ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

প্রবল কর্তৃত্ববাদী শি’র অধীনে চীন যেন উত্তর কোরিয়া!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২, ২০২০
প্রবল কর্তৃত্ববাদী শি’র অধীনে চীন যেন উত্তর কোরিয়া! শি জিনপিংয়ের প্রতিকৃতি নিয়ে শোভাযাত্রা/ ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বে উত্তর কোরিয়া এমন একটি দেশ যেখানে কিম জং উন হলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এ শাসকের কথার বাইরে দেশটিতে কিছু হবে এমনটা ভাবাও যায় না।

দেশটিতে মানবাধিকার হরণ, দমন-পীড়নের ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়! আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনা সবসময় উপেক্ষা করেই নিজের কাজ করেন কিম। সাম্প্রতিক সময়ে চীনের পরিস্থিতিও কিন্তু প্রায় একই। প্রবল কর্তৃত্ববাদী চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তবে কি কিমের পথেই হাঁটছেন? কারণ যেভাবে দেশটিতে উত্তর কোরিয়ার মতো দমন-পীড়নের ঘটনা ঘটছে তাতে এমন ধারণা করাটা বোধহয় খুব বেশি ভুল হবে না।

শিনজিয়াংয়ে রিপোর্টিংয়ের কাজে যাওয়ার পর নিউইয়র্ক পোস্টের সাবেক ব্যুরো প্রধান অ্যানা ফিফিল্ড এমনই কিছু অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। তার সেই অভিজ্ঞতা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

প্লেন থেকে নামার পর যাত্রীদের শরীরের তাপমাত্রা মাপতে চীনের শিনজিয়াং প্রদেশের বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বেইজিং থেকে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে তিন বিদেশি সাংবাদিক সেখানে যান। তাদের কাছে চাওয়া হয় পাসপোর্ট। এসময় তাদের একদিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়।

কেন টেনে নেওয়া হচ্ছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তরে তাদের বলা হয়, আমাদের মাস্ক পরা জানা দরকার। কেননা জুলাই মাসে শিনজিয়াংয়ে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছিল। যদিও আমাদের মুখে মাস্ক ছিল। পরে তারা আমাদের পাসপোর্টের ইনফরমেশন পেজ এবং সাংবাদিক ভিসার ছবি তুলে রাখে।

যে গাড়িগুলো অনুসরণ করেছিল

প্রতিবেদন তৈরিতে বাধা দেওয়া, আমাদের সঙ্গে যেন কথা বলতে স্থানীয়রা ভয় পায় তা নিশ্চিত করার জন্য চারদিন ধরে তীব্র নজরদারি এবং চেকপয়েন্টগুলোর উপদ্রবের শুরু ছিল এ ঘটনা।

‘হোন্ডা-২৫’ ও ‘ভিডব্লিউ-৩৫’ নম্বর প্লেটের গাড়িগুলো আমাদের সবসময় অনুসরণ করেছে।

পাবলিক সিকিউরিটি ব্যুরোর দুই অফিসার মাইকেল এবং স্মিথ হোটেলের লবিতে বারবার বুঝিয়ে দিয়েছেন, রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে যেন আমরা স্থানীয় নীতি অনুসরণ করি।

এমন নজরদারির কারণে শিনজিয়াংয়ের কাশগরের এ ট্রিপ আমাকে চীন নয় বারবার উত্তর কোরিয়ার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল।

উইগুর সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর এবং সিল্ক রোডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র কাশগর পিয়ংইয়ংয়ের মতো ‘পটেমকিন ভিলেজে’ রূপ নিয়েছে।

আমি ২০০৬ সালে কিরগিজস্তানের সীমান্ত দিয়ে কাশগরে প্রথমবারের মতো এসেছিলাম একজন পর্যটক হিসেবে। আমার এখনো মনে পড়ছে, সেই কাশগর ছিল এমন এক জাদুকরী জায়গা যেখানে সেন্ট্রাল এশিয়ানদের মতো দেখতে উইগুরদের বাস এবং তারা কথা বলেন আরবি হরফে লেখা তুর্কি ভাষায়। সেখানকার তাজা ডুমুর, ধোঁয়া উড়া কাবাব এবং হৈচৈপূর্ণ রোববারের পশুর বাজার ছিল বিস্ময়কর এবং মোহনীয় গন্তব্য।

