একটি জাতি কাঁদছে। কিন্তু সেই কান্নার আওয়াজ শুনতে পায় না বিশ্ব।
একটি জাতি রক্তাক্ত। কিন্তু সেই রক্তের রঙ বিশ্ব মানে না, কারণ তা ‘ভুল মানুষের’ শরীরে ঝরে।
একটি জাতি তার মৃতদের দাফন করে— শুধু কবর দেয় না, প্রমাণ করতে হয়—তারা মানুষ ছিল।
গত ২৩ মার্চ। গাজার রাফাহ শহর। পৃথিবীর নৃশংসতম একটি দিন। ইসরায়েলি বাহিনী অ্যাম্বুলেন্স বহরে গুলি চালায়—রেড ক্রিসেন্টের আটজন, সিভিল ডিফেন্সের ছয়জন এবং জাতিসংঘের একজন সহায়তাকর্মীকে হত্যা করে। তারা কেউ বন্দুক হাতে নেয়নি, যুদ্ধ চায়নি। তারা সেই মানুষগুলো, যারা মানুষের প্রাণ রক্ষার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিল। আর তারা দিয়েছিল—নিজেদের প্রাণ।
ইসরায়েল দাবি করে—‘সন্দেহ হয়েছিল’; পশ্চিমা মিডিয়া বলে—‘আইডিএফ বলেছে...’। আর এভাবেই, একেকটা মিথ্যা লাইন দিয়ে ঢেকে ফেলা হয় রক্তের চিহ্ন। একেকটা বাক্য দিয়ে ভেঙে ফেলা হয় ফিলিস্তিনের অস্তিত্ব।
এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটা প্যাটার্ন। এটা এক নৈঃশব্দ্যের আন্তর্জাতিক চুক্তি—যেখানে ফিলিস্তিনিদের মৃত্যু নিয়ে কেউ কাঁদে না, প্রশ্ন করে না, বিচার চায় না।
নিহত চিকিৎসক রিফাত রাদওয়ানের ফোনে থাকা ভিডিও—স্পষ্ট অ্যাম্বুলেন্স চিহ্ন, জ্বলন্ত লাল বাতি, কারও হাতে কোনো অস্ত্র নেই। তারপরও গুলি। তারপরও মৃত্যু। গণকবরে পাওয়া যায় বাঁধা হাত, গুলিবিদ্ধ বুকে পড়ে থাকা লাশ। কেউ তাদের আর জিজ্ঞেস করে না— তুমি কেন মারা গেলে? বরং জিজ্ঞেস করে—তুমি কি দোষী ছিলে?
এটাই ফিলিস্তিনের ইতিহাস। একটা জাতিকে অমানবিক করে তোলার ইতিহাস। এখানে শিশুদের প্রমাণ দিতে হয়—তারা মানব ঢাল নয়। স্কুলকে প্রমাণ দিতে হয়—সে স্কুল। রক্তাক্ত হাসপাতালকেও বলতে হয়— আমি অস্ত্র লুকাইনি, আমি শুধু মানুষ বাঁচাতে চেয়েছিলাম।
আমি গাজায় জন্মেছি, সেখানেই বেড়ে উঠেছি। আমি জানি—রেড ক্রিসেন্টের ভেস্ট মানে কী। সেটা ছিল শেষ আশার প্রতীক—যখন ঘরে খাবার নেই, যখন মাথার ওপর বিমান গর্জে উঠে, তখন কেউ এসে বলে—আমি আছি, আমি বাঁচাতে এসেছি। এবং আমি জানি, সেই আশাকে হত্যা করার মানে কী।
এই চিকিৎসকরা অস্ত্র ছিল না, আশ্রয় ছিলেন। তারা যুদ্ধ করেনি, শান্তি রক্ষার শেষ চেষ্টাটুকু করেছিল। তাদেরও মাথায় গুলি করা হলো। তাদের হাত বেঁধে ফেলা হলো। আর তারপর, তাদের স্মৃতিকেও যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করা হলো। পশ্চিমা মিডিয়া আমাদের জন্য কখনো কাঁদে না। তারা কাঁদে তখন, যখন কাঁদা ‘নিরাপদ’। যখন নিহত ব্যক্তি একজন ইউরোপিয়ান সাংবাদিক, বা একজন ইসরায়েলি। তখন তারা নাম বলে, মুখ দেখায়, স্মরণ করে। আর ফিলিস্তিনি হলে? পরিবারকে আগে প্রমাণ করতে হয়—সে সন্ত্রাসী ছিল না।
আমাদের কান্না বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমাদের শোক ‘অতিরিক্ত আবেগ’ বলে উপেক্ষিত। আমাদের মৃত্যু—'সন্দেহজনক'। আমাদের অস্তিত্ব—'সম্ভাব্য হুমকি'। এভাবে মানবিকতা মরে যায়। এভাবে একটি জাতিকে চুপ করে দেওয়া হয়। এভাবে ইতিহাস লেখা হয় খুনিদের কলমে। ইসরায়েল মানুষ মারে, মিথ্যা বলে, আর পশ্চিমা মিডিয়া তাতে বিশ্বাসও করে।
এই হত্যাকাণ্ড শুধুই একটি হত্যাকাণ্ড নয়—এটা একটা বার্তা। ‘তোমাদের জীবন মূল্যহীন’, ‘তোমাদের শোক ব্যাখ্যা ছাড়া গ্রহণযোগ্য নয়’, ‘তোমরা মানুষ হতে পারো, কিন্তু আমাদের শর্তে’। এই বার্তা আমরা প্রত্যাখ্যান করি।
এই ১৫ জন ফার্স্ট রেসপন্ডার—তারা ছিল আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তারা বিপদের দিকে দৌঁড়ে গিয়েছিল, যেখানে অন্যরা পালিয়ে আসে। তারা বিশ্বাস করেছিল, জীবন এখনও মূল্যবান।
এবং তারাই আমাদের স্মৃতিতে অনন্ত হয়ে থাকুক। তাদের হত্যার বিচার চাই। তাদের শোককে অপমান থেকে মুক্তি চাই। তাদের মানুষ হিসেবে দেখা হোক—এটাই তাদের প্রাপ্য, এটাই আমাদের দাবিও।
ফিলিস্তিনিরা কেবল জীবিত থাকতে চায়—ন্যায়বিচার চায় না, প্রতিশোধও না। শুধু একজন পূর্ণ মানুষ হিসেবে বাঁচতে চায়। কিন্তু সেই স্বীকৃতিটুকুও যদি আমরা না পাই, তবে আমরা কীভাবে বিশ্বকে বিশ্বাস করব? বিশ্বাস ফিরিয়ে দাও। মানবতা ফিরিয়ে দাও। এবং যদি কিছু না দিতে পারো—আমাদের কান্নাটুকু ফিরিয়ে দাও। অন্তত সেটুকু চুপ করে শুনে যাও।
অনুবাদক: মাহমুদুল হাসান ধ্রুব; সিনিয়র নিউজরুম এডিটর। মূল সম্পাদনা: মো. জুবাইর; সিনিয়র নিউজরুম এডিটর, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম।