যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক উত্তেজনা রয়েছে। এই উত্তেজনা দূরে ঠেলে ফুটবল বিশ্বকাপে দুই দেশের ম্যাচ হয়ে উঠতে পারে বন্ধন শক্তিশালী করার সুযোগ।
৩১ বছর বয়সী আমেরিকান-ইরানি শেরভিন শরিফি ফুটবলের একজন অন্ধ ভক্ত। শখের বসে তিনি জার্সি সংগ্রহ করে থাকেন। তার সংগ্রহে বিভিন্ন জাতীয় দল ও ক্লাবের ১০৭টি জার্সি রয়েছে। এর মধ্যে শুধু ইরানের জাতীয় দলেরই রয়েছে ৪০ থেকে ৪৫টি।
খেলা নিয়ে তিন দিনের চিৎকারে শরিফির গলা এরইমধ্যে ভেঙে গেছে। আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বলা যায়, ফুটবলে আমি একমতো আসক্ত। এটিই আমার জীবন।
তিনি এবং তার বন্ধুরা টেক্সাসের ডালাস থেকে পছন্দের ইরানের জাতীয় দলকে সমর্থন দিতে কাতারে এসেছেন। বুধবারের ইরান বনাম যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাচ ঘিরে তার মধ্যে বেশ উত্তেজনা কাজ করছে।
এর আগে ওয়েলসের বিপক্ষে ২-০ গোলের জয় পেয়েছিল ইরান। আর ইংল্যান্ডের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গোলশূন্য ড্র হয়েছিল। পরের পর্বে যেতে যুক্তরাষ্ট্রের জয় প্রয়োজন। আর ইরানের ড্র করলেই হবে। গ্রুপ বি- এর দেশ দুটির মধ্যে একটিই পরের ধাপে যেতে পারে। এই বিশ্বকাপে দেশ দুটির আর দেখা হবে না।
কাতারের দোহার সৌক ওয়াকিফ মার্কেটে দাঁড়িয়ে শরিফি আল জাজিরাকে বলেন, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এই ম্যাচের জন্য ইরানি খেলোয়াড়দের বেশি আবেগ রয়েছে। কেননা তারা শুধু সাফল্যের জন্যই খেলবে না, তাদের ৮০ মিলিয়ন নাগরিককে খুশি করতে হবে। এটি কাঁধে বড় একটি বোঝা।
তিনি বলেন, তিনি স্বীকার করেন যে, অনেকের জন্যই ম্যাচটি ফুটবলের চেয়েও বেশি কিছু। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর থেকে ইরানে শ্বাসরোধকর পরিস্থিতি চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যখন ইরানের দল মাঠে নামবে, তারা শুধু ম্যাচের জন্যই খেলবে না, তারা পরিবর্তনের জন্য খেলবে।
১৯৯৮ সালে ফ্রান্সের লিয়নে মুখোমুখি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র-ইরান। সেই সময় থেকে ফুটবলের প্রেমে পরেন শরিফি। আর এই কারণে তার কাছে ম্যাচটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তিনি সেই ১৯৯৮ সালের সেই ম্যাচের কথা মনে করতে পারেন। সেই ম্যাচে ইরান যুক্তরাষ্ট্রকে ২-১ গোলে হারিয়েছিল। তখন তার বয়স ছিল সাত বছর। এরপর তার পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমায়।
দুই দেশের মধ্যে বিরোধপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে সেই ম্যাচটিকে ইতিহাসের মোস্ট পলিটিক্যালি চার্জড ম্যাচ বলা হয়।
শরিফি বলেন, তার বাবা ফুটবল ম্যাচের রাজনৈতিক দিক নিয়েই বেশি সচেতন ছিলেন। বিষয়টি তাকে উদ্দীপ্ত করত। তিনি বলেন, এটি আমার কাছে কোনো বিষয় নয়। তখন আমি ছোট ছিলাম। আমি শুধু দেখেছিলাম ১১ জন মাঠে নেমেছেন, আমার এটুকুই মনে আছে।
১৯৯৮ সালের সেই ম্যাচ ঘিরে উত্তেজনা নাও বাড়তে পারতো। ইরানের প্রধান নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি হুমকি দিয়েছিলেন দল যাতে ম্যাচটি বর্জন করে। তিনি চাননি খেলোয়াড়রা যুক্তরাষ্ট্রের দলের সঙ্গে হাত মেলাক।