এবার কাশগর আসার আগে সেসময়ের ছবিগুলো খুঁজে বের করলাম। খুঁজে পেলাম প্রসিদ্ধ ঈদখা মসজিদের ছবি। পেলাম দাড়িওয়ালা পুরুষ এবং মাথায় স্কার্ফ পরা নারী এবং ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে পোজ দেওয়া শিশুদের ছবি। আমি ভাবছি এই শিশুগুলোকে নিয়ে, যাদের বয়স বর্তমানে ২০ বছরের কাছাকাছি।

প্রায় চারবছর ধরে চীনা সরকার ১ মিলিয়নেরও বেশি উইগুর মুসলিমকে বন্দীশিবিরে নিয়ে গেছে। উদ্দেশ্য হলো- সংস্কৃতি, ভাষা এবং ধর্ম থেকে তাদের দূরে সরিয়ে দেওয়া। পুরুষদের দাড়ি কেটে ফেলতে হয়েছে, নারীদের মাথা থেকে সরাতে হয়েছে স্কার্ফ।  চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কাছে আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছে। আর বাবা-মায়ের কাছ থেকে নিয়ে বাচ্চাদের রাখা হয়েছে এতিমখানায়।

বহুদিন পর কাশগরে ফিরে এসে প্রথম নজরে আমি কেমন যেন সব অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক বলে মনে করেছিলাম। ওল্ড সিটিতে পরিবারগুলো রাতের বাজারে বাইরে মাংস এবং রুটি খেয়ে বেড়াচ্ছিল।  বাচ্চাদের উপরের জানালা দিয়ে হাসতে শোনা যায়। এমনকী যুবকদেরও দেখা মিলেছে সড়কে- যারা কর্তৃপক্ষের মূল লক্ষ্য।

লেখক

বাইরে থেকে পরিস্থিতি যতই স্বাভাবিক মনে হোক না কেন আমি সবকিছুর মধ্যে একটা ভান দেখতে পাচ্ছিলাম। তাদের চেহারায় স্পষ্ট ভয় এবং অসহায়ত্ব দেখা যাচ্ছিল।

আমার দেখা কাশগরের কাউকে কি এই মাসে রিএডুকেশন ক্যাম্পে নেওয়া হয়েছে? অবশ্যই! কিন্তু আমি রাস্তায় বা কোনো দোকানে বিষয়টি নিয়ে কাউকে জিজ্ঞাসা করিনি। যেমন কোনো বিষয়ে স্থানীয়দের জিজ্ঞাসা করতাম না পিয়ংইয়ং শহরেও। যদি কর্তৃপক্ষ জানতে পারে কোনো বিদেশি নাগরিক বা সাংবাদিকের সঙ্গে কেউ কথা বলেছে তবে তারা বেশ বিপদে পড়তে পারে।

আমি তাদের সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করতাম যাদের এসব ক্যাম্পে থাকার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় অবশ্যই স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে আলোচনার ঝুঁকির বিষয়ে সচেতন থাকতাম।  

আমি ভারাক্রান্ত মন নিয়ে এক সাংবাদিককে বলছিলাম, আমি রাস্তায় কারও সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। স্টোর, পার্ক বা ট্যাক্সিতে কোনো প্রশ্ন করতে পারিনি। নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গে তর্ক করা ছাড়া কিছু করা হয়নি। আমি কেবল যা করতে পেরেছিলাম তা হলো, চুপচাপ দেখে যাওয়া।

দুই বছর আগে যখন আমি চীনে এসেছিলাম সেসময় কিম জং উনের ওপর একটি বই লেখা শেষ হয়েছিল এবং উত্তর কোরিয়া নিয়ে মগ্ন ছিলাম। আমি চেষ্টা করেছি চীনকে তার প্রতিবেশী রাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার চোখে না দেখতে।

আমি নিজেকে বোঝাতে চেয়েছি, চীন কখনোই উত্তর কোরিয়া নয়।

কিন্তু ২০১৩ সালে চীনের সর্বময় ক্ষমতার মালিক বনে যাওয়া শি জিনপিং উত্তর কোরিয়ার অভিজ্ঞতা ভুলে যাওয়ার চেষ্টার বিষয়টি আমার জন্য আর তত সহজ রাখেননি। যদিও এখনো দেশটিতে সীমিত স্বাধীনতা, বাণিজ্য এবং প্রাণবন্ততা রয়েছে কিন্তু চীনের উত্তরপূর্ব সীমান্তে এটা কল্পনাও করা যায় না। আর কখনো কখনো চীন এবং উত্তর কোরিয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না বা আলাদা করা যায় না। তখন চীনকে উত্তর কোরিয়ার মতোই মনে হয়!

