২০০৮ সালে প্রথম বার যখন নির্বাচিত হন তখন তার সেকি জনপ্রিয়তা। যুক্তরাষ্ট্রকে একটি মানবিক মুখ দেওয়ার প্রত্যয়ে তার যাত্রা শুরু।

কিন্তু তারপর? তারপর সেই অভিশপ্ত দ্বিতীয় দফা। এ যেনো এক অমোঘ বিধান। দ্বিতীয় দফা মানেই হৃত গৌরব হারিয়ে এমন কোথাও পৌঁছে যাওয়া যেখানে সমালোচনা আর অবজ্ঞাই হয়ে ওঠে এই দেশটির প্রেসিডেন্টদের ভাগ্য। যার শেকড় আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসের গভীরেই প্রোথিত। ইতিহাসবেত্তা ও রাজনীতির প্রভাষকরা যাকে ‘অভিশপ্ত দ্বিতীয়-দফা’ নাম দিয়েছেন।
 
বারাক ওবামার দ্বিতীয় দফার মন্দা দশা শুরু হয় এই দফার প্রথম দুটি বছর পার করেই।
তখন থেকেই তিনি ডুবতে থাকেন একের পর এক ব্যর্থতায়। বড় ব্যর্থতা ছিলো অর্থনীতির। যার ফলে মধ্যবর্তী নির্বাচনেই আসে ভরাডুবি। সেবার ভোটের ঠিক আগে আগে আইএমএফ যখন ঘোষণা দেয় অর্থনৈতিক শক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র আর সেরা নয়, তালিকার শীর্ষে চীনের নাম, তখন দোষ ওবামার ঘাড়েই চাপে। ভোটেও তার প্রতিফলন ঘটে। আর এর বাইরেও ড্রিম অ্যাক্টের কথা বলে অভিবাসীদের স্বপ্ন দেখাতে দেখাতে এক পর্যায়ে তা দুঃস্বপ্নেও পরিণত হয়।
 
এর পরের সময়টিও ভালো যায়নি। কাজে দেয়নি ওবামা কেয়ার, স্কুল ফিডিংয়ের মতো ভালো ভালো পরিকল্পনাগুলোও। ২০১২ নির্বাচনে জিতলেও কংগ্রেস ছিলো রিপাবলিকানদের হাতে। ফলে সম্ভব হয়নি অনেক পরিকল্পনারই বাস্তবায়ন।
 
বলা হচ্ছে, বা অনেকাংশেই সত্য বারাক ওবামার কোনো ভালো উদ্যোগেই সহায়তা করেনি রিপাবলিকান অধ্যুসিত কংগ্রেস। ফলে তাকে ব্যর্থই হতে হয়েছে। কিন্তু সেসব কথা এখন বড় হয়ে দেখা দেবে না। ব্যর্থতার দায় ওবামাকেই নিতে হবে।
 
এখন ক্ষমতার কিংবা দায়িত্বের শেষ ভাগে এসে বলা হচ্ছে- পররাষ্ট্র নীতিরি নীরিখে ওবামা ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নিকৃষ্টতম প্রেসিডেন্ট। বাইরে এই অবস্থা। ঘরেও কি তিনি ছিলেন ভালো কোনও প্রেসিডেন্ট। মিডিয়াগুলো চিহ্নিত করেছে তার ব্যর্থতার দিকগুলো।
বলা হচ্ছে- ওবামার সময়কালে জাতীয় ঋণের পরিমান প্রায় দ্বিগুন হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে পরমানু বোমার বোতলের দৈত্যকে বের করে মধ্য প্রাচ্যে ছেড়ে দিয়েছেন তিনিই। অবৈধ অভিবাসন সঙ্কট জোরদার হয়েছে তারই হাতে, জাতিগত মেরুকরণ তার কারণেই হয়েছে,ইরাকে একটি যুদ্ধজয় ওবামার কারণেই হাতছাড়া হয়েছে।
 
এসব মিলিয়ে প্রথম দফায় তিনি যতটাই সফল, দ্বিতীয় দফায় ঠিক ততটাই, কিংবা তারও চেয়ে বেশি ব্যর্থ। কারণ এ যে তার অভিশপ্ত দ্বিতীয় দফা। ঠিক যেমনটা ঘটেছে তার পূর্বসূরিদের অনেকের ক্ষেত্রেই।
 
আগেই বলেছি এই অভিশপ্ত দ্বিতীয় দফার শেকড় আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসের গভীরেই প্রোথিত।
 
আবহমানকালের মার্কিন ইতিহাস বলে দ্বিতীয় দফার প্রশাসন প্রথম দফার চেয়ে কম সফল। অন্তত অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে এই সত্যের ব্যতয় কমই ঘটেছে।
 
ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট তার হাতের মুঠোয় ধরে রাখা কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ হারান ১৯৩৭-এ সুপ্রিমকোর্টকে স্বীকৃতিদানের পরিকল্পনা হাতে নিয়ে। কংগ্রেসে ওই বিল পাঠানোর পর তাকে ‘সুপ্রিমকোর্ট প্যাকিং পলিসি’নাম দিতে রাজনৈতিক সমালোচকরা মোটেই সময় নেন নি। আর রোনাল্ড রিগ্যান ১৯৮৬ সালে ডুবেছিলেন ইরান-কন্ট্রা কেলেঙ্কারিতে।
 
১৯৭৪ সালে রিচার্ড নিক্সন করুণ পরিনতি এড়াতে (অনেক জল ঘোলা করেও অবশেষে সুবিধা করতে না পেরে) পদত্যাগকেই সেরা বিকল্প হিসেবে দেখেছিলেন। আর বিল ক্লিনটনের মনিকা লিউইনস্কি কেলেঙ্কারি ও শেষ পর্যন্ত ১৯৯৮ সালে অভিশংসন---এসব তো ভুলে যাওয়ার কথা নয়।
 
এগুলো তো গুটিকয় তরতাজা ঘটনা। কিন্তু সেই গোড়ার ইতিহাস ঘাঁটলেও দেখা যাবে দ্বিতীয় দফাটি সুখকর ছিলো না যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের কাছে। এমনকি দেশটির প্রধানতম পূর্বপিতা জর্জ ওয়াশিংনটকেও তার ফিলাডেলফিয়ার বাড়িতে ক্রদ্ধ ও ক্ষুব্ধ জনতা ঘিরে রেখেছিলো ব্রিটেনের সঙ্গে তার ‘জে ট্রিটি’ গ্রহণের পর তার বিরোধিতায়।
১৭৭৫ থেকে ১৭৮৭ পর্যন্ত আমেরিকান বিপ্লবের পর জনগণ চেয়েছিলো প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিটেনকে নয়, ফ্রান্সকেই সমর্থন দেবেন।
 
ব্রুকিং ইনস্টিটিউটের পণ্ডিত এবং আইজেনহাওয়ার, নিক্সন, ফোর্ড ও কার্টার প্রশাসনের এক অন্যতম সাবেক কর্মকর্তা স্টিফেন হেস এই অভিশপ্ত দ্বিতীয়-দফার ওপর কিছু বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন।
 
এক, প্রেসিডেন্টরা প্রথম দফায়ই তাদের সেরা পরিকল্পনাগুলো কাজে খাটানোর চেষ্টায় থাকেন। খুব কমই তারা একটি অনিশ্চিত দ্বিতীয়-দফার জন্য তুলে রাখেন। আর যখন দ্বিতীয়-দফায় প্রবেশ করেন তখন নতুন একটি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু করেন।
 
দুই, প্রেসিডেন্টরা প্রথম দফায়ই হোয়াইট হাউজে ঢুকে তাদের প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বেছে নেন, যাদের মধ্যে অনেক উৎসাহ উদ্দীপনাওথাকে। কিন্তু দ্বিতীয়-দফায় এদের অনেকেই আর সেই অবস্থায় থাকেন না।
 
প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টই সম্ভবত সবচেয়ে অভিশপ্ত দ্বিতীয়-দফা কাটিয়েছিলেন। তার জীবনীকার জিন এডওয়ার্ড একে ‘বিপর্যয়’ বলেই উল্লেখ করেছিলেন। ১৯৩৬ সালে রুজভেল্টের সবচেযে কাছের উপদেষ্টা লুইস হোইয়ের মৃত্যুর পর বছর কয়েক তার আশেপাশে আর কেউই ছিলেন না--- এই কথাটুকু বলতে যে, তার সুপ্রিম কোর্ট প্যাকিং আইডিয়াটি কতটা খারাপ ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এই ঘটনার পর তার দল দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। রক্ষণশীল ডেমোক্র্যাটরা তাকে বর্জন করেই ক্ষান্ত হননি রিপাবলিকানদের সঙ্গে সখ্য পেতে তারা রুজভেল্টের করা প্রায় সবক’টি অভ্যন্তরীণ আইনের বিরোধিতা করেছিলেন।
 
রুজভেল্টের এই সিদ্ধান্তকে ‘নিজের পায়েই গুলি চালানোর সামিল’ বলে মত দিয়েছিলেন মি. স্মিথ। রুজভেল্ট কিন্তু সেখানেই ক্ষান্ত হননি। এরপর তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় কমাতে নিলেন বেশ কিছু পরিকল্পনা যার অনিবার্য ফল হয়ে দাঁড়ালো গভীর অর্থনৈতিক মন্দা। ওই সিদ্ধান্তের পর মি. স্মিথ লিখেছিলেন ‘রুজভেল্ট এবার জাতির পায়ে গুলি চালিয়েছেন। ’ নির্বাচনে বড় ধরনের জয় নিয়ে দ্বিতীয় দফায় প্রশাসন চালাতে এসে মার্কিন প্রেসিডেন্টরা প্রথমেই যে ভুলটি করেন তা হচ্ছে তারা ভেবে বসেন, ‘দেশ ভাবছে তিনি কোনো ভুলই করতে পারেন না। ’
 
