ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সাক্ষাৎকার

প্রশিকা চেয়ারম্যান ড. কাজী ফারুকের সঙ্গে একটি সন্ধ্যা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৩ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০২২
প্রশিকা চেয়ারম্যান ড. কাজী ফারুকের সঙ্গে একটি সন্ধ্যা

বাংলাদেশের ড. কাজী ফারুক। নামটির সঙ্গে কাউকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই।

দেশের প্রথম এনজিওর চেয়ারম্যান তিনি। মুক্তবুদ্ধির প্রসার, দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাবলম্বী করে তোলা, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই, নারীশিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়তন, মানুষকে অধিকার সচেতন করা,  ভোটাধিকারের পক্ষে মানুষকে সংগঠিত করা, প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো----এই সব নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আপসহীন সংগ্রামের এক কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন তিনি। ৭৫ বছর বয়সে এখনও তারুণ্যে টগবগ।

বাংলানিউজের পক্ষ থেকে গত ১৬ জুন বিপুল প্রতিভা ও অভিজ্ঞতার অধিকারী সংগ্রামশীল এই মানুষটির একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। টানা পাঁচ ঘণ্টার এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকার, আড্ডা ও আলাপচারিতায় কাজী ফারুকের জবানীতে উঠে আসে তাঁর জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা। উঠে আসে তার জনবান্ধব কর্মসূচি, দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম ও ভবিষ্যতের নানা স্বপ্ন ও রূপকল্পের কথা।

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাংলানিউজ সম্পাদক জুয়েল মাজহার, প্রধান প্রতিবেদক ইসমাইল হোসেন ও জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক গৌতম ঘোষ। সঙ্গে ছিলেন জ্যেষ্ঠ ফটো সাংবাদিক জিএম মুজিবুর।   

বাংলানিউজ: শুভ সন্ধ্যা। আপনার ও আপনার পরিচালিত প্রতিষ্ঠান প্রশিকার বিষয়ে বাংলানিউজের অগণিত পাঠকের বিপুল আগ্রহ রয়েছে। আলাপচারিতার ভেতর দিয়ে আমরা ধাপে ধাপে এ বিষয়ে একটু একটু করে জেনে নেব। নিজের সম্বন্ধে শুরুতেই যদি কিছু বলতে বলা হয় কি বলবেন?

ড. কাজী ফারুক: আমার জীবন শুধু আমার নিজের জন্য নয়। আমি অনুভব করি, আমার জীবন অন্যদের জন্যও। তাই অন্যদেরও কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সেকথা সব সময় আমার মধ্যে ছিল এবং আছে। আমি শেষ পর্যন্ত, শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আমার ভিশন, আমার স্বপ্ন ও সংগ্রামে অটল থাকব। এর একচুল নড়চড় হবে না। আমার কাছে এটাই সৃষ্টিকর্তার নির্দেশিত পথ। আমি দেখেছি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এত বড় সব আঘাত, কুচক্রিদের আঘাত আর কূটচাল--এসবের মধ্যে ঈশ্বরের সহায়তা ছাড়া টিকে থাকতে পারতাম না। আর যত মামলায় আমি জিতেছি সেটা আমার কর্মফলের জন্য জিতেছি। সততা আর নিষ্ঠার জন্য জিতেছি। এজন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তিনি যেন আমাকে আরো কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখেন, আমার ভিশনে মানুষের সেবা করতে দেন।  

 

“বাবাকে আরো বললাম, আমি কোরআন শরিফের পাশাপাশি
গীতা, বেদ, বাইবেল ও ত্রিপিটক পড়তে চাই।
তিনি বললেন, হ্যাঁ পড়ো, কোনও অসুবিধা নেই।
তবে শুধু দেখবে যে এসবের মধ্যে অমিল অনেক আছে, কিন্তু মিলও আছে। কোথায় কোথায় মিল আছে সেটা খুঁজবে”

 

বাংলানিউজ: আপনার মধ্যে অসম্প্রদায়িক মূল্যবোধ ও চেতনার বীজ বপন কীভাবে হলো? সে সম্পর্কে জানতে চাই।

ড. কাজী ফারুক: শিক্ষাজীবনে আমি আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম। পরে প্রশিকার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানবিক উন্নয়ন, পরিবেশের উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন--- এসব নিয়ে আমি কাজ করেছি। আমার স্বপ্ন ও আদর্শের ভিত রচিত হয়েছে আমার পারিবারিক জীবন ও শিক্ষা থেকে।

আমার বাবা রক্ষণশীল মুসলমান ছিলেন। বাবা আমাদের ভাই-বোনদের কোরআন শিক্ষার জন্য একজন ওস্তাদ রেখে দিয়েছিলেন। তিনি প্রতিদিন এসে কোরআন শেখাতেন। বাবা বললেন, তোমাকে কোরআন শরিফ বাংলা বা ইংরেজিতে যেভাবেই হোক পড়তে হবে। আমি বললাম, ঠিক আছে আমি পড়বো। বাবাকে আরো বললাম, আমি কোরআন শরিফের পাশাপাশি গীতা, বেদ, বাইবেল ও ত্রিপিটক পড়তে চাই। তিনি বললেন, হ্যাঁ পড়ো, কোনও অসুবিধা নেই। তবে শুধু দেখবে যে এসবের মধ্যে অমিল অনেক আছে, কিন্তু মিলও আছে। কোথায় কোথায় মিল আছে সেটা খুঁজবে।