তবে ওই ম্যাচে খেলোয়াড়দের আচরণ ছিল ভিন্ন। দুই দলই ছবি তোলার জন্য একসঙ্গে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। ইরানের খেলোয়াড়রা শান্তির প্রতীক হিসেবে প্রতিপক্ষকে ফুলের তোড়া দিয়েছিলেন।
শরিফি বলেন, ১৯৯৮ সালের দিকে ফিরে দেখুন। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র ঐক্যবদ্ধ একটি মুহূর্ত এনেছিল।
বিশ্বকাপের সেই ম্যাচের পর থেকে অনেক কিছুর পরিবর্তন এসেছে। বুধবারের ম্যাচের আগে ইরানে উত্তেজনার কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রকে ঘিরে নয়।
ইরানে পুলিশ হেফাজতে মাহসা আমিনি নামক ২২ বছরের এক তরুণীর মৃত্যু ঘিরে গড়ে ওঠা আন্দোলন কয়েক সপ্তাহ ধরে চলছে। গেল সেপ্টেম্বরে তিনি দেশটির নীতি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন অনুপযোগী পোশাক পরার কারণে। এই আন্দোলনে অনেকে মারা গেছেন।
এই বিশ্বকাপে ইরানের প্রথম ম্যাচ ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ইরান দল তাদের দেশে চলমান আন্দোলনের সমর্থনে ম্যাচের আগে জাতীয় সংগীত গায়নি। ওয়েলসের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচে গাইলেও তা ছিল সংরক্ষিত পদ্ধতিতে।
শরিফি বলেন, ইরানের জাতীয় দল আন্দোলনের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসার একটি মাধ্যম। দল যখন জাতীয় সংগীত গায়নি, তখন বিষয়টি সবার নজরে আসে।
৩৭ বছর বয়সী আমেরিকান-কানাডিয়ান ভিগনেশ রাম সানফ্রান্সিসকো বে অঞ্চল থেকে কাতারে এসেছেন তার বাবার সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র দলকে তিনি সমর্থন দিচ্ছেন। রাম বিশ্বাস করেন, ফুটবল এক ঐক্যবদ্ধ শক্তি। এটি দুই দেশের রাজনৈতিক উত্তেজনার ওপর গুরুত্ব দেয় না।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল ভক্তদের জন্য বিদেশে ঘোরাঘুরি আরও অনেক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের সুযোগ। এটি লোকজনকে এমনভাবে একত্রিত করে যা সত্যিই অর্থবহ। যুক্তরাষ্ট্র সেরা দল হতে পারবে না। তাই তাদের হারানোরও বেশি কিছু নেই।
তিনি বলেন, আমি মনে করি এটি শক্তিশালী বন্ধন তৈরির সুযোগ।
রাম এই খেলাটিকে সেইসব লোকদের সম্পর্কে জানার একটি সুযোগ হিসেবে দেখছেন, যারা যুক্তরাষ্ট্রের নন। তিনি বলেন, ফুটবল আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, দেশগুলো তাদের সরকার নয়। তারা তাদের লোকজন।
ডালাস থেকে আসা শরিফিও একমত যে, ফুটবল সহমর্মিতায় উৎসাহ দিতে পারে। তবে তিনি স্বীকার করেন দেশের রাজনীতি থেকে জাতীয় দলকে দূরে রাখা কঠিন।
তিনি বলেন, লোকজন এখানে শুধুমাত্র ফুটবলের জন্য আসেনি। এটি অতীতেরও একটি বিষয়। এর একটি রাজনৈতিক শর্তও রয়েছে। তবে তিনি বিশ্বাস করেন, খেলায় এই রাজনৈতিক সংযুক্তি থেকে ইতিবাচক কিছু আসতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভক্তরা ইরানি লোকজনের প্রতি সহমর্মী হতে যাচ্ছেন, কেননা দিন শেষে তারা তাদের সরকার নয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০২২
আরএইচ