ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তথ্যপ্রযুক্তি

আধুনিক উন্নত বিশ্বে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৭
আধুনিক উন্নত বিশ্বে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা চিত্র: ১

২০১৪ সালের এপ্রিলে বিজনেস ম্যাগাজিন McKinsey Quarterly এর প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগামী দশ বছরে গোটা বিশ্বে তথ্য (ডাটা) এবং অর্থের আদান-প্রদান তিন গুণ বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে। বিশ্বে এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রধান কারণ হচ্ছে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি। আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যেখানে তথ্য, সেবা এবং ব্যবসার মত জিনিসগুলো মানুষের হাতের মুঠোর মাঝে চলে আসছে।

২০ বছর আগেও পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাঝে ৩% এর চেয়েও কম সংখ্যক মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ১% এর চেয়েও কম। বর্তমানে গোটা বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ জনসমষ্টির কাছে মোবাইল ফোন সেবা পৌঁছে গেছে এবং এক-তৃতীয়াংশ জনসমষ্টি ইন্টারনেট ব্যবহার করছে।

বাংলাদেশেও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই।

২০০৪ সালে যেখানে দেশের মাত্র ৪% মানুষের কাছে মোবাইল ফোন ছিল, বর্তমানে সে সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৮৭% এ দাঁড়িয়েছে। এক দশক আগে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিশ লাখের চেয়ে কিছুটা বেশি ছিল, যা বর্তমানে সাড়ে সাত কোটির ঊর্ধ্বে। দি ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুকের তথ্য অনুযায়ী, মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ ১০ম স্থানে রয়েছে।

তথ্যপ্রযুক্তির এই বিস্ময়কর বিপ্লবের সাথে তাল মিলিয়ে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে হলে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জনের বিকল্প নেই। সেই লক্ষ্যে সরকারের “ভিশন ২০২১” এর অন্যতম প্রধান অংশ “ডিজিটাল বাংলাদেশ” যার মূল লক্ষ্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষা করার পাশাপাশি মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিয়ে জীবনধারার মান উন্নত করা। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার মাধ্যমেই দেশের মানুষের কাছে আধুনিক প্রযুক্তি এবং সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে।

খুব দ্রুত যেসকল প্রযুক্তি ভবিষ্যতের পৃথিবীর দৃশ্যপট পাল্টে দিতে সক্ষম তাদের মাঝে অন্যতম হলো ইন্টারনেট অব থিংস। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে “অদৃশ্যভাবে” আমাদের আশপাশের যে কোনো বস্তুর সাথে ইন্টারনেটের সহায়তায় যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়। পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলো ইন্টারনেট অব থিংস (IoT) কে আপন করে নিচ্ছে। গার্টনারের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ সালের মাঝেই গোটা পৃথিবীতে ২৫ বিলিয়নের বেশি ইন্টারনেট কানেক্টেড ডিভাইস থাকবে। ইন্টারনেট অব থিংসের সহায়তায় আমাদের মত ঘনবসতিপূর্ণ দেশের ক্রমবর্ধমান খাদ্যচাহিদা থেকে শুরু করে ট্রাফিক জ্যাম কিংবা বিদ্যুতের অপচয় রোধসহ নানারকমের সমস্যার বাস্তবমুখী সমাধান বের করা সম্ভব। ইন্টারনেট অব থিংসের মত প্রযুক্তি ব্যবহার করা সহজ হলেও তৈরি করার জন্য প্রয়োজন প্রযুক্তিতে দক্ষ মানবসম্পদ। জীবনের প্রায় সকল ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রবেশ ঘটলেও এই সেক্টরে বিশাল এক জনসমষ্টির দক্ষতা নেই। এমনকি উন্নত দেশগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়।