 

 

আমি যখন নটরডেম কলেজে এবং পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন এইসব ধর্মগ্রন্থের ইংরেজি ও বাংলা তরজমা বেশ খানিকটা পড়ে ফেলেছি। ধর্মগুলির নির্দেশিত আচার অনুষ্ঠানে বেশ অমিল থাকলেও মূলে অনেক মিল আছে। সব ধর্মে পাপ-পুণ্যের যে তালিকা আছে, দু-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া তা হুবহু এক। আরও আশ্চর্য মিল হলো, সকল ধর্মের প্রবর্তকরাই গরিব ছিলেন অথবা পরিস্থিতির কারণে বা স্বেচ্ছায় দরিদ্র হয়েছিলেন। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) দরিদ্র মেষপালক ছিলেন। হযরত মুসা (আঃ) ফেরাউনের রাজপ্রাসাদে পালিত হলেও আদতে দ্ররিদ্র পারিবারের সন্তান ছিলেন, হযরত ঈসা (আঃ) দরিদ্র মেষপালক ছিলেন। মাঝে মাঝে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ ( স.) এতিম ছিলেন। মেষপালক হিসেবেই তাঁর প্রথম জীবন কাটে। গৌতম বুদ্ধ যুবরাজ ছিলেন, মানুষের দুঃখ নিবারণের উপায় খুঁজতে রাজ প্রাসাদ ত্যাগ করে বনেজঙ্গলে সাধনা করতে থাকেন এবং ভিক্ষার অন্নেই দিন গুজরান করতেন। অবতার শ্রীরামকে বিমাতার ষড়যন্ত্রে বনবাসে কঠোর জীবন যাপন করতে হয়েছে। অবতার শ্রী কৃষ্ণকে অত্যাচারী রাজা কংসের হাত থেকে বাঁচতে গোয়ালা পরিবারে দরিদ্র রাখালবালক হিসাবে বড় হতে হয়েছে। এই ধর্ম প্রবর্তকদের সব বাণী ও হিতোপদেশই দরিদ্র, ক্রীতদাস, অবলা নারী ও নির্যাতিত মানুষের পক্ষে। দরিদ্রবান্ধব এই ধর্মগুলি যখন খুব জনপ্রিয় হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়, তখনই সেগুলো চলে যায় শাসক-শোষকদের নিয়ন্ত্রণে। তখন এগুলো হয়ে ওঠে রাজনীতির হাতিয়ার। ব্যবসার পুঁজিও তখন নারীর অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার পুরুষতান্ত্রিক অপকৌশলে রূপ নেয়। আমি বিজ্ঞানের অধ্যয়নের মধ্য দিয়েও অসম্প্রদায়িকতা বা ধর্ম নিরপেক্ষতার চেতনা লাভ করেছি। সৃষ্টিকর্তার নিয়ম ও নেয়ামত জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য সমান।

আর বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে যেটা পেয়েছি সেটা হলো, বঙ্গবন্ধু যখন বক্তব্য দিতেন তখন তিনি বলতেন ‘আমি মানুষ, আমি বাঙালি, আমি মুসলমান’। অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার দেওয়া যে পরিচয় সেটা হলো প্রধান পরিচয়। আমি মানুষ, দ্বিতীয় পরিচয় হবে মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির পরিচয়, আর তৃতীয় হচ্ছে আমি মুসলমান। এর মধ্যে ‘আমি মানুষ’ ---এটা হচ্ছে সবার বড়। এই পরিচয়টা যদি সবাই গ্রহণ করি তাহলে কিন্তু সব রকমের মারামারি-হানাহানি, সহিংসতা কমে যাবে। বিশ্বশান্তির জন্য এটাই মূল পরিচয়। বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষার কথা বলেছেন, বৈষম্যহীন সমাজ ও দেশের কথা বলেছেন। আমি এই আইডিয়াটা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পেয়েছি। এখান থেকেই আমার মানস গঠন হয়েছে। এটার ভিত্তিতে আমি আমার জীবন গঠন করেছি।  প্রশিকা থেকে বাস্তবিক জীবনে এটা চর্চা করেছি। সেজন্যই সব মানুষের বিশেষ করে নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াবার প্রেরণা পেয়েছি। যতোই কঠিন হোক আমি সৃষ্টিকর্তার নির্দেশিত পথেই চলছি।  

 

“বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছেন,
বৈষম্যহীন সমাজ ও দেশের কথা বলেছেন।
আমি এই আইডিয়াটা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পেয়েছি।
এখান থেকেই আমার মানস গঠন হয়েছে। এটার ভিত্তিতে আমি আমার জীবন গঠন করেছি। ..’’

