রাজধানী কিয়েভসহ পূর্ব ও উত্তর ইউক্রেন দখলে রাশিয়ার লড়াই অব্যাহত রয়েছে। এরপরেও রাশিয়ার অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে দক্ষিণ ইউক্রেনে সাফল্য পাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ।
ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চল রাশিয়ার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং ইতোমধ্যে কিছু শহর তারা দখলেও নিয়েছে। সর্বশেষ তাদের দখলে এসেছে জেপোরেঝিয়ার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। অবশ্য দক্ষিণে তাদের এই অভিযান শুরু হয়েছে মূলত ক্রিমিয়া দিয়ে। ২০১৪ সালে এটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল রাশিয়া। এখন সেখানে রাশিয়ার বড় ধরনের সামরিক উপস্থিতি রয়েছে।
গত বুধবার (০২ মার্চ) পেন্টাগনের মুখপাত্র জন কিরবিও বলেছেন, রুশ সেনারা ক্রিমিয়ার দিক থেকে ইউক্রেনে প্রবেশ করেছে। ধীরে ধীরে তারা পূর্বদিকে মারিওপোল ও পশ্চিমের ওডেসার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা ইউক্রেনের সমুদ্র যোগাযোগ বন্ধের হুমকি দিয়েছে, যা হবে দেশটির অর্থনীতির জন্য চরম ক্ষতিকর।
ডিকিনসন কলেজের রাশিয়া বিশেষজ্ঞ প্রফেসর কার্ল কুয়ালস বলেন, কৌশলগত দিক থেকে ওই অঞ্চলে বড় বন্দর আছে যা পুতিন বাহিনীকে সাগর পথে ইউক্রেনের জন্য আসা সরবরাহ বন্ধ করে দিতে সহায়তা করবে। আবার ক্রিমিয়ার পূর্বদিকে রুশ বাহিনী মারিওপোলের দিকে যাচ্ছে। শহরটিতে প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষ বসবাস করে। ইতোমধ্যে সেখানে পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে বলে অধিবাসীরা জানিয়েছেন।
তবে মারিওপোলের পতন হলে এটি রাশিয়াকে ইউক্রেনের একটি বড় বন্দরের নিয়ন্ত্রণ পেতে সহায়তা করবে। একইসঙ্গে এটি ক্রিমিয়া ও রাশিয়া সমর্থিত লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক অঞ্চলের সঙ্গে একটি সড়ক করিডোর প্রতিষ্ঠা করবে। এতে রাশিয়া থেকে সরাসরি ক্রিমিয়াতে মালামাল ও মানুষ পরিবহন সহজ হবে, যা ২০১৪ সাল থেকে পাওয়ার চেষ্টা করে আসছে দেশটি। এখন এই উপত্যকার সঙ্গে রাশিয়ার যোগসূত্র হিসেবে আছে একটি মাত্র সেতু, যা অনেক অর্থ ব্যয় করে তৈরি করেছে দেশটি।
মারিওপোলের উত্তরপশ্চিমে জেপোরেঝিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র দখল করে নিয়েছে রাশিয়া। স্বাভাবিক সময়ে এই কেন্দ্র ইউক্রেনের ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। বলা যায়, এ কেন্দ্রটি দখলের মাধ্যমে রাশিয়া ইউক্রেনের বিদ্যুৎ সরবরাহের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। রুশ সামরিক বাহিনী খারসন শহরও দখল করে নিয়েছে, যা এমন একটি জায়গায় যেখানে দানিয়ুব নদী গিয়ে কৃষ্ণসাগরে মিশেছে। এ স্থানটি রুশ সেনাদের ইউক্রেনের আরও ভেতরে অগ্রসর হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
পেন স্টেট ইউনিভার্সিটির ইতিহাস, রাশিয়া ও ইউক্রেন বিষয়ক প্রফেসর ক্যাথরিন ওয়ানার বলেন, যদি রাশিয়া আরও পশ্চিমে ওডেসা এবং তারপরেও অগ্রসর হতে পারে তাহলে তা শুধু ইউক্রেনকে সমুদ্র থেকেই বিচ্ছিন্ন করবে না। পুরো দেশটিকে রাশিয়া তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলতে পারবে।
তবে দক্ষিণাঞ্চলে রাশিয়ার আগ্রাসনের একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। ১৮ শতকে অটোমানদের সঙ্গে অনেকগুলো যুদ্ধের পর রাশিয়ার সম্রাট ইউক্রেনের ওডেসা থেকে শুরু করে লুহানস্কের দক্ষিণ থেকে পূর্বদিক পর্যন্ত নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল। এটাই পরিচিত হয়ে উঠেছিল নতুন রাশিয়া হিসেবে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সময়ে নতুন রাশিয়ার বড় অংশের নামই ছিল ইউক্রেনিয়ান সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক, যা পরে বর্তমান ইউক্রেনে রূপ নেয়। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছিলেন, বিভিন্ন কারণে নতুন রাশিয়া ভূখণ্ড হারালেও এর জনগণ সেখানেই আছে।
প্রফেসর কার্ল কুয়ালস বলেন, রাশিয়ার ভূমি হিসেবে যে মিথলজি আছে সেটিই পুতিন তুলে ধরেছিলেন। তবে এটি রুশ সাম্রাজ্যের অংশ ছিল কিন্তু রাশিয়ানরা সেখানে বাস করতো না। বরং রাশিয়ানদের চেয়ে রোমানিয়ান ও ইউক্রেনিয়ানরা সেখানে বেশি ছিল। তবে ধারণাটি হারিয়ে যায়নি। লুহানস্ক ও দ্যোনেৎস্ক-এর স্বঘোষিত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নতুন রাশিয়াকেই আবার ফিরিয়ে আনতে চায়। তবে ইউক্রেনের ভূমি নিয়ে পুতিনের দাবিকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে রাজি নন প্রফেসর ক্যাথরিন ওয়ানার।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৩ ঘণ্টা, মার্চ ০৫, ২০২২
এনএসআর