২০১৬ সালে প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী OECD (The Organisation for Economic Co-operation and Development) এর সদস্য দেশসমূহে প্রাপ্তবয়স্কদের (১৬ থেকে ৬৫ বছর) মাঝে ৫৬% মানুষের আইসিটিতে দক্ষতা নেই অথবা খুব সামান্য দক্ষতা রয়েছে। রিপোর্টে তিনটি ধাপ বা লেভেলের উপর ভিত্তি করে ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে – প্রথম লেভেলে অবস্থিত জনসমষ্টি আইসিটিতে অদক্ষ অথবা সামান্য দক্ষ এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় লেভেলে তাদেরকে রাখা হয়েছে যারা আইসিটিতে যথেষ্ট দক্ষ (যেমন- কম্পিউটারের বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন দক্ষতার সাথে ব্যবহার করতে পারেন, প্রোগ্রামিং পারেন ইত্যাদি)। রিপোর্টের ফলাফল অনুযায়ী OECD এর সদস্য দেশসমূহে প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ বা তারও বেশি মানুষ আইসিটি এবং ডিজিটাল টেকনোলজিতে খুব বেশি দক্ষ নন অর্থাৎ তারা প্রথম লেভেলে রয়েছেন। অথচ বর্তমান চাকরিক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে দক্ষ কর্মীরা ভাল অবস্থানে রয়েছেন। প্রথম লেভেলে অবস্থিত কর্মীদের তুলনায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় লেভেলে অবস্থিত কর্মীরা ২৭% বেশি বেতন পাচ্ছেন।

শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে বেশিরভাগ কাজের জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তিতে দক্ষতার প্রয়োজন পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই দ্বিতীয় এবং তৃতীয় লেভেলে অবস্থিত জনসংখ্যার বেশিরভাগই ২৫ থেকে ৩৫ বছরের মাঝে অবস্থিত।

আমাদের দেশের চিত্রপট এর থেকে খুব বেশি ভিন্ন নয়। ডিজিটালাইজেশনের ফলে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলাটা এখন আবশ্যকীয়তায় পরিণত হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ করতে হলে দেশের তরুণ প্রজন্মকে নিঃসন্দেহে প্রযুক্তিতে দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করতে হবে।
ডিজিটাল প্রযুক্তির দিক দিয়ে বাংলাদেশ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। BASIS (Bangladesh Association of Software and Information Services) এর ২০১৭ সালের রিপোর্ট থেকে সফটওয়্যার এবং সেবা (ITES) রপ্তানিতে দেশ কতদূর এগিয়ে গেছে তার ধারণা পাওয়া যায়। ২০১৮ সালের মধ্যে সফটওয়্যার রপ্তানি করে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে মোট ১ বিলিয়ন ডলার উপার্জন করার লক্ষ্যে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলছে। বেসিসের ৯৫৬ আইটি মেম্বার কোম্পানির মাঝে ৩৮২ টি কোম্পানি তাদের সফটওয়্যার রপ্তানির তথ্য প্রদান করেছে এবং তাদের মোট রপ্তানি প্রায় ৫৯৪ মিলিয়ন ডলার। এছাড়া দেশে প্রায় ১০০০ আইটি কোম্পানি রয়েছে যারা বেসিসের মেম্বার নয়। সেই সকল কোম্পানির সফটওয়্যার এবং সেবা রপ্তানিসহ বিভিন্ন কাজে মোট আয় হয়েছে আনুমানিকভাবে ৩ বিলিয়ন ডলার!

তবে এদের মাঝে সকল কোম্পানি IT এবং ITES রপ্তানির সাথে সংযুক্ত নয়। যদি ধরে নেওয়া হয় যে এদের মাঝে ২৫% কোম্পানি সফটওয়্যার ও সেবা রপ্তানির সাথে সংযুক্ত, তাহলে সফটওয়্যার রপ্তানি থেকে মোট আয় দাঁড়ায় প্রায় ৭৬১ মিলিয়ন ডলারে! ২০১৬ সালের ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, বাংলাদেশ আইসিটি ক্ষেত্রে রপ্তানি করে ৭০০ মিলিয়ন ডলার উপার্জন করছে।
দেশে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে দক্ষ তরুণ তৈরি হচ্ছে যারা এদেশের প্রযুক্তিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে। বিশেষ করে ইন্টারনেট অব থিংস এবং বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ফলে বাংলাদেশ ডিজিটাল টেকনোলজির নবযুগে প্রবেশ করতে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১৫ সালে স্যাটেলাইট তৈরির কাজের টেন্ডার ছাড়ে ।

বিটিআরসি এবং ফ্রেঞ্চ কোম্পানি থালেস অ্যালেনিয়ার সাথে ২৪৮ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি সাক্ষর করা হয়।