 

ধর্মের নামে যে অধর্মের আস্ফালন, আমি তার বিরোধিতা করেছি। নারীদেরকে নীচু দেখিয়ে, তাদের হেয় ও অবজ্ঞা করে, দমিয়ে রেখে দাসীর মতো করে রাখার যে অপ সমাজ-ব্যবস্থা, তাকে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি এসবের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। জীবনের শঙ্কা এসেছে বহুবার। এই পথচলায় আমি আমার স্ত্রীকে পাশে পেয়েছি। আমাকে প্রেরণা দিয়েছেন আমার সহকর্মীরা, তাঁরা আমার সংগ্রামের সঙ্গী হয়েছেন। এভাবেই আমার ব্যক্তিগত মূল্যবোধ গঠিত, বিকশিত হয়েছে।  

বাংলানিউজ: স্বাধীনতার পরপরই প্রশিকা মানবিক উন্নয়নকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান এই এনজিও গঠনের পেছনের গল্পটা জানতে চাই

ড. কাজী ফারুক:  ১৯৬৮ সালে বিএসসি অনার্স শেষ করে ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করি। ঊনসত্তরের ছাত্র আন্দোলনের সময় ইকবাল হলের ছাত্র ছিলাম। আন্দোলনে ছাত্রদের মিছিলে ১-২ হাজারের বেশি লোক হচ্ছিল না, তখন শ্রমিকশ্রেণিকেও যুক্ত করলাম। তখন ফুলবাড়িয়া থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত বস্তি ছিল। কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে শ্রমিকদের উদ্বুদ্ধ করার কাজ শুরু করি। যদিও আমি নেতা গোছের কিছু ছিলাম না, একটিভিস্ট ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা এবং তাঁর মুক্তির দাবিতে সেই আন্দোলন ছিল। এটা বাংলাদেশের মানুষের প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শ্রেণি সংগ্রাম ছিল।  

১৯৭০ সালে পিসিএসআইআর (পাকিস্তান কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ)  পরীক্ষা দিলাম। সেখানে সায়েন্টিফিক অফিসার হিসেবে পোস্টিং হলো লাহোরে। কিন্তু সে চাকরিতে যোগ না দিয়ে জার্মানিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বায়ার ফার্মায় যোগ দিয়ে চাকরি করলাম তিন মাস। পরে সেই চাকরিও ছেড়ে দিলাম।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ওই চাকরি ছেড়ে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ ও ওষুধ সংগ্রহ শুরু করলাম। আগরতলা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আসতো। আমরা সংকেত ব্যবহার করে একে অপরকে চিনতাম। ওষুধ ও অর্থ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে হস্তান্তর করতাম।  একবার তো আরেকটু হলে ধরাই পড়ে যেতাম, মোটর সাইকেলে করে এসব হস্তান্তর করে ফিরছি... ঢাকা কলেজের পেছনে কালো পোশাক পরা মিলিশিয়ারা আটক করলো। কনুইয়ে দাগ আছে কিনা দেখল। কারণ, মুক্তিযোদ্ধাদের কনুইয়ে দাগ থাকত। দাগ না থাকায় ছাড়া পেলাম।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম বিসিএস দেব বলে ঠিক করলাম। । ১৯৭৩ সালে বিসিএস পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। এরই মধ্যে কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান কিউসোতে চাকরি হয়ে গেল।

১৯৭৩ সালে চাকরির সময় কুমোরদের নিজস্ব কৃৎকৌশল ও প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার দায়িত্ব পেলাম। কম তাপমাত্রায় কুমোরদের তৈজসপত্র ভালোভাবে পোড়া হতো না। আমার দায়িত্ব পড়ল টেকসই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কংক্রিটের ফার্নেস এবং পায়ে-চালানো পটার্স হুইল তৈরি করে দেওয়া। তা দিয়ে ৭০০ ডিগ্রি তাপমাত্রা হতো। প্রখ্যাত শিল্পী কামরুল হাসান তখন বিসিকে চাকরি করতেন। তিনিই ডিজাইন করে দিতেন। ধামরাইয়ের কাকরাইন গ্রামে কুমোরদের নিয়ে কাজ করছিলাম। তৈজসপত্রের মধ্যে চায়ের কাপ,  ফ্লাওয়ার ভাস, প্লেট, টেবিল ল্যাম্পস্ট্যান্ড ইত্যাদি।  কুমোরদের পণ্যগুলো জাতীয় স্মৃতিসৌধে বিক্রি করতে বললাম। সেখানে ধীরে ধীরে মৃৎশিল্প সামগ্রীর পসার জমে গেল। যা এখনও আছে।

বাংলানিউজ: সামাজিক-অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ভিত্তিক-অসম্প্রদায়িক এবং প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা পালনের লক্ষ্যে প্রশিকার মত প্রতিষ্ঠান তৈরির আইডিয়া কীভাবে এল?