আমি হাঁটছি কোনো বুকস্টোরের মধ্যে সেখানে শি জিনপিং-এর ‘দ্য গভর্ন্যান্স অব চায়না’ ছাড়া আর কোনো বই নেই। গত বছরের ১ অক্টোবর জাতীয় দিবস উদযাপনের সময় দেখলাম শি’র বিশাল প্রতিকৃতি নিয়ে একটি কালো গাড়ি ঘুরছে।  

সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিন এবং কমিউনিস্ট চীনের প্রতিষ্ঠাতা মা সেতুং নিজেদের ব্যক্তিত্বের যে সংস্কৃতি তৈরি করেছিলেন উত্তর কোরিয়ার কিম সম্ভবত তাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। তবে শি জিনপিং যে ভক্তির সংস্কৃতি তৈরি করেছেন তা চীনে কয়েক দশক ধরে দেখা যায়নি।

বলতে গেলে এ প্রপাগাণ্ডা অনেক সময় কাজেও আসে। এই বছর মাও সেতুং এর জন্মস্থান চাংশা শহরের বেশ কিছু তরুণের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, যারা প্রকৃতপক্ষেই কমিউনিস্ট পার্টির প্রশংসা করছিল। আমি বেইজিং এর অলিতে গলিতে অসংখ্য বুড়ো মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি, যারা এ করোনা পরিস্থিতিতে শি জিনপিংকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পেয়ে নিরাপদ বোধ করছেন।

তাদের অনুভূতিতে কোনো খাদ নেই। তবে সার্বিকভাবে এটা জোর দিয়ে বলা মুশকিল।

শুধু শিনজিয়াং নয়, পুরো চীন জুড়ে, সাধারণ লোকের সঙ্গে কথোপকথন অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।  সমালোচনা বা অন্য কোনো বিষয়েই মানুষ কথা বলতে ভয় পায়। এবার শিক্ষার্থী বা অধ্যাপক, সুপারমার্কেটের কর্মী বা ট্যাক্সিচালক-মোটরসাইকেল চালক সবাই আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।

আমি এমন সাহসী কারও মুখোমুখি হতে চাই যিনি কথা বলতে চান। আর তা পারলে আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো সবসময়। কিন্তু তার এই সাহস বা সততার সঙ্গে ভয়ের একটি বিষয়ও সামনে চলে আসে। আমার এ স্টোরি বা আমার সঙ্গে কথোপকথনের জন্য কি তাকে বন্দী করা হবে? যারা কথা বলে তাদের বহু বছর কারাভোগসহ নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয়।  

কাশগরের ওল্ড সিটিতে গেলে মনে হবে জীবন এখানে স্বাভাবিক

চীনের নাগরিকরা অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। কেননা, দেশটিতে প্রকৃত কোনো বিচার প্রক্রিয়া বর্তমান নেই এবং নেই কোনো আশ্রয়। তবে উত্তর কোরিয়ার মতো চীনও ক্রমবর্ধমান বিদেশিদের জিম্মি করে রাখছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীদের সঙ্গে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিরোধে সাংবাদিকদেরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। কানাডিয়ান মাইকেল কভরিগ এবং মাইকেল স্পাভর যাদের আমি কাজের মাধ্যমে চিনি তাদের ৬৫০ দিনেরও বেশি সময় ধরে চীন আটকে রেখেছে হুয়াওয়ের মেং ওয়াংজুকে গ্রেফতারের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। উত্তর কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ শিক্ষার্থী অটো ওয়ার্মবিয়ার যতদিন বন্দী ছিলেন এ সময় তার চেয়েও বেশি।

অতি সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক চেং লেইকে আটক করা হয়েছে। যিনি চীনে ইংরেজি ভাষার টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ করতেন।  

আমি দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে চীন ছেড়ে এলাম। অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিকদের সঙ্গে সর্বশেষ ঘটনার আগেই আমি নিউজিল্যান্ডে ঘরে বসে একটি নতুন সুযোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আর চীনে দেশটির নাগরিকদের জন্য পরিস্থিতি সহসাই ভালো হচ্ছে এমনটা মোটেও মনে করছি না।

চীন ছাড়ার আগে এক প্রবীণ আমাকে একটি কৌতুক শোনালেন। যা আজকাল দেশটিতে বেশি শোনা যাচ্ছে। তা হলো- ‘আমরা ভাবতাম উত্তর কোরিয়া আমাদের অতীত। কিন্তু বর্তমানে আমরা অনুধাবন করছি, উত্তর কোরিয়া আমাদের অতীত নয় বরং ভবিষ্যৎ। ’

বাংলাদেশ সময়: ২০৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০২, ২০২০
এইচএডি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।