আশা করা হচ্ছে, এই বছরের মাঝেই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কাজ শেষ করবে থালেস অ্যালেনিয়া। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নামে দেশের প্রথম স্যাটেলাইটের নামকরণ করা হয় বঙ্গবন্ধু -১। ১৯৭৫ সালে রাঙ্গামাটিতে দেশের প্রথম আর্থ স্টেশন বেতবুনিয়া উপগ্রহ ভূকেন্দ্রের উদ্বোধন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তার সেই দূরদর্শিতার ফলেই দেশের প্রথম নিজস্ব স্যাটেলাইটের কাজে এগিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ। চুক্তি সাক্ষরের অনুষ্ঠানে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী তারানা হালিম জানান, ২০১৭ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দেশের মহান বিজয় দিবসে বঙ্গবন্ধু -১ উৎক্ষেপণ করা হবে। বর্তমানে স্যাটেলাইট অপারেটর থেকে ব্যান্ডউইথ ভাড়া করে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট সংযোগের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে, যাতে বছরে প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। বিটিআরসি প্রস্তাব অনুযায়ী স্যাটেলাইট প্রকল্পটি সাত বছরের মধ্যে ব্রেক-ইভেন লেভেল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাবে এবং নিয়ন্ত্রককে অন্যান্য দেশগুলিতে অতিরিক্ত ক্ষমতা বিক্রি করার অনুমতি দেবে। বঙ্গবন্ধু -১ এ সমস্ত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, তুর্কমেনিস্তান, কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তানসহ অন্যান্য দেশে সেবা প্রদান করতে সক্ষম হবে। ভারত, পাকিস্তানের নিজস্ব স্যাটেলাইট আছে এবং শ্রীলংকার নিজস্ব স্যাটেলাইটের পরিকল্পনা চলছে।

বঙ্গবন্ধু -১ এর সার্ভিস নেপাল, ভুটান এবং মিয়ানমারের মত দেশে দিয়ে অর্থ উপার্জন করা সম্ভব হবে। সব মিলিয়ে বছরে ৫০ মিলিয়ন ডলার উপার্জন করা সম্ভব হবে। যার ফলে উন্নয়নের নতুন এক যুগের নবসূচনা দেখা দেবে।
চিত্র: ২
চিত্র- ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু উদ্বোধন করেন দেশের প্রথম উপগ্রহ ভূকেন্দ্র
বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ইন্টারনেট অব থিংসের রূপকল্প শুরু হয়েছে। ঢাকার মিরপুরে গড়ে উঠেছে ইন্টারনেট অব থিংসের ল্যাব। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এই ল্যাবের সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে রয়েছে যৌথভাবে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) এবং ডাটাসফট। ট্রেনিং প্রোগ্রামে দেখাশোনা করছে আইএটি, বুয়েট এবং আর্থিক সহায়তায় রয়েছে বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি মন্ত্রণালয়। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা একঝাঁক মেধাবী তরুণকে নিয়ে বাস্তবমুখী বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছে ডাটাসফট।   গোটা প্রকল্পে তত্ত্বাবধায়নে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কলাম্বিয়া এর ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অ্যাডজাঙ্কট অ্যাসিসট্যান্ট প্রফেসর ড. মাইকেল ওয়াং। ডক্টর ওয়াং সরাসরি ক্লাস নিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন।
চিত্র: ৩

চিত্রঃ ইউল্যাব, বুয়েট, আইএটি, বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক এবং ডাটাসফটের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ইন্টারনেট অব থিংস ল্যাব

ডিজিটাল প্রযুক্তির জন্য দেশের প্রস্তুতিকে আরো বেগবান করতে হলে মূল দৃষ্টি রাখতে হবে তরুণ প্রজন্মের উপরে। কারণ তরুণরা ডিজিটাল প্রযুক্তিকে দ্রুত আপন করে নেওয়ায় সক্ষমতা দেখিয়েছে। এক্ষেত্রে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে আইসিটি শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করবে। OECD দেশসমূহের পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে ডিজিটাল টেকনোলজিতে দক্ষতা অর্জনে বয়স্কদের তুলনায় তরুণদের পারদর্শিতা বেশি। পরবর্তী প্রজন্মকে দ্রুত আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তির সাথে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার মাধ্যমেই এই সেক্টরে তাদের মেধা বিকাশের পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হবে।

শুধু ট্রেনিং সেন্টারে বিভিন্ন কোর্স করে দেশকে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দূরদর্শিতা অর্জন করা কঠিন। উদ্ভাবনী চিন্তার জন্য প্রয়োজনীয় সৃজনশীলতা অর্জনে আগামী প্রজন্মকে প্রস্তুত করতে হবে।

২০১১ সালে ইউনেস্কোর প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী, শিক্ষাক্ষেত্রে আইসিটি প্রযুক্তির ব্যবহার দেশের, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন করতে সক্ষম। পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, যেসকল শিক্ষার্থীরা কম্পিউটার টিউটোরিয়াল ব্যবহার করে তারা ম্যাথম্যাটিক্স, ন্যাচারাল সাইন্স এবং সোশ্যাল সাইন্সের মত বিষয়গুলোতে তুলনামুলকভাবে বেশি স্কোর অর্জন করতে পারে।

প্রাইমারি স্কুলের যেসকল শিক্ষার্থী পড়া এবং লেখা (Reading and Writing) এর জন্য কম্পিউটার সফটওয়্যার ব্যবহার করে তারা তুলনামুলকভাবে রিডিং এবং রাইটিং স্কিলের পরীক্ষায় বেশি স্কোর অর্জন করতে সক্ষম হয়। সেই সাথে বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চতর শিক্ষা পর্যায়ে আরো বেশি গবেষণামূলক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষার্থী এবং গবেষকরা প্রয়োগিক কাজের মাধ্যমে তাদের দক্ষতাকে নতুন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবেন।
জাতীয় আইসিটি পলিসি ২০১৫ অনুযায়ী শিক্ষাক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য সরকার কাজ করে চলছে। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ই-লাইব্রেরি গঠন, ICT প্রযুক্তি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ফান্ডিং প্রদান এবং প্রতিটি বিভাগে অন্তত একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে “Center of Excellence for ICT” তে রূপান্তরিত করা এই পলিসির অন্যতম লক্ষ্য। মানুষের দোরগোড়ায় ডিজিটাল সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে শুরু হয়েছে Access to Information (a2i) Program যার মাধ্যমে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল বইয়ের ডিজিটাল ভার্সন প্রকাশ করার কাজ চলছে। অনলাইনে কলেজে ভর্তি ব্যবস্থা এবং পাবলিক পরীক্ষার (এসএসসি, এইচএসসি) ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে।

অতিরিক্ত শিক্ষার্থী বাংলাদেশের অন্যতম বড় একটি চ্যালেঞ্জ। এদেশে শিক্ষকের তুলনায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। ২০১৩ সালে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতি ৫৩ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১ জন শিক্ষক বরাদ্দ রয়েছে। ২০১১ সালে এই অনুপাত ছিল ৪০:১, ফলে শিক্ষার্থীরা যেমন যথার্থ শিক্ষা পেতে সক্ষম হচ্ছে না তেমনই শিক্ষকদের উপরেও অতিরিক্ত চাপ পড়ে যাচ্ছে। এই সমস্যার একটি সমাধান হতে পারে রিমোট টিচিং। জাতীয় আইসিটি পলিসির অন্যতম লক্ষ্য কম খরচে মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে স্কুলের সকল শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়া।

রিমোট টিচিংয়ের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও উন্নত শিক্ষা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। কম্পিউটার এবং ওয়েবক্যাম ব্যবহার করে ঢাকায় বসেই একজন শিক্ষক দূরের কোন অঞ্চলে ক্লাস নিতে পারবেন।

চিত্র: ৪
ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন করতে হলে দেশের নেটওয়ার্ক আরো শক্তিশালী করতে হবে। শক্তিশালী নেটওয়ার্ক দেশের তথ্যপ্রযুক্তি এবং আধুনিক সকল প্রযুক্তির (যেমন – ইন্টারনেট অব থিংস) মেরুদণ্ড হিসাবে কাজ করে। দি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের নেটওয়ার্কড রেডিনেস ইনডেক্স (NRI) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নেটওয়ার্কের উন্নতির উপর ভিত্তি করে প্রতি বছর একটি র‍্যাঙ্কিং তৈরি করে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ NRI র‍্যাঙ্কিংয়ে ১৪৮ টি দেশের মাঝে ১১২ তম স্থানে রয়েছে। এই স্কেলে সব মিলিয়ে বাংলাদেশের স্কোর ৩.৩ । NRI র‍্যাঙ্কিংয়ে ১ম, ২য় এবং ৩য় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে সিঙ্গাপুর (স্কোর ৬.০), ফিনল্যান্ড (স্কোর ৬.০) এবং সুইডেন (স্কোর ৫.৮)। NRI র‍্যাঙ্কিংয়ে প্রতিটা দেশের নেটওয়ার্ক ও ডিজিটালাইজেশনকে চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয় -  Constrained, Emerging, Transitional এবং Advanced -যাদের মাঝে Advanced ক্যাটাগরিতে সবচেয়ে উন্নত নেটওয়ার্কসম্পন্ন দেশগুলোকে রাখা হয়। বাংলাদেশ বর্তমানে Constrained পর্যায়ে অবস্থিত।