ড. কাজী ফারুক: ১৯৭৪ সালে দেশে ভয়াবহ বন্যা ও দুর্ভিক্ষ হয়। ওই সময় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রও ছিল, হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ (Bottomless Basket) বললেন। তাঁর এই কথা আমাকে রাগিয়ে দিল, আমার শরীর রি-রি করছিল। তখনও কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান কিউসোতে চাকরি করি। আমি অফিসে বললাম যে রিলিফ ওয়ার্কে যেতে চাই। ওরা বললো, আমাদের তো রিলিফ ওয়ার্ক নেই। আমি বললাম ভোলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারি? ওরা বললো ঠিক আছে। তারপর অক্সফামের সাথে কাজ করা শুরু করলাম। তারা আমাকে পেয়ে খুশি হলো। কিউসো থেকে তিন মাসের ছুটি নিয়ে রৌমারী গেলাম। তিন ঘণ্টা ফেরিতে এবং ১০ ঘণ্টা বাসে চড়ে রংপুর পৌঁছাই। এরপর ট্রেনে করে রাত ২টায় চিলমারী পৌঁছলাম। মানুষজনকে জিগ্যেস করলাম, স্টেশন কোথায়? তারা বললো, নদীতে নিয়ে গেছে। দেখলাম টিম টিম করে আলো জ্বলছে, সেখানে কিছু লোকের জটলা। বললাম, আমাকে রাতে থাকতে হবে। তারা বললো, চায়ের দোকানে থাকতে পারবেন। হ্যারিকেন উঁচিয়ে দেখাল ওখানে ৮-১০ জন শুয়ে আছে। আমি ব্যাগ মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়লাম। ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠে বললাম, রৌমারী কীভাবে যাব? বললো, বাস নেই, গরুর গাড়িও নেই। পায়ে হেঁটে ব্রহ্মপুত্র নদী পার হচ্ছি। কখনও হাঁটুপানি, কখনও বা কোমরপানি। সবুজ প্রকৃতি দেখে ভাবলাম এখানে কীভাবে দুর্ভিক্ষ হয়! সন্ধ্যায় রৌমারী পৌঁছলাম এবং ডাকবাংলোয় উঠলাম।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বাজারের সামনের বটতলায় একটা জটলা দেখলাম। দেখলাম ৮/১০টা মৃতদেহ পড়ে আছে। সবাই না খেতে পেয়ে মরে গেছে। আমি ছবিতে দুর্ভিক্ষ দেখেছি, কিন্তু না খেয়ে মরার ছবি চাক্ষুষ করিনি। এটা দেখে আমার মাথা ঘুরে গেল। হাট-বাজারে খাবার আছে, সেখানে খাবারের ঘাটতিও দেখলাম না। এত এত খাবার তবু কেন না খেয়ে মরলো ?---এই প্রশ্ন মাথায় ঘুরছিল। তখন বুঝলাম যে, এদের কিনে খাওয়ার ক্ষমতা নেই। সো দে ডায়েড সাইলেন্টলি। এটা দেখে মনে ঝড় উঠল। ওদের কেনার ক্ষমতা নেই। ওরা হয়তো টানা ১০-১৫ দিন না খেয়েই ছিল, কেউ তাদের খাবার দেয়নি, তবু ওরা খাবার কেড়ে নিতেও যায়নি। তখন মাথায় এলো, ওদের প্রতিবাদ করারও ক্ষমতাটুকুও নেই। দারিদ্র্য যেখানে বেশি, সেখানে সবচেয়ে বেশি এফেক্টেড, বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারীরা, শিশুরা।  

আমার রাগ, দুঃখ হচ্ছে, মনের মধ্যে ঝড় হচ্ছে--- আমি ওদের জন্য কী করতে পারি? দরিদ্র মানুষের মুখে ভয়েস পাওয়ার তুলে দেওয়ার, প্রতিবাদ করার ক্ষমতা দেওয়ার, তাদের কেনার সামর্থ তৈরি করার জন্য মাথার মধ্যে নানা চিন্তা-ভাবনা কাজ করা শুরু করলো। আমি ওখানে না গেলে এটা মাথার মধ্যে ঢুকত না। এসব ঘটনা হচ্ছে ১৯৭৪ এর শেষ এবং ১৯৭৫ এর ফেব্রুয়ারির মধ্যে।

 

 

সেখানে দেখলাম বড় বড় জোতদার। তারা দাওয়াত দিয়ে বললো, এদের রিলিফ দেবেন না, এই গরিব লোকগুলোকে লোভী করে তুলবেন না। তাহলে ওরা অলস হয়ে যাবে। আমি প্রথমে প্রতিবাদ করতে চাচ্ছিলাম, পরে ভাবলাম এরা এত পাওয়ারফুল যে আমাকে মেরেই ফেলবে। বললাম, অক্সফামকে চিঠি লিখব, আপনাদের মাধ্যমে রিলিফ বিতরণের জন্য। কিন্তু চিঠি আর লিখিনি। এরপর তারা বেশ কয়েকবার তাগাদা দিয়েছে। আমি বলেছি, এখনও অনুমোদন আসেনি। এই ফাঁকে রৌমারীতে ত্রাণ বিতরণের কাজ শুরু করলাম। অক্সফাম অনেক রিলিফ পাঠিয়েছিল। ত্রাণের মধ্যে চাল, ডাল, তেলসহ জনপ্রতি প্রায় ২ হাজার ক্যালরির খাবার ছিল। সব মিলে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের ত্রাণ ছিল তিন মাসের জন্য।  

