ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সাক্ষাৎকার

আগামী ১০ বছরে প্রতিটি গ্রামে অর্গানিক কৃষির প্রচলন করব, সরকারকে পাশে চাই

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৬ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০২২
আগামী ১০ বছরে প্রতিটি গ্রামে অর্গানিক কৃষির প্রচলন করব, সরকারকে পাশে চাই

বাংলাদেশের ড. কাজী ফারুক। নামটির সঙ্গে কাউকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই।

দেশের প্রথম এনজিওর চেয়ারম্যান তিনি। মুক্তবুদ্ধির প্রসার, দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাবলম্বী করে তোলা, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই, নারীশিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়তন, মানুষকে অধিকার সচেতন করা,  ভোটাধিকারের পক্ষে মানুষকে সংগঠিত করা, প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো----এই সব নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আপসহীন সংগ্রামের এক কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন তিনি। ৭৫ বছর বয়সে এখনও তারুণ্যে টগবগ।
 

বাংলানিউজের পক্ষ থেকে গত ১৬ জুন বিপুল প্রতিভা ও অভিজ্ঞতার অধিকারী সংগ্রামশীল এই মানুষটির একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। টানা পাঁচ ঘণ্টার এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকার, আড্ডা ও আলাপচারিতায় কাজী ফারুকের জবানীতে উঠে আসে তাঁর জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা। উঠে আসে তার জনবান্ধব কর্মসূচি, দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম ও ভবিষ্যতের নানা স্বপ্ন ও রূপকল্পের কথা।  

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাংলানিউজ সম্পাদক জুয়েল মাজহার, প্রধান প্রতিবেদক ইসমাইল হোসেন ও জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক গৌতম ঘোষ। সঙ্গে ছিলেন জ্যেষ্ঠ ফটো সাংবাদিক জিএম মুজিবুর।   

 



দ্বিতীয় পর্ব
আমি আগেই বলেছি আমার একটা ভিশন, একটা দুর্মর স্বপ্ন রয়েছে। সেটা হলো, প্রশিকার মাধ্যমে সারাদেশে আমি অর্গানিক কৃষির প্রচলন করতে চাই। এই কৃষি প্রচলনের মধ্য দিয়ে আমি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের দুয়ারে বিষমুক্ত খাদ্য পৌঁছে দিতে চাই। এর জন্য ১০ বছরের একটা কর্মসূচি নিয়েছি৷ সেজন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি। এবার বলুন, এ বিষয়ে কী জানতে চান।

বাংলানিউজ: প্রশিকা মূলত হতদরিদ্র, অবহেলিত আর সত্যিকার অর্থে দুস্থ মানুষদের নিয়ে কাজ করে। এই সমাজসেবামূলক কাজের ফাঁকে বাংলাদেশে অর্গানিক কৃষি প্রচলনের আইডিয়াটি কীভাবে আপনার মাথায় এলো? 

ড. কাজী ফারুক:  দেশের বিভিন্ন গ্রামে কাজ করার সময় সমিতির সদস্যরা বলতে থাকলো, বছর-বছর রাসায়নিক সার ব্যবহার করেও আর আগের মতো ফসল পাই না। নদী-খাল-বিলে আগের মতো মাছও পাই না। আমি রসায়নের ছাত্র ছিলাম, অর্গানিক রসায়নে সর্বোচ্চ নম্বর পাই। আমি বুঝতে পারলাম মাটি উর্বরতাগুণ হারিয়ে ফেলেছে, পানি দূষিত হয়ে পড়েছে এবং পরিবেশের ভারসাম্যটাই নষ্ট হয়ে গেছে। জৈব সার ও জৈব কীটনাশক ব্যবহার করলে ধীরে ধীরে পরিবেশের ভারসাম্য ফিরে আসবে, ফসল বিষমুক্ত হবে এবং ফসলের উৎপাদন বেড়ে যাবে। মাটি ও পানিকে ক্ষতিকর কীটনাশকের বিষচক্র থেকে মুক্ত করে মানুষ ও পশুপাখির জীবনকে নিরাপদ করতে ১৯৭৫ সনে মানিকগঞ্জের কইট্টা গ্রামে ১ লাখ টাকায় ৭ একর জমি কিনলাম। সেখানে প্রশিক্ষণ সেন্টার স্থাপন করে অর্গানিক কৃষি শুরু করলাম। অর্গানিক কৃষিতে উল্লেখ্যযোগ্য সাফল্যের জন্য ১৯৭৮ সালে কানাডার মন্ট্রিয়লে আইএফওএএম (ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব অর্গ্যানিক এগ্রিকালচার মুভমেন্ট) -এর সেমিনারে আমন্ত্রণ পেলাম। আমরা অর্গানিক কৃষি শুরু করার পর দেশের কয়েকজন কৃষিবিজ্ঞানী বাঁকা সুরে বললেন, আপনি তো দেখছি দেশে দুর্ভিক্ষ ডেকে আনবেন! কিন্তু সত্যিটা হলো, ২০০০ সালে অর্গ্যানিক কৃষির জন্য বঙ্গবন্ধু কৃষি-স্বর্ণপদক লাভ করি।  

