১৯২৬ সালে ইতিহাসের অন্যতম সেরা আবিষ্কারক নিকোলাস টেসলা কোলাইডার ম্যাগাজিনে দেওয়া এক সাক্ষাতকারেওএমন নেটওয়ার্কের স্বপ্নের কথা উল্লেখ করেন –
When wireless is perfectly applied the whole earth will be converted into a huge brain, which in fact it is, all things being particles of a real and rhythmic whole.........and the instruments through which we shall be able to do this will be amazingly simple compared with our present telephone. A man will be able to carry one in his vest pocket.
বঙ্গানুবাদঃ যখন ‘ওয়্যারলেস’ বা তারবিহীন প্রযুক্তি যথাযথভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে, তখন গোটা বিশ্ব এক বিশাল তথ্যভাণ্ডারে পরিণত হবে, আসলে দুনিয়াটা এমন, যেখানে সকল বস্তুই বাস্তব এবং ছন্দময় বৃহৎজিনিসের একটি ক্ষুদ্র অংশ…এই ক্ষেত্রে ব্যবহৃত যন্ত্রগুলো জটিল কাজ করতে সক্ষম যদিও এগুলো আমাদের বর্তমান টেলিফোনের তুলনায় খুবই সাধারন ও সহজে ব্যবহার করার মত হবে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে একজন মানুষ অপরজনকে তার পকেটে ধারণ করতে পারবে।
টেসলা আমাদের ইন্টারনেটের কথাই বলছিলেন, যা আমরা আজকে উপভোগ করছি। স্মার্ট ডিভাইসের নেটওয়ার্ক নিয়ে ১৯৮২ সালের দিকে আলোচনা এবং কাজ শুরু হয়। সেই সময়েই Carnegie Mellon University এর একটি ডিভাইস ইন্টারনেটে সংযুক্ত হওয়া প্রথম ডিভাইস হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো সেই ডিভাইসটি ছিল একটি সাধারন কোক মেশিন! এটি ইন্টারনেটে সংযুক্ত হয়ে কি করতে পারতো? এটি নিজেই নিজের সকল কোকের তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করতে পারত আর এতে দেওয়া নতুন কোকগুলো ঠাণ্ডা হয়েছে কিনা এই তথ্য ইনভেন্টোরিতে পাঠাতে পারত।
১৯৮৯ সালে টিম বার্নারস-লী World Wide Web (WWW) সিস্টেমের প্রস্তাব দেন। ধীরে ধীরে সর্বসাধারণের জন্য ইন্টারনেট উন্মুক্ত হওয়ার পথ খুলতে থাকে। ১৯৯১ সালে প্রথম ওয়েব পেজ খুলেন টিম বার্নারস-লী। যুক্তরাষ্ট্রের Xerox PARC এর এক শীর্ষ বিজ্ঞানী মার্ক ওয়েইজার ১৯৯১ সালে ‘The Computer of the 21st Century’ শীর্ষক এক সেমিনার পেপার প্রকাশ করেন যেখানে তিনি IoTএর লক্ষ্য এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেন। এছাড়াও সেই সময় UbiComp এবং PerCom এর মত অ্যাকাডেমিক ভ্যেনুগুলো IoT নিয়ে এবং এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা শুরু করে। ওয়েইজার তার পেপারে উল্লেখ করেন –
The most profound technologies are those that disappear. They weave themselves into the fabric of everyday life until they are indistinguishable from it.
বঙ্গানুবাদঃ সর্বোৎকৃষ্ট প্রযুক্তি সেটাই যা অদৃশ্য। এরা নিজেদেরকে দৈনন্দিন জীবনের সাথে জালের মত মিশিয়ে নিতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা প্রকৃতির সাথে সম্পূর্ণ সদৃশ হয়।
১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৬ সালের দিকে মাইক্রোসফট এবং নোভেলোর মত কোম্পানিগুলো বাস্তব জীবনে IoT নিয়ে আসার উদ্যোগ নেয়। মাইক্রোসফট বের করে তাদের ‘At Work’ যা মূলত অফিসের বিভিন্ন ডিভাইস যেমন ফটোকপি এবং ফ্যাক্স মেশিনের মাঝে যোগাযোগ সৃষ্টি করে। অপরদিকে নোভেলোও তৈরি করে Novell Embedded Systems Technology (NEST) যা ১৯৯৬ সালে বাজারে আসে।
১৯৯৫ সালের দিকেই অ্যামাজন এবং ইবেয় এর মত কমার্শিয়াল সাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট বাণিজ্যিক গুরুত্বও লাভ করতে শুরু করে। অবশেষে ১৯৯৯ সালে IoT গতি পেতে শুরু করে যখন বিল জয় তার ‘সিক্স ওয়েব’ ফ্রেমওয়ার্কের অংশ হিসাবে ‘ডিভাইস টু ডিভাইস’ (D2D) যোগাযোগের মডেল উপস্থাপন করেন সেই বছর ডেভসে অনুষ্ঠিত World Economic Forum এ। এই সময় Auto-ID Center এর মত বিভিন্ন প্রকাশনী Internet of Things এর ধারণাকে সাধারণ মানুষের মাঝে জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষে এগিয়ে আসে।
Auto-ID Center এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কেভিন অ্যাশটন বিশ্বাস করতেন যে রেডিও-ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন(RFID) বস্তুদের ইন্টারনেটে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। বর্তমানে RFID আসলেই গুরুত্বের সাথে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়াও অ্যাশটন বিশ্বাস করতেন যে, বস্তুদের নেটওয়ার্কের নাম হওয়া উচিত ‘Internet for Things’। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সকল বস্তু এবং মানুষের যদি এই আইডেন্টিফাইয়ার থাকে তবে তাদেরকে সহজেই কম্পিউটার দ্বারা পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। বস্তুদের আইডেন্টিফিকেশন অন্যান্য টেকনোলজির মাধ্যমেও করা যায় যেমন near field communication, barcodes, QR codes এবং digital watermarking।
লেখক: প্রফেসর ড. সাজ্জাদ হোসেন, বিভাগীয় প্রধান, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ। সহযোগিতায়: মোঃ শাকিফ ফেরদৌস ও খায়রুন নাহার
বংলাদেশ সময়: ২০৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৭
জেডএম/