পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমের প্রদেশ বেলুচিস্তানে মঙ্গলবার রাতে বিমান হামলা চালিয়েছে ইরান। এতে জাতীয় নির্বাচনের এক মাসেরও কম সময় আগে ইসলামাবাদকে বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতে টেনে আনার শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন।
ইরান বলছে, সশস্ত্র গোষ্ঠী জইশ আল-আদলকে (ন্যায়ের সৈনিক) লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। এতে দুই শিশু নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে আরও তিনজন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে।
মন্ত্রণালয় বলছে, পাকিস্তান জোরালোভাবে এ হামলার নিন্দা জানাচ্ছে। সীমান্ত শহর পানজগুরের কাছে হামলার ঘটনাটি ঘটে। ইসলামাবাদ হামলাকে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন বলে আখ্যা দিয়ে ইরানকে গুরুতর পরিণতির জন্য সতর্ক করে দিয়েছে।
কিন্তু এর কী পরিণতি হতে পারে?
বেড়েছে দ্বিপক্ষীয় সম্পৃক্ততা
সম্প্রতি পাকিস্তানি ও ইরানি কর্মকর্তাদের মধ্যে, বেসামরিক ও সামরিক উভয়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান মিথস্ক্রিয়ার মধ্যেই এ হামলার ঘটনা ঘটল।
বেলুচিস্তানে ইরানি যুদ্ধবিমানের বোমা ফেলার কয়েক ঘণ্টা আগেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার-উল-হক কাকার ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমিরাবদুল্লাহিয়ানের সঙ্গে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সাইডলাইনে সাক্ষাৎ করেন।
চলতি সপ্তাহের শুরুতে ইসলামাবাদে পাকিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জলিল আব্বাস ইরানের আফগানবিষয়ক বিশেষ দূত হাসান কাজমি কোমির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য বর্ধিত সমন্বয় নিয়ে আলোচনা করেন।
১৬ জানুয়ারি গালফ ও হরমুজ প্রণালীতে একদিনের নৌ-মহড়ায় অংশ নেয় দেশ দুটি।
সাম্প্রতিক এসব সম্পৃক্ততা এবং সীমান্ত ব্যবস্থাপনার জন্য দুই দেশের মধ্যে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনে ২০২২ সালের সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও সীমান্ত সংঘর্ষ অল্প-বিস্তর রয়েই গেছে।
গেল ডিসেম্বরে ইরানি গণমাধ্যমে এক প্রতিবেদনে জানায়, সেদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সতর্ক করে দিয়ে বলেন, পাকিস্তান যেন ইরানে হামলা থেকে যেন জইশ-আল-আদিলকে থামায়। ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশের রাস্ক শহরে হামলায় ১১ পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পর এ সতর্কতা দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
২০২৩ সালের মে মাসে পাকিস্তান সীমান্তে ইরানি সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ছয় সদস্য নিহত হন। এরপরও ইরান সতর্কবার্তা দেয়। এক মাস আগে চার পাকিস্তানি সেনা বেলুচিস্তান প্রদেশে আন্তঃসীমান্ত গোলাগুলিতে নিহত হন।
ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রায় ৯০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। দেশ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয় দেয় বলে একে অন্যকে দোষারোপ করে।
আলাদা হওয়ার দাবিতে কয়েক দশক ধরে বেলুচ বিদ্রোহীদের বিদ্রোহের মুখোমুখি পাকিস্তান।
অন্যদিকে ইরানের দাবি, পাকিস্তান যাতে জইশ আল-আদিলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। সুন্নি গোষ্ঠীটি ইরানি কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে বিভিন্ন সময়ে হামলা চালিয়েছে। গোষ্ঠীটির দাবি, দেশের সবচেয়ে দরিদ্র সিস্তান-বেলুচিস্তানের বাসিন্দাদের উন্নত জীবনমান।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ইরানের হামলা এমন এক সময়ে ঘটল, যখন গাজায় ইসরায়েল হামলা চালাচ্ছে। এ যুদ্ধ অঞ্চলব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইরানের হামলা পরিণত জবাবই আশা করে। এসব কথা বলেন ইসলামাবাদ-ভিত্তিক থিংকট্যাংক তাবাদলাবের মোশাররফ জাইদি এমনটি বলেন। ইরান সম্প্রতি সিরিয়া ও ইরাকেও হামলা চালিয়েছে।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, পাকিস্তানের জবাব এখন পর্যন্ত তা-ই হওয়া উচিত। ইরানিরা অপ্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়া উসকে দিতে চাইছে। এই মুহূর্তে আসল ঝুঁকি হলো পাকিস্তানের বৃহত্তর বিপদগুলো এমন একটি সংঘাতে আটকে যেতে পারে, যেটি প্রধান নয়, এবং যেটির মাধ্যমে আরও বিভ্রান্ত করা হবে।
সামরিক প্রতিক্রিয়া
অন্যদিকে ওয়াশিংটন, ডিসি-ভিত্তিক নিউ লাইনস ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটিজি অ্যান্ড পলিসির জ্যেষ্ঠ পরিচালক কামরান বোখারি বলেন, পাকিস্তান হামলার মাধ্যমে জবাব দিতে পারে- যদিও এর অর্থ পাকিস্তানের জন্য একটি সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, পশ্চিমে আফগানিস্তান এবং পূর্বে ভারতের পর তৃতীয় একটি সীমান্তে সংঘাত শুরু হতে পারে। ইসলামাবাদ এর জন্য প্রস্তুত কি না, আমি নিশ্চিত নই।
পাকিস্তান অভিযোগ জানাতে ইসলামাবাদে ইরানের শীর্ষ দূতকে তলব করেছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইহসানউল্লাহ টিপু বলেন, তিনি আশা করছেন, পাকিস্তান কূটনৈতিক ও সামরিক উভয় প্রতিক্রিয়ার জন্য সম্ভাব্য বিকল্প দেখবে।
টিপু আল জাজিরাকে বলেন, পাল্টা জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের জন্য ন্যয্যতা ও চাপ- দুই-ই রয়েছে। দেশটি ইরানের সর্বোচ্চ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে ক্ষমা আশা করতে পারে। তবে যদি এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, পাকিস্তান ইরানের হামলায় সামরিক প্রতিক্রিয়াও বিবেচনা করতে পারে।
খবর ও গবেষণার পোর্টাল খোরাসান ডায়েরির একজন পরিচালক টিপু। পোর্টালটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যুতে বিশ্লেষণ করে থাকে। তিনি মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে অব্যাহত সংঘাত সত্ত্বেও ইরানের কর্মকাণ্ডে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন, ইরানের পদক্ষেপ রাজনীতি ও নিরাপত্তা উভয় ক্ষেত্রেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে।
টিপু বলেন, পাকিস্তান মনে করে ইরানে পাকিস্তান-বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর অবস্থান রয়েছে। ইরানের হামলা পাকিস্তানকে একই পথ অনুসরণের ন্যায্যতা দিয়েছে।
কামরান বোখারি বলেন, ইরানের বিমান হামলা পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও তুরস্কের সঙ্গে বৃহত্তর জোট গঠনে বাধ্য করতে পারে। এসব দেশের প্রতিটিই ইরানের সংযম নিশ্চিত করতে আগ্রহী। পাকিস্তানের ওপর হামলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের বৃহত্তর সংঘর্ষের একমাত্র উপাদান।
তিনি বলেন, তেহরান ওয়াশিংটনের সঙ্গে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে একটি গুটি হিসেবে দেখে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০২৪
আরএইচ