মাত্র এক মাস আগেই সৌদি আরবে একটি বিনিয়োগ সম্মেলনের মঞ্চ থেকে ইরানকে সতর্ক করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তখন অনেকেই এই হুঁশিয়ারিকে পাত্তা না দিলেও এখন তা প্রায় ভবিষ্যদ্বাণীর মতোই প্রতীয়মান হচ্ছে।
ওই সম্মেলনে ট্রাম্প বলেছিলেন, আমরা কখনোই আমেরিকা বা তার মিত্রদের সন্ত্রাসবাদ বা পারমাণবিক হামলার হুমকিতে ফেলতে দেব না। তাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের হাতে সময় কম। সবকিছু দ্রুত বদলে যাচ্ছে।
গত ১৩ মে’র সেই বক্তব্যের সময় হয়তো হোয়াইট হাউজ জানত, ইসরায়েল ইরানে হামলা চালাতে পারে এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টের হয়তো তাতে কিছুই করার থাকবে না। দুই মার্কিন কর্মকর্তার বরাতে এমনটিই জানিয়েছে একাধিক কূটনৈতিক সূত্র।
পর্দার অন্তরালে চলছিল প্রস্তুতি
মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই ইসরায়েলকে সম্ভাব্য সামরিক সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা তৈরি করতে শুরু করে পেন্টাগন। এমনকি ইউক্রেনে পাঠানোর কথা ছিল, এমন কয়েক হাজার প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্রও সরিয়ে নেওয়া হয় মধ্যপ্রাচ্যের দিকে ভবিষ্যৎ সংঘাতের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে।
পেন্টাগন এই বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানালেও একাধিক মার্কিন প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কূটনীতিক ও ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ট্রাম্প প্রশাসন ধীরে ধীরে এক কঠিন সিদ্ধান্তের দিকে এগোচ্ছিল। যেখানে শান্তি প্রচেষ্টা এবং সামরিক হস্তক্ষেপের মধ্যে দোদুল্যমান এক প্রেসিডেন্টের প্রতিচ্ছবি উঠে আসে।
যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে সবসময় ‘শান্তির দূত’ বলে দাবি করে আসছেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তিচুক্তির জন্য স্টিভ উইটকফকে বিশেষ দূত হিসেবে পাঠিয়েছেন। তার আশপাশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক সহযোগীরা বরাবরই চাইছিলেন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েল যেন হামলা চালায়, এবং তাতে যুক্তরাষ্ট্র যেন সমর্থন দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যেও বারবার উঠে এসেছে, ইসরায়েল একতরফা হামলা চালাতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র রাজি হোক বা না হোক। দুই মার্কিন ও এক ইসরায়েলি শীর্ষ সূত্র জানায়, সরাসরি ‘হ্যাঁ’ না বললেও ট্রাম্প অন্তত ‘না’ বলেননি। তার নীরব অবস্থানই ইসরায়েলকে সামনে এগিয়ে যেতে সাহস জুগিয়েছে।
দ্বিধায় ট্রাম্প
ইসরায়েল-ইরান সংঘাত শুরু হওয়ার সাতদিন পর, ট্রাম্পের সামনে এখন তিনটি রাস্তা। ১. আবারও কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া, ২. ইসরায়েল-ইরানকে লড়তে দেওয়া, অথবা ৩. মার্কিন যুদ্ধবিমান দিয়ে ইরানের গোপন পারমাণবিক স্থাপনা ফোর্দো এনরিচমেন্ট প্ল্যান্টে হামলা চালানো।
মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্র উপদেষ্টা অ্যারন ডেভিড মিলার এ ব্যাপারে নিজের মন্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ট্রাম্প ঘটনাগুলো ঘটতে দিয়েছেন। তিনি এখন বাঘের পিঠে উঠে গেছেন। তিনি সেটি নিয়ে চরছেন।
হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে কিনা, সে বিষয়ে ট্রাম্প আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেবেন।
যুদ্ধের সুতো বোনা দীর্ঘদিন ধরেই
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ যে সম্ভাব্য, সেটি টের পাওয়া যায় গত এপ্রিল মাসেই। সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী যুবরাজ খালিদ বিন সালমান আল সৌদ এক গোপন বৈঠকে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের উদ্দেশে বলেন, ট্রাম্পের দেওয়া কূটনৈতিক প্রস্তাব গ্রহণ না করলে যুদ্ধ এড়ানো কঠিন হবে।
ইসরায়েলি ও মার্কিন সেনা কর্মকর্তারা ওই সময় ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র মজুদ ও পারমাণবিক কার্যক্রম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল কীভাবে আত্মরক্ষা করতে পারে, সেটি নিয়েও পরিকল্পনা তৈরি হতে থাকে। এক পর্যায়ে ইউক্রেনে পাঠানোর কথা ছিল এমন অস্ত্রশস্ত্র সরিয়ে নেওয়া হয় ইসরায়েলের জন্য। কিয়েভ এতে ক্ষুব্ধ হয় এবং জানায়, মস্কোর বিপক্ষে যুদ্ধ চালাতে আরও অস্ত্র প্রয়োজন, যা অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্ত
গত ৯ জুন, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে ট্রাম্প ফোনে কথা বলেন। তখনও ট্রাম্পের অবস্থান স্পষ্ট ছিল না। সূত্রগুলো বলছে, তিনি সরাসরি হামলার বিরুদ্ধে অবস্থান নেননি। গত ১১ জুন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত হয়ে যায়, ইসরায়েলের হামলা অবশ্যম্ভাবী। পরদিন, ১২ জুন যুক্তরাষ্ট্র কয়েকটি মিত্র দেশকে জানিয়ে দেয়, ইসরায়েল ইরানে হামলা চালাতে যাচ্ছে। সেই রাতেই শুরু হয় ইসরায়েলের বিমান হামলা। যা দ্রুতই রূপ নেয় পূর্ণাঙ্গ আকাশযুদ্ধে।
হোয়াইট হাউজের সিচুয়েশন রুমে বসে ট্রাম্প ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা হামলার দৃশ্য সরাসরি প্রত্যক্ষ করেন। পাশে বসে থাকা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সেদিন তাদের ডিনারে ছিল স্থানীয় এক রেস্তোরাঁর স্টোন ক্র্যাব। হামলায় ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির কয়েকজন ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা নিহত হন, এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তবে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার মতে, এই হামলা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে মাত্র কয়েক মাস পিছিয়ে দিতে পেরেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতায় গুরুতর আঘাত হানতে হলে ফোদো ফুয়েল এনরিচমেন্ট প্ল্যান্টে বাংকারবাস্টিং বোমা ফেলতে হবে। এ সক্ষমতা কেবল যুক্তরাষ্ট্রেরই রয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি এমন একটি হামলার বিষয় বিবেচনা করছেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হবে একটি বড় ধরনের সামরিক অভিযানের সূচনা। এবং এতে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের মাত্রা নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে।
রয়টার্স অবলম্বনে
এমজে