ঢাকা, শনিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৭ মে ২০২৫, ১৯ জিলকদ ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

কেন তালিবানকে কাছে টানছে ভারত?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২:৫৮, মে ১৭, ২০২৫
কেন তালিবানকে কাছে টানছে ভারত?

তালিবান সবশেষ আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসে ২০২১ সালের আগস্টে। সংগঠনটির ক্ষমতায় আসার পর প্রথমবারের মতো নয়াদিল্লি ও কাবুলের মধ্যে রাজনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগ হয়েছে।

খবর ইন্ডিয়া টুডের।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর আফগানিস্তানের অন্তর্বর্তী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাওলাওয়ি আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে কথা বলেছেন। পহেলগামে সংঘটিত হামলার নিন্দা জানানোয় জয়শঙ্কর তাকে ধন্যবাদ জানান। ওই হামলায় ২৬ জন নিহত হন।

এই কথোপকথনের একদিন পর নয়াদিল্লির কর্মকর্তারা জানান, ভারত আফগানিস্তান নিয়ে সাহসী পদক্ষেপ নেবে এবং ভবিষ্যতে তালিবান-শাসিত রাষ্ট্রটির সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করতে প্রয়োজনীয় সব কিছু করবে। এর অংশ হিসেবে পাকিস্তানের বিতাড়িত করা আফগান শরণার্থীদের জন্য মানবিক সহায়তার বিষয়টি বিবেচনা করছে ভারত।

এক সময় একই সাম্রাজ্যের অংশ ছিল ভারত ও পাকিস্তান। দুই দেশের সম্পর্ক খুব মসৃণ ছিল না। কখনো ছিল বন্ধুর মতো, কখনো দ্বন্দ্বে জর্জরিত। ১৯৯৯ সালে ভারতীয় বিমান অপহরণের ঘটনা দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিবাদ তৈরি করেছিল। তাহলে বড় প্রশ্ন হলো এখন কেন এখন জয়শঙ্কর তালিবানের সঙ্গে কথা বলছেন? এই বড় প্রশ্নের ছোট উত্তর হলো—  শত্রুর শত্রু বন্ধু।

বলা হয়ে থাকে, আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে ঝামেলা বহু আগের। ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারতে এই বিবাদ পরিলক্ষিত হয়। কৌরব ও পাণ্ডবদের শত্রুতার পেছনে গান্ধারার চালাক রাজপুত্র শকুনির বড় ভূমিকা ছিল। শকুনি ছিলেন দারুণ জুয়াড়ি এবং ষড়যন্ত্রকারী।

গান্ধারা এক সময় ভারতের অংশ ছিল। ঐতিহাসিক বিশ্বাস অনুযায়ী, গান্ধারার বর্তমান নাম কান্দাহার, যা আফগানিস্তানের দক্ষিণ অঞ্চলে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। কিছু গবেষক মনে করেন, হেলমান্দ নদীর একটি শাখা আরগান্দাব নদী হয়তো বৈদিক যুগের বিখ্যাত সরস্বতী নদীরই অংশ ছিল। তবে এই ধারণাটি এখনও বিতর্কিত এবং গবেষণার বিষয়।

ইন্দো-আর্যদের অভিবাসন তত্ত্ব অনুযায়ী, গান্ধারা ছিল তাদের যাত্রাপথের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ভাষাবিদরা বলছেন, কাবুল (কুভ) ও বলখ (ভালিকা) নাম দুটি সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে, যা ভারতের  সঙ্গে আফগানিস্তানের প্রাচীন ও গভীর সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। বহু শতাব্দী ধরে, বিশেষ করে মৌর্য সাম্রাজ্যের সময় থেকে আধুনিক আফগানিস্তানের অনেক এলাকা ভারতের অংশ ছিল।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উত্থান-পতনের সম্পর্কের পর ১৮ শতকে দুররানি সাম্রাজ্যের সময়ে ভারত ও আফগানিস্তানের চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর ব্রিটিশরা আফগানিস্তানকে রাশিয়ার সঙ্গে ‘গ্রেট গেম’ নামে পরিচিত বিস্তৃতি ও আধিপত্যের জটিল এক দ্বন্দ্বে বাফার স্টেট হিসেবে ব্যবহার করে।

১৯৭৩ সালে আফগানিস্তান যখন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়, তখনই ভারত দেশটিকে মিত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই ভঙ্গুর শান্তি বজায় থাকে ১৯৯৬ সালে তালিবানের উত্থান পর্যন্ত। আর তখনই আবার আফগানিস্তান ভারতের শত্রুর তালিকায় চলে যায়।  