ত্রাণ বিতরণের সুবিধার্থে ওখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। সাতটি ইউনিয়নে সাতটি লঙ্গরখানা চালু করে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হলো। মুক্তিযোদ্ধাদের বললাম, তোমরা আমাকে একটু প্রটেকশন দিও। তিন মাস রিলিফের কাজ করে ১৯৭৫ এর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় চলে এলাম।  

বাবা বললেন, তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?

তিন মাস পর ঢাকা ফিরে এলাম। ঢাকায় ফিরে বাবার সঙ্গে ডিসকাস করলাম, এতদিনে বিসিএসের রেজাল্টও বের হয়ে গেছে। বাবাকে বললাম, আমি বিসিএসে জয়েন করব না। একটা সংগঠন করব। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে মানুষকে প্রতিবাদী করে তোলার কাজ করব। হতদরিদ্র মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানোর কাজে নামব। বাবা খেপে গেলেন। বললেন, তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? বললাম আমি এটা করতে না পারলে চিরদিন বিবেকের কাছে দায়ী থেকে যাব। নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। বাবা বললেন, যা করতে চাচ্ছ তা যদি করতে না পারো তাহলে তোমার ভবিষ্যৎ কী হবে? বললাম, লেখাপড়া শিখিয়েছেন, মোটামুটি একটা অবস্থায় যেতে পারব। বাবা সম্মতি বা অসম্মতি কিছুই দিলেন না।

বাংলানিউজ: প্রশিকাতে প্রথম অর্থসংস্থান কোথা থেকে এবং কীভাবে শুরু হয়?

ড. কাজী ফারুক: তারপর কিউসোর ঢাকা অফিসের ডিরেক্টর রেমন্ড কোর্নিয়ার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বললাম। আমার দ্বিধা হলো যে, দরিদ্রদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগের ব্যাপারটা ওরা হয়তো মেনে নেবে, কিন্তু ওদের মুখে ভয়েস পাওয়ার দেওয়ার ব্যাপারটা, ওদেরকে প্রতিবাদী করে তোলার ব্যাপারটা তো হাইলি পলিটিক্যাল। প্রতিবাদ তৈরির বিষয়টা মানবে কিনা! ও মা, উনি টাকা দিতে রাজি হয়ে গেলেন! তবে শর্ত একটাই, হেড অফিসের সম্মতি নিতে হবে। অটোয়ায় হেড অফিসে অনুমোদনের জন্য তিনি চিঠি লিখলেন। দেখলাম মাত্র ৩ সপ্তাহের মধ্যে চিঠি এলো ১ লাখ ডলার বরাদ্দের। সেটা মার্চ,  ১৯৭৫-এর ঘটনা। বাংলাদেশের  ইতিহাসে দাতাসংস্থা থেকে ১ লাখ ডলার অনুদানের এটাই প্রথম চিঠি।

 

“আমাদের শহুরে মানুষজনের ধারণা হলো, গ্রামের মানুষ কিছুই জানে না।
ওদের কোনো আইডিয়া নেই,
কোনো আইডিয়া ওরা নেয় না, এজন্য কথা বলতে চায় না।
আমি ভাবলাম এই ভুল ধারণাটা পাল্টাতে হবে”

 

ওই টাকা পেয়ে (কানাডিয়ান ডলার) আমি তাঁকে বললাম একটা প্রতিষ্ঠান করতে হবে, সেটা হবে দেশীয় প্রতিষ্ঠান। তিনি বললেন, ঠিক আছে করো। প্রশিক্ষণ শিক্ষা এবং কাজ ---এই তিনে মিলে হলো প্রশিকা। প্রশিক্ষণ হলেই মানবিক উন্নয়ন হবে। মানবিক উন্নয়ন হলেই সমতাভিত্তিক সমাজ, প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও নারীর ক্ষমতায়ন হবে। কর্মসূচি ঠিক করলাম। এর মধ্যে ছিল মানবিক ক্ষমতায়ন এবং মানুষকে প্রতিবাদী করা ও তাদের কেনার ক্ষমতা তৈরি করা। এভাবে কর্মসূচি ঠিক করলাম, আয় বৃদ্ধি হলেই কেনার ক্ষমতা বাড়বে। আমি তখন গ্রামে গ্রামে ঘুরছি। সাটুরিয়া, ধামরাই, ভৈরব, কুমিল্লার উত্তর রামপুর ও দক্ষিণ রামপুর এবং বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জে কাজ শুরু করলাম।