ডিজিটাল পৃথিবীর জন্য প্রস্তুত হতে হলে কোন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত? OECD এর রিপোর্ট অনুযায়ী, মূলত চারটি দিকে মনোযোগ রেখে আইসিটি পলিসি তৈরি করা উচিত:
চিত্র ৫

১. আইসিটি শিক্ষা ব্যবস্থা: ভবিষ্যতের পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে আইসিটি। তাই আগামী প্রজন্মকে প্রস্তুত করার জন্য প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বেসিক আইসিটি স্কিলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার মাধ্যমিক পর্যায় থেকে আইসিটি শিক্ষা চালু করেছে যা অত্যন্ত প্রশংসনীয় একটি পদক্ষেপ। আগামীতে কর্মস্থল থেকে শুরু করে জীবনের সকল ক্ষেত্রেই প্রযুক্তির দক্ষ ব্যবহারের প্রয়োজন পড়বে, সেই লক্ষ্যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে।

২. নতুন বিশ্বের চাহিদা পূরণ: নতুন প্রযুক্তির আগমনের সাথে সাথে মানুষের চাহিদা পরিবর্তিত হচ্ছে, সেই সাথে নতুন ধরনের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে। আগামীতে কোন ধরনের দক্ষতার চাহিদা বেশি থাকবে তা এখনই যৌক্তিকভাবে অনুমান করে সেই ধরনের দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষার্থী তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে বিগ ডাটার ব্যবহার করে শ্রমবাজারে এবং চাকরিক্ষেত্রে কোন ধরনের চাহিদা বেশি তা নির্ণয় করা যেতে পারে। যার ফলে শিক্ষার্থীদেরকে সেই সকল দিকে দক্ষ করে গড়ে তোলা সম্ভব হয়।

৩. দক্ষতার সঠিক ব্যবহার: বর্তমান সময়ে শুধু দক্ষ কর্মচারী থাকলেই সর্বোচ্চ ফলাফল পাওয়া যায় না বরং দক্ষ কর্মচারীদের প্রতিভার সঠিক ব্যবহার করতে হয়। পড়া (Reading), নিউমারেসি (Numeracy) কিংবা প্রযুক্তির ব্যবহার করে সমস্যা সমাধানের মত দক্ষতার সঠিক প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন কর্মক্ষেত্রে উন্নত ওয়ার্ক অর্গানাইজেশন এবং ম্যানেজমেন্ট প্র্যাকটিস।

৪. নতুন প্রযুক্তি শেখার আগ্রহ সৃষ্টি করা: ডিজিটাল প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চাহিদা সারাক্ষণ পরিবর্তন হতে থাকে, যার ফলে এই সেক্টরের কর্মীদেরকে বারবার ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে নতুন বিষয় শিখতে হয়। প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য কর্মীদের এবং প্রতিষ্ঠানের (Firm) আগ্রহ থাকতে হবে। সেই সাথে যেসকল তরুনের যথেষ্ট দক্ষতা নেই তাদেরকে বিশেষ ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

এছাড়াও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষা, গবেষণা, উন্নয়নের প্রভাবক এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প বাস্তবায়নের নেতৃত্বের জন্য আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। আর এর মাধ্যমেই ডিজিটাল প্রযুক্তিতে ধারাবাহিক অগ্রগতি বজায় রাখা সম্ভব হবে, যার ফলশ্রুতিতে আগামীর জন্য প্রস্তুত হয়ে (Ready for Tomorrow) উন্নত আধুনিক বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।

প্রফেসর ড. সাজ্জাদ হোসেনপ্রফেসর ড. সাজ্জাদ হোসেন: ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ(ইউল্যাব)। সহযোগিতায়: মোঃ শাকিফ ফেরদৌস এবং খায়রুন নাহার।



বাংলাদেশ সময়: ১৯০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।