এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে কোনো রুশ রাজনীতিবিদ বা কর্মকর্তা এখন পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে জয়ের সম্ভাবনার বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেননি। এতে বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে যে, ট্রাম্প প্রশ্নে তারা এখন ঠিক আগের অবস্থানে নেই।
বরং এবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে দেখা গেছে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের প্রশংসা ও সমর্থন করতে। যদিও পুতিনের ওই প্রশংসা ও সমর্থনকে ক্রেমলিনের রসিকতা হিসাবেই ব্যাখ্যা করেছেন অনেকে।
সম্প্রতি নিজের এক বক্তব্যে রুশ প্রেসিডেন্ট জানান যে, তিনি হ্যারিসের সংক্রামক হাসি পছন্দ করেন। কিন্তু পুতিনের মুখে যে হাসি এখনো টিকে আছে, সেটির কৃতিত্ব যে হ্যারিসের না বরং ট্রাম্পের, তা বুঝতে রাজনীতির মহাজ্ঞান রাখার প্রয়োজন নেই।
উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা নিয়ে রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণায় বাইডেন প্রশাসনের কঠোর সমালোচনা করেন।
অথচ ইউক্রেনের ওপর পূর্ণমাত্রায় আগ্রাসন চালানোর জন্য প্রেসিডেন্ট পুতিনকে দায়ী করে বক্তব্য দেওয়ার বিষয়ে তার ভেতরে যে অনিচ্ছা কাজ করছে, সেটা বেশ স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক নির্বাচনী বিতর্কের সময়েও তিনি ইউক্রেনকে যুদ্ধে জেতানোর বিষয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেননি। প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়ে ট্রাম্প উল্টো দাবি করেন যে, তিনি ক্ষমতায় থাকলে এ যুদ্ধ শুরুই হতো না।
কিন্তু ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে এর ঠিক বিপরীত অবস্থানে দেখা যায়। তিনি সরাসরি ইউক্রেনের পক্ষে কথা বলেন। নানা যুক্তি তুলে ধরে হ্যারিস বলেন, কৌশলগত স্বার্থেই ইউক্রেনকে সমর্থন করা প্রয়োজন।
এসব কথা বলার সময় তিনি রুশ প্রেসিডেন্টকে খুনি স্বৈরশাসক বলেও উল্লেখ করেন।
অবশ্য রাশিয়ার টিভি চ্যানেলে যে হ্যারিসের খুব প্রশংসা করা হচ্ছে, তেমন নয়। কয়েক সপ্তাহ আগে রাশিয়ার একজন প্রথম সারির সংবাদ উপস্থাপককে হ্যারিসের রাজনৈতিক জ্ঞান ও সক্ষমতার বিষয়ে প্রশ্ন পর্যন্ত তুলতে দেখা যায়।
তবে এসব আলাপ-আলোচনার বাইরে মার্কিন নির্বাচন শেষ পর্যন্ত কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে যাচ্ছে, তা রাশিয়ার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
কেননা, ট্রাম্প ও হ্যারিসের মধ্যে একজন যদি সামান্য ব্যবধানে হেরে যান, সেক্ষেত্রে দুই পক্ষের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও রেষারেষি-বিতর্ক বেড়ে যাবে। এতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈদেশিক নীতির বিষয়ে তাদের মনোযোগ কম থাকবে বলে মনে করেন অনেকে।
সাবেক প্রসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্ষমতা নেওয়ার পর রুশ-মার্কিন দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর সেটির আরও অবনতি হয়।
জো বাইডেনের সময়েও অবস্থার উন্নতি হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সদ্য সাবেক রুশ রাষ্ট্রদূত আনাতোলি আন্তোনোভের ভাষায়, বাইডের প্রশাসনের অধিনে রুশ-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কার্যত ভেঙে পড়েছে।
ওয়াশিংটন অবশ্য এ ঘটনার জন্য অবশ্য পুরোপুরিভাবে মস্কোকেই দায়ী করছে। জেনেভায় বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকের মাত্র আট মাসের মাথায় ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রায় আক্রমণের নির্দেশ দেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন।
এরপর রাশিয়ার ওপর রীতিমত নিষেধাজ্ঞার সুনামি বইয়ে দেয় বাইডেন প্রশাসন। গত আড়াই বছরেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধে টিকে থাকতে কিয়েভকে সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
দেশটি ইউক্রেনকে ট্যাঙ্ক, হাই মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেমসহ বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করছে, যা রুশ-মার্কিন সম্পর্ককে তলানিতে নামানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
এসব দেখে এখন বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয় যে, একটা সময় ছিল যখন বৈশ্বিক নিরাপত্তা জোরদারের লক্ষ্যে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অংশীদার হিসেবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং তা খুব বেশিদিন আগের ঘটনাও নয়।
১৯৮৭ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসক মিখাইল গর্বাচেভ দুই দেশের পারমাণবিক অস্ত্র সীমিত করার লক্ষ্যে চুক্তিতে সই করেছিলেন।
এরপর ১৯৯১ সালে মার্কিন ফার্স্ট লেডি বারবারা বুশ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের রাইসা গর্বাচফ মস্কোতে যৌথভাবে একটি অসাধারণ ভাস্কর্য উন্মোচন করেছিলেন।
সেটি ছিল আটটি বাচ্চাসহ একটি মা হাঁসের ভাস্কর্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন পাবলিক গার্ডেনের একটি ভাস্কর্য অনুকরণে স্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়েছিল, যা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকান শিশুদের মধ্যে বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে মস্কোতে স্থাপন করা হয়েছিল।
ভাস্কর্যটি এখনো মস্কোবাসীর কাছে বেশ প্রিয়। ফলে রুশ নাগরিকদের অনেকেই ব্রোঞ্জের তৈরি হাঁস ও তার বাচ্চাদের সঙ্গে ছবি তুলতে নোভোদেভিচ পার্কে ছুটে আসেন। তবে তাদের মধ্যে খুব কম মানুষই এ হাঁস কূটনীতির পেছনের গল্প জানেন।
রুশ-মার্কিন সম্পর্কের মতো ব্রোঞ্জের হাঁসগুলোর ওপর দিয়েও নানান ঝক্কি গেছে। কয়েকটি বাচ্চা তো রীতিমত চুরিরও শিকার হয়েছিল, যেগুলো পরবর্তীতে প্রতিস্থাপন করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির নির্বাচন নিয়ে রুশ নাগরিকরা কী ভাবছেন, তা খুঁজতে বিবিসির প্রতিবেদক ওই হাঁস ও তার বাচ্চাদের ভাস্কর্যের কাছে গিয়েছিলেন।
আমি চাই আমেরিকা অদৃশ্য হয়ে যাক, রাগান্বিত কণ্ঠে বলছিলেন অ্যাংলার ইগর। তিনি ভাস্কর্যটির পাশেই একটি পুকুরে মাছ ধরছিলেন।
তিনি বলেন, দেশটি বিশ্বে অনেকগুলো যুদ্ধ শুরু করেছে। সোভিয়েত আমলেও আমেরিকা আমাদের শত্রু ছিল এবং এখনও তা-ই আছে। এক্ষেত্রে কে প্রেসিডেন্ট হলো তা বিবেচ্য বিষয় নয়।
এখানে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলোতে প্রায়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে রাশিয়ার চিরশত্রু হিসেবে উপস্থাপন করতে দেখা যায়।
অনেকে আমেরিকাকে শত্র বিবেচনা করেন না বলে জানান। স্বেতলানা নামের একজন রুশ নাগরিক বলেন, আমি শান্তি ও বন্ধুত্বের পক্ষে। কিন্তু আমার যে বন্ধু আমেরিকায় থাকে, সে এখন আমাকে ফোন করতে ভয় পায়। সেখানে হয়তো বাকস্বাধীনতা নেই। অথবা সম্ভবত এখানে রাশিয়ায় বাকস্বাধীনতা নেই। আমি ঠিক জানি না।
নিকিতা নামের আরেক রুশ নাগরিক বলেন, আমাদের দুই দেশ এবং সেখানকার জনগণের মধ্যে সম্পর্ক হওয়া উচিত বন্ধুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে যুদ্ধ কিংবা কার কাছে বেশি ক্ষেপণাস্ত্র আছে, সেটা দেখানোর মতো প্রতিযোগিতা ছাড়াই সম্পর্ক হোক। আমি ট্রাম্পকে পছন্দ করি। তিনি যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন বড় কোনো যুদ্ধ বাঁধেনি।
রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে নানা পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও দেশ দুটির মধ্যে একটি বিষয়ে বেশ মিল রয়েছে। তা হলো, দুই দেশেই কখনো কোনো নারী প্রেসিডেন্ট হতে দেখা যায়নি, সব সময় পুরুষরাই হয়েছেন।
রুশ নাগরিকরা কি এই অবস্থার পরিবর্তন দেখতে চান? মেরিনা নামে এক নাগরিক বলেন, আমি মনে করি যে, একজন নারী দেশের প্রেসিডেন্ট হলে ব্যাপারটা দারুণ হবে।
তিনি বলেন, এখানে (রাশিয়ায়) একজন নারী প্রেসিডেন্টকে ভোট দিতে পারলে আমি খুশি হবো। আমি বলছি না যে, সেটি ভালো বা খারাপ হবে। তবে বেশ ভিন্ন একটা ব্যাপার হবে।
বিবিসি অবলম্বনে
বাংলাদেশ সময়: ২২৩০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৫, ২০২৪
আরএইচ