আমি চিন্তা করলাম, আগে থেকে ঠিক করে প্রোগ্রাম করব না। তারা কী চায়? স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরলাম। সে সময় দেখলাম তারা চেয়ার কাঁধে করে বয়ে নিয়ে আসতো, আমাকে বসতে দিতো। আমি বললাম আমি একা বসব না, চলুন সবাই মিলে চেয়ারে বসি। ওরা বলে, এত চেয়ার তো নাই। বললাম কী আছে? বলে যে, মাদুর আছে। তাদের সঙ্গে মাদুরেই বসলাম। এভাবে তাদের সঙ্গে মিশলাম। নারীরা শাড়ি ঝুলিয়ে পর্দা নিয়ে আড়ালে থাকলেন।

 

 

এরপর এলো ৩ মিলিয়ন ডলারের অনুদান
কানাডিয়ান পার্লামেন্টের ফরেন এইডের চেয়ারম্যান ডগ রৌস বাংলাদেশে এলেন। তিনি প্রশিকার প্রজেক্ট দেখতে চান। কুমিল্লার উত্তর রামপুর ও দক্ষিণ রামপুর ভিজিট করলেন। সেখান থেকে ফিরে তিনি রিডার জাইজেস্ট পত্রিকায় প্রশিকার কার্যক্রম নিয়ে আর্টিকেল লিখলেন, প্রশিকা দরিদ্রবান্ধব, নানান হিতকর কাজ করেছে, ঋণ দিয়েছে।

সিডা থেকেও কিছু অর্থ আমাদের দিয়েছে। রিডার জাইজেস্ট পত্রিকার ওই লেখাটি ছাপা হওয়ার পর সিডা থেকে লোকজন এসে প্রজেক্ট চাইল। দিলাম ৩ মিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট। তারা শর্ত দিল, সরকারের কোনো মন্ত্রণালয় স্পন্সর না করলে তারা অর্থ দেবে না। কৃষিসচিব এজেডএম ওবায়দুল্লাহ খান সেন্টু ভাইকে (খ্যাতিমান, প্রয়াত কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ) জানালাম। তিনি আশ্বাস দিয়ে বললেন, স্পন্সর করা হবে। তিনি সিডাকে চিঠি পাঠালেন। তারা ৩ মিলিয়ন ডলার মঞ্জুর করলো। বিদেশি প্রজেক্ট ইআরডিতে অনুমোদন নিতে হয়। সেখানকার একজন উপসচিব রেগে গেলেন, বিষয়টি কৃষি মন্ত্রণালয়ে জানালাম। এরপর সব বাধা সরে গিয়ে কাজ হয়ে গেল। তিন মিলিয়ন (ত্রিশ লাখ) ডলার অনুমোদন করা  হলো। এরপর একের পর এক অনুদান এলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সুইডিশ সিডা, নোভিভ, ডিএফআইডি (যুক্তরাজ্য) এবং ফোর্ড ফাউন্ডেশন থেকে।  

বাংলানিউজ:  প্রশিকাই প্রথম ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম শুরু করে, কীভাবে এর শুরু হলো?

ড. কাজী ফারুক: আমাদের শহুরে মানুষজনের ধারণা হলো, গ্রামের মানুষ কিছুই জানে না। ওদের কোনো আইডিয়া নেই, কোনো আইডিয়া ওরা নেয় না, এজন্য কথা বলতে চায় না। আমি ভাবলাম এই ভুল ধারণাটা পাল্টাতে হবে। গ্রামের হতদরিদ্রদের কাছে ডেকে নিয়ে বললাম, আপনাদের সমস্যা কী? তারা বলল, আমাদের সমস্যা আপনি তো জানেনই। বললাম, আপনারা যা জানেন, আমি তা জানি না। যেমন,আপনারা কী যত্নে, কী দক্ষ হাতে ধান চাষ করেন, মাছ চাষ করেন, শাকসবজি ফলান, এগুলো তো আমি জানি না। আমি হয়তো কিছু কথা জানি।

 

“১৯৭৬-৭৭ সালে প্রোগ্রাম হিসেবে আমরা এটা শুরু করি।
তখন থেকে শুরু হলো মাইক্রো ক্রেডিট বা ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম।
আমরাই প্রথম শুরু করলাম”

 

তখন আস্তে আস্তে তারা মুখ খুলতে শুরু করে। তারা তাদের প্রথম সমস্যার কথা বলে। বলে যে, আমরা যা উৎপাদন করতে পারি তার জন্য আমাদের টাকা দরকার। কিন্তু আমরা তো ব্যাংক থেকে ঋণ পাই না। ওখানে ঢুকতেই পারি না। অপমান করে তাড়িয়ে দ্যায়। ঘুষও চায়। মহাজন ১০০ টাকায় মাসে ২০ টাকা সুদ নেয়। জমিজমা, ঘটি-বাটি সব বন্ধক রেখে ঋণ করতে হয়।