তালিবান ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধে জয়ী হয়ে শাসনক্ষমতা দখল করে। পাকিস্তান তালিবানকে মদদ দিচ্ছে, এই শঙ্কার সঙ্গে মতাদর্শ দ্বন্দ্বে ভারত তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। এরপর ঘটে কান্দাহার কাণ্ড। ডিসেম্বরে কাঠমান্ডু থেকে উড্ডয়ন করা একটি ভারতীয় বিমান ছিনতাই হয় এবং শেষ পর্যন্ত সেটি আফগানিস্তানের কান্দাহারে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকে।

২০২১ সালে তালিবান আবারও কাবুলের ক্ষমতায় ফিরে আসে। ভারত তখন সরাসরি কোনো অবস্থান না নিয়ে ধীরে চলো নীতিতে চলে। ভারত সম্পর্ক সীমিত পর্যায়ে রাখে।

কয়েক বছর ধরে গুঞ্জন চলছিল ভারতের সঙ্গে তালিবানের গোপন বৈঠক ও পেছনের দরজা দিয়ে আলোচনা নিয়ে। যদিও ভারত বরাবরই তা অস্বীকার করে আসছিল। এসব জল্পনার অবসান ঘটে ২০২৫ সালের ৮ জানুয়ারি। সেদিন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি দুবাইয়ে আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
 
আর এখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সরাসরি তালিবানের সঙ্গে কথা বললেন। এটি কাবুল ও নয়াদিল্লির কূটনীতিতে নতুন এক বাঁকেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

আফগানিস্তানের ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, তারা খুব একটা দীর্ঘস্থায়ীভাবে কারো সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারে না। এক সময় সোভিয়েত-বিরোধী যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ছিল তার মিত্র, পরে সেই যুক্তরাষ্ট্রই হয়ে ওঠে শত্রু। এখন সেই একই কঠিন বাস্তবতা মুখোমুখি পাকিস্তান।

এক সময় যাকে তালিবানের মদদদাতা বলা হতো পাকিস্তানকে। সেই পাকিস্তান এখন কাবুলের সঙ্গে একাধিক ইস্যুতে তীব্র বিরোধে জড়িয়েছে। গত কয়েক বছরে পাকিস্তানে, বিশেষ করে খাইবার পাখতুনখোয়া ও বেলুচিস্তানে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) হামলা বেড়েছে।  

পাকিস্তানের দাবি, টিটিপি যোদ্ধারা আফগান ভূখণ্ড থেকে অভিযান চালিয়ে ফের সেখানেই ফিরে যায়। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে টিটিপির এক হামলার পর পাকিস্তান আফগানিস্তানের পাকতিকা প্রদেশে বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তান তখন বলেছিল, তারা সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি লক্ষ্য করেই হামলা চালিয়েছে। কিন্তু আফগানিস্তান সেই দাবি উড়িয়ে দিয়ে জানায়, এতে বেসামরিকরা হতাহত হয়েছে।  

এ ছাড়া পাকিস্তানের সীমান্তে বেড়া দেওয়ার চেষ্টা এবং ডুরান্ড লাইন বাস্তবায়ন নিয়েও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। ২০২৩ সালে পাকিস্তান নিরাপত্তা ঝুঁকি ও সীমান্ত সমস্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে হাজার হাজার আফগান শরণার্থীকে ফেরত পাঠায়। এতে আফগানিস্তানে ক্ষোভ চরমে পৌঁছায়।

২০২১ সালে তালিবান কাবুলে ফিরে আসার পর পাকিস্তান কিছুটা উচ্ছ্বসিত হয়েছিল বলে ভারত মনে করে। পাকিস্তান ভেবেছিল, এবার ভারতের ওপর চাপ বাড়ানো যাবে। ইমরান খানসহ অনেকে একে ‘সুবর্ণ সুযোগ’ হিসেবে মনে করেছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টেছে। সেই তালিবানই এখন পাকিস্তানের শত্রু হয়ে উঠেছে।

ডুরান্ড সীমান্তের উত্তেজনায় বরফ গলছে দিল্লি ও কাবুলের সম্পর্কে। সেই শীতল সম্পর্ক এখন উষ্ণতা পাচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত ঘনিষ্ঠতার আভাস স্পষ্ট। কারণ, কূটনীতিতে স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু বলে কিছু নেই। আছে শুধু স্থায়ী স্বার্থ, যা পাথরের মতো অটল।

আরএইচ


 

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।