ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৯ ফাল্গুন ১৪৩১, ০৪ মার্চ ২০২৫, ০৩ রমজান ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

বৈশ্বিক সহযোগিতায় ‘ফাটলের আলামত’ জি-২০ বৈঠকে

মোহাম্মদ নাহিয়ান, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ৪, ২০২৫
বৈশ্বিক সহযোগিতায় ‘ফাটলের আলামত’ জি-২০ বৈঠকে

দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক জি২০ অর্থনৈতিক বৈঠকে বৈশ্বিক সহযোগিতার ক্রমবর্ধমান ফাটল সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। এই বৈঠকে বিশ্ব নেতারা বহুপাক্ষিকতার অবক্ষয় সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যা বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন করছে।

আয়োজনের স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা তার ভাষণে বহুপাক্ষিক সহযোগিতার অপরিহার্যতা তুলে ধরেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা বিরোধ নিষ্পত্তি ও সংঘাত নিরসনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার মতে, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার জন্য বহুপাক্ষিক সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজনীয়।

তবে এই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্টের অনুপস্থিতি জি২০-এর ভেতরকার বিভাজনকে আরও প্রকট করেছে।  

১৯টি উন্নত অর্থনীতির দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নিয়ে গঠিত জি২০ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ সমাধানের জন্য যৌথ নীতির মাধ্যমে কাজ করে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মার্কো রুবিও জি২০ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক বয়কট করে ফোরামের বিরুদ্ধে “অ্যান্টি-আমেরিকানিজম” এর অভিযোগ তোলেন, যা বহুপাক্ষিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে উদ্বেগজনক সংকেত।

আন্তর্জাতিক আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে উৎসাহিত করার জন্য ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জি২০। কিন্তু সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা—যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জলবায়ু নীতি এবং মার্কিন প্রশাসনের পরিবর্তিত অবস্থান—জি২০-এর ঐক্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট রামাফোসা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে সমন্বিত আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, বহুপাক্ষিক সহযোগিতাই ধীর এবং অসম প্রবৃদ্ধি, ঋণের বোঝা, দারিদ্র্য ও বৈষম্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার একমাত্র কার্যকর পন্থা। তার মতে, যৌথ কৌশলের অভাবে অর্থনৈতিক সংকট, পরিবেশগত অবক্ষয় এবং ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।

জি২০-তে এই বিভাজন আরও বড় বৈশ্বিক প্রবণতাকে প্রতিফলিত করে, যেখানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অবক্ষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।  

ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিয়ানকার্লো জর্জেত্তি প্রেসিডেন্ট রামাফোসার উদ্বেগের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সতর্ক করেন যে, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে আরও সংকটময় পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে — বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য। তিনি তুলে ধরেন কিভাবে সুরক্ষাবাদ, বাণিজ্যে বাধা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিশ্বব্যাপী মূল্য শৃঙ্খলকে (চেইন) ব্যাহত করে, উৎপাদন খরচ এবং মূল্যস্ফীতি বাড়ায় — যা অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতাকে দুর্বল করে দেয়।

স্কট বেসেন্টের অনুপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের বহুপাক্ষিক সহযোগিতা থেকে সরে আসার আশঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে এবং জি২০-এর বৈশ্বিক সংকট ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এমন অনুপস্থিতি জি২০-এর বিশ্বাসযোগ্যতা এবং যৌথ সংকট মোকাবিলার সক্ষমতাকে দুর্বল করতে পারে।

আধুনিক বিশ্বে অর্থনীতির আন্তঃসংযোগের কারণে এক অঞ্চলের সংকট দ্রুত অন্য অঞ্চলে প্রভাব ফেলে। আর্থিক সংকট, জলবায়ু দুর্যোগ বা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা জাতীয় সীমান্তে সীমাবদ্ধ থাকে না — এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় সম্মিলিত প্রতিক্রিয়া অপরিহার্য।

বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা নির্ভর করে দেশগুলোর একত্রে কাজ করার উপর — সংকট ব্যবস্থাপনা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণাও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে ত্বরান্বিত হয়, যা বৈশ্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত জি২০-এর বৈঠক এই বার্তা দিয়েছে যে, বৈশ্বিক সহযোগিতা এখন এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রেসিডেন্ট রামাফোসার বক্তব্য স্পষ্ট ছিল: বহুপাক্ষিকতা বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সর্বোত্তম উপায়। দেশগুলো যদি পারস্পরিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত না করে, তবে গভীরতর বিভাজনের ঝুঁকি থেকে যাবে এবং বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা আরও দুর্বল হবে।

একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়তে বিশ্ব নেতাদের মতপার্থক্য ভুলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে একক প্রচেষ্টার চেয়ে সম্মিলিত উদ্যোগই বেশি কার্যকর — এই বার্তাই জি২০ সম্মেলনের পরিসরের বাইরে গিয়েও প্রতিধ্বনিত হয়।

বাংলাদেশ সময়: ২০৪১ ঘণ্টা, মার্চ ০৪, ২০২৫
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।