২০১০ সালের অক্টোবরে দিল্লিতে দিনব্যাপী এক সম্মেলনের আয়োজন করেছিল ‘কমিটি ফর দ্য রিলিজ অব পলিটিক্যাল প্রিজনার্স’। সম্মেলনে অরুন্ধতী রায় ‘কাশ্মীর কখনোই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল না।
মঙ্গলবার (১৮ জুন) এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। এতে উল্লেখ করা হয়, ১৪ বছর আগে ভারতের অন্যতম বিখ্যাত লেখক বুকারজয়ী অরুন্ধতী রায়ের করা একটি মন্তব্যের জেরে বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তিনি সত্যিই কি জেলে যাবেন?
পেছনে ফিরলে জানা যায়, অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধে ২০১০ সালে মূল অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। ওই অভিযোগের ১৪ বছর পর গত সপ্তাহে তার বিরুদ্ধে দেশটির কঠোর সন্ত্রাসবিরোধী আইনে বিচারের অনুমতি দিয়েছেন দিল্লির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
ভারতের অধিকারকর্মী, সাংবাদিক, সুশীল সমাজের সদস্যসহ সমালোচকদের চুপ করিয়ে দিতে দেশটির কেন্দ্রীয় নরেন্দ্র মোদী সরকার এই আইন ব্যবহার করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
বিবিসির খবরে বলা হয়, ২০১০ সালের শুরুর দিকে কাশ্মীরে স্বাধীনতার পক্ষে নতুন করে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। বিক্ষোভকালে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী নিহত হন। এ ঘটনার ধারাবাহিকতায় সে বছরের অক্টোবরে দিল্লির সম্মেলনে কাশ্মীর নিয়ে এ মন্তব্য করেছিলেন ৬২ বছর বয়সী স্পষ্টভাষী ও অধিকারকর্মী অরুন্ধতী।
বিতর্কিত অঞ্চলটিকে (কাশ্মীর) নিজেদের বলে দাবি করে আসছে পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তান। কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দুটি যুদ্ধ হয়েছে।
এ বিষয়ে অরুন্ধতীর ভারতের আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকেই। অরুন্ধতীকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়েছিল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার। অরুন্ধতীর বাড়ির বাইরে তখন বিক্ষোভ হয়েছিল। তখন কাশ্মীরের আইনের শিক্ষক শেখ শওকত হুসেন ছাড়া আরও দুজনের বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করা হয়। এতে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়।
প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বাকস্বাধীনতার অধিকারের পক্ষে অরুন্ধতী বলেছিলেন, ভারত ভাঙতে চাই এই অভিযোগে পত্রপত্রিকায় আমার বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক বক্তব্য দিয়েছিল। পক্ষান্তরে আমি যা বলেছি, তা ভালোবাসা ও গর্ব থেকে। আফসোস সেই জাতির জন্য, যারা মনের কথা বলার জন্য তাদের লেখকদের চুপ করিয়ে দেয়।
বক্তব্যের এক দশকের বেশি সময় পর অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে মামলা ও বিচারের মুখোমুখি করার সিদ্ধান্তে আইনজীবীরা বিভ্রান্ত।
অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে মূলত রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছিল। কিন্তু ২০২২ সালের মে মাসে ঔপনিবেশিক আমলের রাষ্ট্রদ্রোহ আইন স্থগিত করেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু এখন ইউএপিএ আইনের অধীন মামলার অনুমতি দেওয়ায় সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ এড়িয়ে বিচারকাজ এগিয়ে নিতে পারবে সরকার।
এদিকে মোদী সরকারের একজন কঠোর সমালোচক অরুন্ধতী। অধিকার গোষ্ঠীগুলোর অভিযোগ, মোদী সরকার অধিকারকর্মীদের নিশানা করছে। বাকস্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করছে।
নরেন্দ্র মোদী তৃতীয় মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এরপরই অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে মামলার অনুমতি দেওয়া হলো। অনেকেই মোদি সরকারের এই পদক্ষেপকে একটি রাজনৈতিক বার্তা হিসেবে দেখছেন। তা হলো, এবার বিজেপি জোট সরকার গড়লেও ভিন্নমত দমনে কৌশল অব্যাহত রাখবে তারা।
২০১০ সালে সুশীল পণ্ডিত নামের এক ব্যক্তি অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে অভিযোগটি দায়ের করেছিলেন। টাইমস নাউ টেলিভিশনকে সুশীল বলেন, যারা নথিটি সচল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাদেরই বিষয়টি ব্যাখ্যা করা উচিত। কেন দেরি হলো, সে বিষয়ে একটি তদন্ত হওয়া উচিত। জবাবদিহি আদায় করা উচিত।
এদিকে অনেকেই এই পদক্ষেপকে মোদির সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার আরেকটি প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন। লেখক অমিতাভ ঘোষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে বলেন, অরুন্ধতীকে হেনস্তা করা পুরোপুরি বিবেকবর্জিত কাজ। তিনি একজন বড় মাপের লেখক। তার মতামত দেওয়ার অধিকার রয়েছে। এক দশক আগে তিনি যা বলেছিলেন, সে জন্য তার বিচার করার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিবাদ হওয়া উচিত।
গত বছরের অক্টোবরে দিল্লির কর্তৃপক্ষ মামলাটি আদালতে নেওয়ার অনুমোদন দিলে কানাডার লেখক ও অধিকারকর্মী নাওমি ক্লেইন এক্স পোস্টে মোদিকে সতর্ক করে বলেছিলেন, সোচ্চার সমালোচককে চুপ করানোর পরিণতি কী হবে, তা আপনার কোনো ধারণা নেই।
গত দুই দশকে কাশ্মীর, পারমাণবিক অস্ত্র, বড় বাঁধ, বিশ্বায়ন, দলিত আইকন বি আর আম্বেদকর, মাওবাদী বিদ্রোহীদের সঙ্গে বৈঠক, অ্যাডওয়ার্ড স্নোডেন ও জন কুসাকের সঙ্গে কথোপকথনের মতো বিষয়ের ওপর বেশ কিছু নন-ফিকশন বইসহ অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন অরুন্ধতী।
‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ অরুন্ধতীর শৈশব অনুপ্রাণিত একটি পারিবারিক উপন্যাস। এটি ১৯৯৭ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পায়। তিনি অল্প বয়সেই তারকা লেখক বনে যান।
সমালোচকেরা অরুন্ধতীর কুশপুত্তলিকা পর্যন্ত পুড়িয়েছেন। তার নানা অনুষ্ঠান ভন্ডুল করেছেন তারা। তিনি রাষ্ট্রদ্রোহ ও অবমাননার অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন। এমনকি বড় বড় বাঁধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় তিনি এক দিন কারাগারে পর্যন্ত কাটিয়েছেন।
অনেকে মনে করেন, ভারতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কমেছে। ২০১৪ সালে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ছিল ১৪০। ২০২৩ সালে দেশটির অবস্থান ১৬১তম স্থানে নেমেছে।
মামলাসংক্রান্ত সর্বশেষ ঘটনা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি অরুন্ধতী। পুলিশ অভিযোগের তদন্ত করেছে কি না বা অরুন্ধতীসহ অন্য ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রমাণ আছে কি না, তাও স্পষ্ট নয়।
এই মামলায় দুই অভিযুক্ত ইতোমধ্যে মারা গেছেন। তবে এটা নিশ্চিত, যদি ভারতের সবচেয়ে সম্মানিত লেখকদের একজনকে একটি কঠোর সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়, তাহলে তা বিশ্বব্যাপী নিন্দা ও ক্ষোভের জন্ম দেবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৯ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০২৪
এমজে