ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের মৃত্যু, সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে নিহতদের পরিবারে শোকের মাতম গত কয়েক বছরে বেশ পরিচিত দৃশ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু গত দশ-বারো দিন ধরে এর একেবারে উল্টোটা ঘটতে দেখা যাচ্ছে মেঘালয় সীমান্তের সাউথ গারো হিলস জেলায়।
মেঘালয়ের পুলিশ ও প্রশাসন জানিয়েছে, নিহত ব্যক্তিকে মাদক চোরাকারবারি বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা হলেও তার আদৌ কোনো অপরাধের রেকর্ড ছিল না। দুদেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে এখন এই হত্যাকান্ডের প্রতিকারের চেষ্টা চলছে।
বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মেঘালয়ের রাসনগর গ্রামের বাসিন্দা, ৪৮ বছর বয়সী থেডিয়ান জি মোমিনের গুলিবিদ্ধ মরদেহ সীমান্তের কাছে বাংলাদেশের দিক ঘেঁষে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল গত ২৯শে ডিসেম্বর সকালে। স্থানীয় গ্রামবাসীদের বক্তব্য, তার আগের রাতেই বাংলাদেশের দুষ্কৃতীরা তাকে টেনে-হিঁচড়ে সীমান্তের অন্য পারে নিয়ে যায় এবং বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি-র সহায়তায় সূর্যপুর-ডুমিলকুড়া সীমান্তের কাছে তাকে গুলি করে হত্যা করে।
রাসনগর গ্রামটি যে ওয়েস্ট গারো হিলস জেলায় পড়ছে, সেখানকার পুলিশ প্রধান প্রিয়াংশু পান্ডে জানান, প্রত্যক্ষদর্শী গ্রামবাসীদের জবানবন্দী অনুযায়ী ওই ব্যক্তিকে শেষবারের মতো দেখা গিয়েছিল তার মৃত্যুর ঠিক আগের দিন বিকেলে। "তিনি সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ ক্ষেতের শাকসবজি তুলতে গিয়েছিলেন, তবে তিনি পুরোপুরি ভারতের সীমানার ভেতরেই ছিলেন বলে জানান তিনি।
"পরদিন সকালে বিএসএফ আমাদের জানায় যে একজন ভারতীয় নাগরিককে গুলি করে হত্যা করার কথা বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি তাদের জানিয়েছে। " "বিএসএফ আমাদের বলে যে বিজিবি গুলিচালনার কথা স্বীকার করলেও আত্মরক্ষার্থেই না কি সে গুলি চালানো হয়েছে। ওই ব্যক্তির কাছ থেকে ইয়াবা মাদকের ট্যাবলেটও ছিল বলে বিজিবি দাবি করেছে। " "অথচ তার নামে পুলিশের কাছে কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই, এলাকায় বরং তার বেশ সুনামই ছিল। " "চোরাকারবারেও সে জড়িত ছিল না, তাই এলাকার বাসিন্দারা স্তম্ভিত - বিজিবির বক্তব্য তারা মোটেও বিশ্বাস করতে পারছেন না", বলছিলেন ওয়েস্ট গারো হিলসের পুলিশ সুপার প্রিয়াংশু পান্ডে।
স্থানীয় বিএসএফ কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই সীমান্তের অন্য দিকে ময়নসিংহ সেক্টরে মোতায়েন বিজিবি-র ৩৯ ব্যাটেলিয়নের কাছে এই হত্যাকান্ডের ব্যাপারে একটি প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছেন। এদিকে এই ঘটনায় সীমান্ত এলাকায় তীব্র উত্তেজনা তৈরি হওয়ার পর মেঘালয় রাজ্য সরকারও বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে।
মেঘালয়ের উপ-মুখ্যমন্ত্রী প্রেস্টোন টিনসং বিবিসিকে বলছিলেন তাদের সরকার অবশ্য এখনো থেডিয়ান জি মোমিনের মৃত্যু নিয়ে কোনো চূড়ান্ত রিপোর্ট হাতে পায়নি। উপমুখ্যমন্ত্রী মি টিনসং জানান, "সরকার বিষয়টি বিএসএফের হাতেই ছেড়ে দিয়েছে এবং বিএসএফ কর্তৃপক্ষের রিপোর্টের অপেক্ষায় আছে। " "আমরা শুধু এটুকু জানি, কমান্ডান্ট পর্যায়ে দুদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। "
এদিকে এই বিতর্কের মধ্যেই সীমান্ত এলাকার আর একটি ঘটনাকে ঘিরেও মেঘালয়ে উত্তেজনা ছড়িয়েছে, যেটি ঘটেছে রাজ্যের ওয়েস্ট জয়ন্তিয়া হিলস জেলায়। স্থানীয় সূত্রগুলো জানাচ্ছে, ২রা জানুয়ারি রাতে ওই জেলার আমজলং গ্রামে বিজয় রংপির সুপারিবাগানে ঢুকে ফসল চুরি করার চেষ্টা করছিল একদল বাংলাদেশি দুষ্কৃতী।
বিজয় রংপি সেটা টের পেয়ে বাধা দিতে গেলে তাকে পিছমোড়া করে বেঁধে বাংলাদেশের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ওই দুষ্কৃতীরা - কিন্তু তার চিৎকারে গ্রামের লোকজন জড়ো হয়ে যাওয়ায় সে চেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। মেঘালয় বিএসএফের পক্ষ থেকে টুইট করে এ ঘটনায় গ্রামবাসীদের ভূমিকার প্রশংসাও করা হয়েছে।
মেঘালয়ে মোতায়েন বিএসএফের আইজি হরদীপ সিং দুদিন আগেই এক সাংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেন, "মেঘালয় ও বাংলাদেশের ৪৪০ কিলোমিটার লম্বা সীমান্তের ৩০ শতাংশ এলাকায় এখনো কাঁটাতারের বেড়া বসানো সম্ভব হয়নি। " "আর এ কাজ যতদিন না শেষ হচ্ছে ততদিন এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। " "সীমান্তে বেশ কয়েকটা জায়গায় বেড়া বসাতে বাংলাদেশ সরকারের অনুমতিও লাগবে, আমরা তাদের কাছে সে ব্যাপারে যোগাযোগও করছি", জানান বিএসএফের ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
প্রসঙ্গত, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহেই বিএসএফ ও বিজিবি-র মহাপরিচালকরা আসামের রাজধানী গুয়াহাটিতে শীর্ষ সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন - আর ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সেটাই ছিল দুই বাহিনীর ডিজি-দের মধ্যে প্রথম বৈঠকে। সীমান্ত হত্যাকান্ড বন্ধ করার ব্যাপারেও সেই সম্মেলনে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা হয়েছিল।
কিন্তু এই মুহূর্তের বাস্তবতা হল, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে বিএসএফের বিরুদ্ধে যে ধরনের ক্ষোভ-বিক্ষোভ আখছার শুনতে পাওয়া যায় - এখন মেঘালয়ের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী গ্রামেও বিজিবি-র বিরুদ্ধে ঠিক একই ধরনের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।