প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের জীবনচরিত রচয়িতা ও ওয়াশিংটন পোস্টের হোয়াইট হাউজ রিপোর্টার লুই ক্যানোন তার এক পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘বড় জয় বিজেতার জন্য ভয়ঙ্কর’। ১৯৩৬ সালের নির্বাচনে রুজভেল্ট মাত্র দুটি অঙ্গরাজ্যে হেরেছিলেন, ১৯৭২ সালে নিক্সন হেরেছিলেন কেবলই ম্যাসাচুসেটসে ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ায়। ১৯৮৪ সালে রিগ্যান মাত্র একটি অঙ্গরাজ্যে হেরেছিলেন। এর পরের দুটি বছর ১৯৮৫-৮৬ ছিলো প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ১৬ বছরের প্রশাসনের সবচেয়ে অসফল সময়, এমনটাই মত লুউ ক্যানোনের।
 
কেবল যে বড় জয় তাই নয়, সামান্য ব্যবধানে জয় নিয়েও বড় হম্বিতম্বি কিংবা প্রয়োজনের চেয়ে বেশিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হতে দেখা গেছে মার্কিন প্রেসিডেন্টদের। জর্জ ডব্লিউ বুশ ২০০৪ সালে তার দ্বিতীয় দফায় মাত্র ৫০.৭ শতাংশ ভোট নিয়ে প্রশাসনে অধীষ্ট হন। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর এই বিজয়কে তিনি জনগণের একটি বিশাল ম্যান্ডেড হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করলেন এবং ২০০৫ সালেই সামাজিক নিরাপত্তাকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়ে কড়া সমালোচনায় পড়েন। ডেমোক্র্যাটদের সমন্বিত প্রতিরোধের মুখে তা থেমে যায়। দ্বিতীয় দফায় কাজ চলে গজ গতিতে।
 
এর পরে তো আর কিছু নেই তাই যেসব মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয় তা সেগুলো উত্তরাধিকারের হাতে শপে দেওয়ারই একটা মানসিকতা কাজ করে। হতে পারে সে উত্তরাধিকার নিজ দলের কিংবা বিরোধী পক্ষের। জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্সিয়াল পণ্ডিত রিচার্ড নরটন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের উদাহরণ টেনে বলেছেন, তার দ্বিতীয় প্রশাসনে নতুন আইডিয়ার অভাব ছিলো প্রকট। কেবিনেটের গুরুত্বপূর্ণ অফিসাররা দ্রুতই তাকে ছেড়ে চলে যান। চিফ-অব-স্টাফ শেরমান অ্যাডামসও বেশি দিন থাকেন নি। আর ১৯৬০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের আকাশ থেকে যখন একটি মার্কিন ইউ-টু গোয়েন্দা বিমান গুলি করে নামানো হয় আর তার জেরে দুর্মুখ আর চরম বদরাগী বলে পরিচিত সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ প্যারিস সামিট ভণ্ডুল করে দেন। তখন বেশ বেকায়দায়ই পড়তে হয় মার্কিন প্রেসিডেন্টকে।
 
আসা যাক প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের কথায়। কয়েক দশকের মধ্যে প্রথম একটি ভারসাম্যের বাজেট তিনি দিয়েছিলেন ১৯৯৭ সালে। এছাড়াও ন্যাটোর সেনা না পাঠিয়েই ক্লিনটন কসভোয় সার্বদের মুসলিম নিধনযজ্ঞ বন্ধে সফল হয়ে (ডেটন চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে) আন্তর্জাতিক প্রশংসাও কুড়িয়েছেন। কিন্তু তারপরেও তাকে অভিংশনের মুখে পড়তে হয়েছিলো। যেটি ছিলো একটি অভিশপ্ত সময়।
 
প্রেসিডেন্ট বুশ অনেক লক্ষ্য পূরণেই ব্যর্থ হয়েছিলেন। যার মধ্যে অভিবাসন প্রক্রিয়া উদারিকরণ, ট্যাক্স কোড সংস্কার অন্যতম। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে প্রেসিডেন্টরা তাদের দ্বিতীয় দফায় প্রশাসনের সবকিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন না।
 
বারাক ওবামার দ্বিতীয় দফা সম্পর্কে ন্যাশনাল রিভিউতে প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়েছে এভাবে: ওবামার দ্বিতীয় দফা ছিলো পুরোই ব্যর্থ- এর বাইরে আর কিছু বলার নেই। ওয়াশিংটন পোস্টের ক্রিস সিলিজা বছরের সবচেয়ে বড় ব্যর্থ রাজনীতিক খুঁজতে গিয়ে এবারও বারাক ওবামাকেই খুঁজে পেয়েছেন।

বাংলাদেশ সময়: ২৩৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৭, ২০১৬
এমএমকে