প্রকাশ্যে পাওয়া বিভিন্ন নথিপত্র, বিদেশে বসবাসরত বা আশ্রিত কয়েকডজন উইগুর পরিবারের সাক্ষাৎকারসহ অনেক পোক্ত তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম বিবিসি। যদিও বরাবরই এ ধরনের অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়ে আসছে বেইজিং।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, প্রাপ্ত রেকর্ড অনুসারে ঝিনজিয়াংয়ের একটি শহরেই কেবল ৪০ জন শিশু তার মা-বাবাকে ‘হারিয়েছে’। ‘মা-বাবা হারানো’ এই শিশুরা হয়তো কোনো ক্যাম্প, নয়তো কোনো বন্দিশালায় রয়েছে। যদিও সরকার এসব ক্যাম্পকে প্রচার করে আসছে ‘আবাসিক স্কুল’ হিসেবে। কেবল তাই নয়, হাজারো প্রাপ্তবয়স্ক উইগুর বন্দি রয়েছে বড় বড় ক্যাম্পে। বিশেষ উদ্দেশে বড় ধরনের ‘আবাসিক স্কুল’ বানানোর কার্যক্রমও চলছে দ্রুত। তথ্য-উপাত্ত বলছে, ঝিনজিয়াংয়ের প্রাপ্তবয়স্কদের ‘পরিচয় বদল ফেলা’র পাশাপাশি সমানভাবে চলছে শিশুদের শেকড়-বিচ্ছিন্ন করার পদ্ধতিগত কর্মকাণ্ড। বিবিসি বলছে, দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পর ঝিনজিয়াংয়ে কোনো সাংবাদিক গেলেও তার পেছনে ২৪ ঘণ্টা নজরদারির জন্য গোয়েন্দা লাগিয়ে দেয় সরকার। সেজন্য প্রয়োজনীয় উপাত্ত সেখান থেকে পাওয়া অসম্ভব। তবে কিছু তথ্য-উপাত্ত ও সাক্ষাৎকার মেলে তুরস্কে আশ্রিত বা বসবাসরত উইগুর পরিবারগুলোতে।
ইস্তাম্বুলের একটি বিশাল মিলনায়তনে নিজেদের ওপর দমন-পীড়নের কাহিনি বিবিসির কাছে তুলে ধরেন উইগুর সম্প্রদায়ের কয়েক ডজন লোক। এসময় তাদের হাতে ছিল জিনজিয়াংয়ে ‘নিখোঁজ হয়ে যাওয়া’ শিশুদের ছবি।
এক মা তার তিন কন্যার ছবি দেখিয়ে কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, ‘আমি জানি না, আমার সন্তান কাদের কাছে আছে, কে তাদের দেখছে। কোনো খোঁজখবর জানি না। ’
আরেক মা তার তিন পুত্র ও এক কন্যার ছবি হাতে নিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন, ‘শুনেছি তাদের নাকি কোন অনাথাশ্রমে নিয়ে গেছে। তারা কেমন আছে, কিছুই জানি না। ’
এভাবে প্রায় ৬০ জন তাদের শতাধিক শিশু নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার তথ্য দেন সেখানে।
যদিও এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে চীন সরকার বরাবরই বলে আসছে, ‘সহিংস ধর্মীয় উগ্রবাদ’ মোকাবিলায় উইগুরদের ‘কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে’ শিক্ষিত করে গড়ে তোলা হচ্ছে। কিন্তু তথ্য-উপাত্ত বলছে, এদের বেশিরভাগকেই আটকে রাখা হয়েছে কেবল নিজেদের বিশ্বাস বা প্রার্থনার কারণে, অথবা পর্দা করার কারণে অথবা তুরস্ক বা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে ‘যোগাযোগ’ রাখার কারণে। ভাষা-বিশ্বাস এবং সাংস্কৃতিক কারণে উইগুর সম্প্রদায়ের লোকজনের তুরস্কে যাতায়াত ও যোগাযোগ বেশি। তাছাড়া সম্প্রদায়টির অনেকে পড়াশোনার জন্যও ইউরোপ-এশিয়ার সংযোগস্থল দেশটিতে যায়। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তুরস্কে অবস্থানরত উইগুররা বলছেন, ঝিনজিয়াংয়ে ফেরত যাওয়া মানে অনেকটা বন্দিশালায় ঢোকা। তুরস্ক থেকে ঝিনজিয়াংয়ে থাকা স্বজনদের সঙ্গে কথাও বলা যায় না, কারণ আড়ি পেতে ওই স্বজনদের চিহ্নিত করা হয়।
