বিশ্লেষকদের অনেকেই অভিযোগের আঙুল তুলছেন ট্রাম্পের দিকে; বলছেন, অভিশংসন থেকে সবার মনোযোগ সরিয়ে দেওয়ার জন্যেই এ কাজ করেছেন ট্রাম্প। ইরানের মতো শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে চাইলেই মার্কিন সেনাবাহিনী ব্যবহার করার সাহস রয়েছে তার, এমন একটি বার্তা দিলেন যেন।
বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) দিনগত রাতে হত্যা করা হয় সোলেমানিকে। তিনি এমন এক ব্যক্তি, যিনি যুক্তরাষ্ট্র ও এর মধ্যপ্রাচ্যের মিত্রদেশগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন হামলার পেছনে রয়েছেন। শুধু ট্রাম্প নয়, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টদের অনেকেই তাদের সময়ে সোলেমানি ও ইরাকের ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি জানালেও পররাষ্ট্রনীতির কারণে সেটি বাস্তবে রূপ দেননি।
পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ সোলেমানিকে হত্যা করা হয়। এর পেছনে রয়েছে তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যকার দীর্ঘদিনের উত্তপ্ত পরিস্থিতি। মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) ইরান-সমর্থিত ইরাকি মিলিশিয়া বাহিনীর সমর্থকরা হামলা চালিয়েছে বাগদাদে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসে। এ হামলার কারণ ছিল গত রোববার (২৯ ডিসেম্বর) ইরান সমর্থিত ইরাকি মিলিশিয়া ‘কাতাইব হিজবুল্লাহ’র ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালায় মার্কিন সেনারা। এতে অন্তত ২৫ যোদ্ধা নিহত ও ৫৫ জন আহত হয়। রোববারের হামলার কারণ ছিল, এর আগে ওই মিলিশিয়া বাহিনী একটি সামরিক ঘাঁটির ওপর রকেট হামলা চালিয়ে একজন আমেরিকান ঠিকাদারকে হত্যা ও এক মার্কিন সেনাকে আহত করে।
এসব হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনায় বহুবার ইরানকে সতর্ক করেছেন ট্রাম্প। মার্কিন দূতাবাসে হামলার জন্য ইরানকে দায়ী করে এক টুইটে ট্রাম্প বলেন, সব প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির সম্পূর্ণ দায় নিতে হবে ইরানকে। এর জন্য তাদের ‘বড় মাসুল’ দিতে হবে। এটা কোনো সতর্কবার্তা নয়, এটা হুমকি। সোলেমানিকে হত্যার মাধ্যমে ট্রাম্প একটি পরিষ্কার বার্তা দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন এই হুমকি কতখানি সত্যি ছিল।
সোলেমানি হত্যাকাণ্ডে ইরানের শীর্ষ নেতারা ক্ষুব্দ হলেও, তারা বোধবুদ্ধিহীন নন। তাই সামরিক ‘সুপারপাওয়ার’ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ এ যাত্রায় এড়িয়ে যেতে পারে ইরান। যদি যুদ্ধ না-ই বাঁধে তাহলে কি শঙ্কার কিছু আছে?
প্রথমত, সোলেমানি হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে চেষ্টা করবে ইরান। কারণ তিনি সরাসরি জবাব দিতেন ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির কাছে। ইরাকে সংঘটিত হলেও, এ হত্যাকাণ্ড ইরানের ঠিক প্রাণকেন্দ্রে আঘাত করেছে। প্রতিশোধ হিসেবে পারস্য উপসাগরে চলমান মার্কিন জাহাজগুলোর ওপর হামলা চালাতে পারে দেশটি। জবাবে অবশ্য পাল্টা হামলার শিকার হবে ইরান। তাই কোনো পক্ষই যুদ্ধ না চাইলেও পরিবেশ উত্তপ্ত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন বর্তমানে ইরাক একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তাদের সঙ্গে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক রয়েছে ইরান সরকারের। ইরানের অর্থ ও সামরিক সহায়তা দরকার ইরাকের। পশ্চিমা শক্তির বিস্তার মধ্যপ্রাচ্যে একসময় যদি না থাকে, তবুও ইরাকের প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে সব সময় থাকবে ইরান। ফলে, এ পরিস্থিতিতে নিজেদের দেশ থেকে মার্কিন সেনাদের সরাতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ দেবে ইরাক।
এর আগেই ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন সেনাদের সরিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন এবং সে অনুযায়ী গত অক্টোবরে সিরিয়া থেকে সরিয়ে নিয়েছেন বহু সেনা। তবে দূতাবাসে হামলার ঘটনার পর মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে আরও সেনা মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। ধারণা করা হচ্ছে, চাপ প্রয়োগ করলে তিনি ইরাক থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নিতে চাইবেন না।
অপরদিকে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এক বিবৃতিতে বলেছেন, সোলেমানি হত্যাকাণ্ড ওই অঞ্চলের পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে পারে। এতে একমত প্রকাশ করেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র সৌদি আরবও নতুন করে ভাবতে বাধ্য হবে ট্রাম্পের ওপর আর ভরসা করা যায় কি-না। কারণ নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ইরানি হামলা থেকে বাঁচতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে সৌদি সরকার।
ইরাকে ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়া বাহিনীর ওপর প্রভাব ছিল সোলেমানির। ধারণা করা হয়, অসংখ্য হামলার পেছনে তার হাত ছিল। তাই সোলেমানি হত্যাকাণ্ডে বিক্ষুব্ধ মিলিশিয়া বাহিনীর বিভিন্ন সদস্য স্বপ্রণোদিত হয়ে মার্কিন সেনাদের ওপর হামলা করে বসতে পারে।
অন্যদিকে, এবছর অনুষ্ঠিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগ্য প্রমাণ করতে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন ট্রাম্প। এমন সময় আমেরিকানদের ওপর ইরানের হামলা, মার্কিন সেনাদের সরাতে ইরাকের চাপ, ইউরোপ ও ডেমোক্র্যাটদের সমালোচনার মুখে কী প্রতিক্রিয়া দেখাবেন ট্রাম্প, সেসবের ওপরই নির্ভর করছে ঘটনা কোন দিকে মোড় নেবে।
কেউই যুদ্ধ চায় না, কিন্তু পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে থাকলে ঠাণ্ডা মাথারই জয় হবে, এমন নিশ্চয়তা নেই।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৪, ২০২০
এফএম