আমি বললাম, তাহলে কী করা যায় বলুন তো? তারা বললো, আমরা কোনো পথ পাচ্ছি না, আপনি সহযোগিতা করতে পারবেন? বললাম, আপনারা সবাই সঞ্চয় করুন, ১ টাকা বা আট আনা বা প্রতিদিন এক মুঠ করে চাল সঞ্চয় করুন। আপনারা যত টাকা জমাবেন তার ৫ গুণ টাকা আমি আপনাদের দেব। তারা বললো, জামানত নেবেন না? বললাম, নেব না।  আপনারা যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমিতি করেছেন, এটাই তো জামানত। যদি কেউ টাকা না দেয় আপনারাই তাকে ধরবেন। প্রত্যেক এলাকায় ১০-১২টা করে ৫ জায়গায় ৫০টির মতো সমিতি হলো।

তখন ৬০-এর দশকে কুমিল্লায় ‘আখতার হামিদ খান সমবায় সমিতি’ ছিল, সেখানে সব শ্রেণির কৃষক ছিল। আমি একেবারে গরিব, ভুখা-নাঙ্গা শ্রেণির মানুষকে নিয়ে শুরু করি। ১৯৭৬-৭৭ সালে প্রোগ্রাম হিসেবে আমরা এটা শুরু করি। তখন থেকে শুরু হলো মাইক্রো ক্রেডিট বা ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম। আমরাই প্রথম শুরু করলাম।
 

বাংলানিউজ: প্রশিকা আর কাদের নিয়ে কাজ করেছে? ঝরেপড়া শিশু ও বয়স্ক নিরক্ষরদের শিক্ষাদানে, তাদের স্বাক্ষর করে তোলার কাজে প্রশিকার ভূমিকা কী?

ড. কাজী ফারুক:  স্কুল থেকে ঝরেপড়া শিশুদের শিক্ষা দিতে প্রতি ৩০ জনের জন্য একজন শিক্ষক ছিল।  এরকম ২২ হাজার নন ফর্মাল স্কুলে ৭ লাখ শিশু এভাবে শিক্ষা পেল। এদের অনেকেই এসএসসি, এইচএসসি এবং ভার্সিটি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। বয়স্ক নিরক্ষরদের জন্য ৫২ হাজার নাইট স্কুল পরিচালনা করে প্রশিকা। ‘৭৮ সালে শুরু করা এই কার্যক্রমে ২০ লাখের বেশি নারী-পুরুষ লিখতে, পড়তে ও সহজ অংক করতে শেখে।

১৯৭৬ থেকে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত সারাদেশে ২৭ হাজার গ্রামে এক লাখ ৫০ হাজার সমিতি গঠন করা হলো। ২৩০টি শাখা অফিসের মাধ্যমে এক কোটি মানুষ প্রশিকার উপকারভোগী।

চেতনাগত ক্ষমতায়ন ও ব্যবহারিক কাজের মধ্য দিয়ে তাদের বোঝাতে সক্ষম হই কেন তারা দরিদ্র। সেটা বোঝানোর জন্যই প্রশিকা মানবিক উন্নয়নকেন্দ্র। যখন মানুষের ভুল ভেঙে যায়, তারা তখন ভুল ভাঙাতেও পারে।  

 

“আমাদের দেশে ছোট দলগুলো যে ভোট পায়,
সেসব ভোট নষ্ট হয়ে যায়।
উন্নত বিশ্বে ৫ শতাংশের ওপরে যত শতাংশ ভোট পায় তত শতাংশ আসনে অংশ নিতে পারে।
বাংলাদেশেরও সে প্রক্রিয়ায় যাওয়া উচিৎ”

 

বাংলানিউজ: জীবনের এই মুহুর্তে এসে অনেক কিছু পেয়েছেন। নানা অভিজ্ঞতা ও অর্জনে আপনার জীবনপাত্র পূর্ণ। আগামী প্রজন্মের যাঁরা নেতৃত্ব দেবেন সেই মানুষদের জন্য এবং বাংলাদেশের সকল মানুষের জন্য আপনার কি বলার আছে? 

ড. কাজী ফারুক: প্রথমে আমি বলবো, বাংলাদেশের অনেক উন্নয়ন হয়েছে, গণতন্ত্রের অনেক বিকাশ হয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে গণতন্ত্রের কিছু সীমাবদ্ধতা এখনও রয়ে গেছে। গণতন্ত্র পূর্ণাঙ্গ রূপ পাচ্ছে না। জার্মানি, ফ্রান্সের নির্বাচনে দুইবার রানআপ হয়। ৫০ শতাংশের নিচে যারা ভোট পাবে তাদের মধ্যে রানআপ হবে। সেখানে প্রথম ও দ্বিতীয় যারা হবে তাদের মধ্যে আবার রানআপ হবে। সেখানে যে জিতবে সে সরকার গঠন করবে। ফলে মাইনরিটিরনয়, বরং মেজরিটিরই বিজয় হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এখানে মাইনরিটিরই বিজয় হচ্ছে। ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েও জিতে যাচ্ছে। এই সীমাবদ্ধতা দূর করতে জার্মানি-ফ্রান্সের মতো দ্বিতীয় দফার নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যেতে হবে।  