জার্মানির গবেষক ড. আদ্রিয়ান জেনজের সহযোগিতায় তৈরি এ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঝিনজিয়াংয়ে ‘স্কুল’ বেড়ে যাওয়ার হার নজিরবিহীন। যেমন ২০১৭ সালে ঝিনজিয়াংয়ের ‘কিন্ডারগার্টেনগুলোতে’ শিশু ভর্তির হার বেড়েছে ৫ লাখেরও বেশি।
সরকারি হিসাব মতে, ভর্তির হার ৯০ শতাংশই বেড়েছে উইগুরসহ অন্য মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিশুর। সেজন্য গোটা চীনের স্কুলগুলোতে শিশু ভর্তির হারের চেয়ে অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে ঝিনজিয়াংয়ে।
উইগুর শিশুদের জোর করে ‘আবাসিক স্কুলে’ ভর্তির কথা তুলে ধরে প্রতিবেদন বলছে, গত বছরের এপ্রিলে ঝিনজিয়াংয়ের একটি কাউন্টির কয়েকটি গ্রাম থেকে প্রায় ২ হাজার শিশুকে আরেকটি কাউন্টির আবাসিক স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যদিও সরকারের প্রচারণা দফতর বলছে, আবাসিক স্কুলগুলোর বৈশিষ্ট্য ‘সামাজিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি’ ধরে রাখার জন্য সহায়ক এবং এসব স্কুল মা-বাবার মতোই দেখাশোনা করছে শিশুদের। কিন্তু গবেষক ড. জেনজ বলছেন, ‘এই কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য অনেক গভীর। ’ তার মতে, ‘সংখ্যালঘু সমাজের সংস্কৃতি-বিশ্বাস বদলে দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি নতুন রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে আবাসিক স্কুল আদর্শ উপায়। ’
প্রতিবেদন বলছে, উইগুর অধ্যুষিত অঞ্চলে এখন সেখানকার জনগোষ্ঠীর বা স্থানীয় ভাষা বর্জনে বাধ্য করা হচ্ছে। কেউ যদি স্কুলে চীনা ভাষার বদলে অন্য ভাষায় কথা বলে, তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়কেই শাস্তির মুখে পড়তে হচ্ছে। আর এর পক্ষে সম্প্রতি সরকারি বিবৃতিগুলোর তথ্য মিলে যায়, যেখানে বলা হয়েছে- সব স্কুলে চাইনিজ ভাষায় শিক্ষা দেওয়ার লক্ষ্য সর্বাগ্রে অর্জন করেছে ঝিনজিয়াং।
সার্বিক বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ঝিনজিয়াংয়ের প্রচারণা বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ঝু গুঝিয়াং মা-বাবা ছাড়া বিপুলসংখ্যক শিশুকে ‘দেখভাল করার’ অভিযোগ হেসে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, বলেন, ‘যদি কোনো পরিবারের সব সদস্যই কারিগরি প্রশিক্ষণের জন্য চলে আসে, তাহলেতো ওই পরিবারই বিপদে পড়ে যাবে। আমি এমন কোনো ঘটনা দেখিনি। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫১ ঘণ্টা, জুলাই ০৬, ২০১৯
এইচএ/