এছাড়া আমাদের দেশে ছোট দলগুলো যে ভোট পায়, সেসব ভোট নষ্ট হয়ে যায়। উন্নত বিশ্বে ৫ শতাংশের ওপরে যত শতাংশ ভোট পায় তত শতাংশ আসনে অংশ নিতে পারে। বাংলাদেশেরও সে প্রক্রিয়ায় যাওয়া উচিৎ। তাহলে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে এবং প্রতিটা মানুষের মতামত স্বীকৃতি ও মর্যাদা পাবে। গণতন্ত্রকে আরো উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে।  গণতন্ত্র বিকাশের সুফল মানুষের কাছ বরাবর পৌঁছে দিতে হবে। নতুন প্রজন্মের কাছে এটাই আমার বলবার কথা।  

 

 

আরো একটা বিষয় আছে, আমাদের দেশে (সেটা উন্নত বিশ্বেও আছে),  সেটা হলো ধনীদের শাসন। দেশে যাদের টাকা আছে তাদেরই নমিনেশন দিচ্ছে বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ সকল রাজনৈতিক দল। আর যাদের টাকা নেই তাঁরা জনপ্রিয় হওয়ার পরও তাঁদের নমিনেশন দেওয়া হয় না। ফলে সংসদে ধনী লোকেদের প্রাধান্যে প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চাটাও সেভাবে হচ্ছে না, হতে পারছে না। এজন্য আমার অভিমত হচ্ছে, সব দলের  এমন ৩০ শতাংশ নেতাকে নমিনেশন দিতে হবে, যাদের টাকা নেই কিন্তু বিপুল জনপ্রিয়তা, জনসম্পৃক্ততা আছে। এ-ধরনের একটি প্রস্তাবও আমি দিয়েছিলাম। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে একটি ফান্ড করে দিতে হবে। বিভিন্ন দল থেকে যাঁরা এমপি নির্বাচন করবেন তাঁদের ৪০ লাখ টাকা করে দেওয়া হবে এবং যাঁরা স্থানীয় সরকার নির্বাচন করবেন তাঁদের ২০ লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। যাঁদের টাকা পয়সা নেই তাঁরাও সুযোগ পাবেন। এতে করে যাঁরা জনগণের প্রকৃত সেবক হয়ে রাজনীতি করছেন, তাঁরা সুযোগ পাবেন। এটা করতে ৫০০ কোটি টাকার বেশি লাগবে না। এটা খুব সহজেই করতে পারা যায়। আমি এই পরামর্শই দেব।  

বাংলানিউজ: ব্যক্তিগত জীবনের অর্জন ও ভালোলাগা নিয়ে কিছু বলবেন?

ড. কাজী ফারুক:  আমার জন্ম খুলনায়। আমার শৈশবের স্কুল ছিল খুলনা ভিক্টোরিয়া প্রাইমারি স্কুল। সেখানেই আমি পড়াশোনা করেছি। সেখান থেকে খুলনা জেলা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হই। তারপর খুলনা সেন্ট জোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। সেখান থেকেই ম্যাট্রিকুলেশন। আমাদের সময় প্রথম এসএসসি পরীক্ষা হয়। ১৯৬৩ সালে এসএসসি পাস করে ঢাকার নটরডেম কলেজে ভর্তি হই। ১৯৬৫ সালে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে ভর্তি হই।

আমি ক্রিকেট, টেবিল টেনিস, বাস্কেট বল, ভলিবল ভালো খেলতে পারতাম। বক্সিংয়েও খুব ভালো ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেনটাম ওয়েটে রানর্স আপ হই। এছাড়া সব ধরনের খেলা খেলতাম। নটরডেমে ডিবেটিং করতাম। টেলিভিশনে সাধারণ জ্ঞানের যে সকল কুইজ প্রতিযোগিতা হতো সেখানে প্রথম হতাম। আর অল পাকিস্তান প্রতিযোগিতায় রানার্স আপ হয় আমাদের ইকবাল হল। রচনাও ভালো লিখতাম। আবৃত্তিও ভালো করতাম।  

১৯৭৫ সালের ১৮ মার্চ পারিবারিকভাবে শাহানা আহম্মদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই। আমার দুই ছেলে কাজী রুবায়েত ও কাজী বুলান্দ মুসাব্বীর এবং মেয়ে রিফাত জাবিন বহ্নি। ছেলেরা স্কলারশিপ নিয়ে দেশের বাইরে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরত এসেছে। এজন্য আমি তাদের নিয়ে গর্ববোধ করি।

রোববার পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব: ‘আগামী ১০ বছরে গ্রামে অর্গানিক কৃষি প্রচলন করবো, সরকারের সহযোগিতা চাই’

বাংলাদেশ সময়: ১২০৩ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০২২
এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।