 

“আমরা অর্গানিক কৃষি শুরু করার পর
দেশের কয়েকজন কৃষিবিজ্ঞানী বাঁকা সুরে বললেন,
‘আপনি তো দেখছি দেশে দুর্ভিক্ষ ডেকে আনবেন!’
কিন্তু সত্যিটা হলো, ২০০০ সালে অর্গ্যানিক কৃষির জন্য বঙ্গবন্ধু কৃষি-স্বর্ণপদক লাভ করি”

 

বাংলানিউজ: দেশের প্রতিটি এলাকায় অর্গানিক কৃষি পৌঁছে দিতে আপনার ভিশন কি?

ড. কাজী ফারুক:  আমাদের দেশের মানুষের সামনে এখন প্রধান সমস্যাটি হচ্ছে বিষাক্ত খাদ্য। আগামী ১০ বছরের মধ্যে দেশের প্রতিটি গ্রামে অর্গানিক কৃষির প্রচলন করব। কৃষি মন্ত্রণালয় প্রশিকার অর্গানিক সার ল্যাবরেটরি ও মাঠে পরীক্ষা করে অনুমোদন দিয়েছে। জৈব সার ব্যবহার করে উৎপাদন কমেনি বরং ১৫ শতাংশ বেড়েছে। বিপুল খাদ্যচাহিদার কথা মাথায় রেখে ধানের উফসী হাইব্রিড জাত ব্যবহার করে ভাল ফলন পেয়েছি। কৃষকরা বছরে রাসায়নিক সারের ব্যবহার ৩০% কমিয়ে দিয়ে ৩০% অর্গানিক সার ব্যবহার করে মাত্র তিন বছরেই পুরোপুরি অর্গানিক কৃষক হয়ে উঠতে পারবে। তবে, এই তিন বছরে শুরু থেকেই রাসায়নিক কীটনাশক বাদ দিয়ে জৈব কীটনাশক বা জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে।  

 


 

বাংলানিউজ: অর্গানিক কৃষি ছড়িয়ে দিতে আপনার ভিশন কিভাবে বাস্তবায়ন করবেন? 

ড. কাজী ফারুক: রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে কৃষকের জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে।  মানুষের স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ক্যান্সার হচ্ছে, নতুন নতুন রোগের জন্ম হচ্ছে। এজন্য বাংলাদেশের প্রতি গ্রামে ২০-২৫ জন কৃষককে পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তিন বছরে থানা-উপজেলা পর্যায়ে ১৫ লক্ষ কৃষককে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এই কৃষকরা ফিল্ড ডে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গ্রামের অন্য সকল কৃষককে অর্গানিক কৃষি করতে উদ্বুদ্ধ করবে। এভাবে ১০ বছরে প্রায় সকল কৃষক অর্গানিক কৃষি চালু করবে। এভাবে সারাদেশে অর্গানিক কৃষির প্রচলন হবে। বিষমুক্ত খাদ্যও সর্বত্র বিপুল পরিমাণে পাওয়া যাবে। শুরু থেকে এপর্যন্ত ১ লাখের বেশি কৃষককে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। প্রশিকার ৫টি ফার্মে ৬০০ বিঘার মতো জমি আছে। সেখান থেকে কিছু প্রোডাক্ট ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে দিয়েছি। সেখানে ভালো সাড়া পাওয়া গেছে।

 


 

বাংলানিউজ: অর্গানিক কৃষি প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে কোন ধরনের সহায়তা পাচ্ছেন কি? 

ড. কাজী ফারুক: কোনো ব্যাংক থেকে প্রশিকার সম্পদের বিপরীতে যদি পর্যাপ্ত ঋণ পাই তাহলে আমাদের যে পাঁচটি ফার্ম আছে সেখানে এই অর্গানিক কৃষির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করব। কৃষি বলতে শুধু ধান বা শাকসবজির চাষ নয়, বরং মাছ-মাংস-ডিম-দুধ-ফলমূল সবই সেখানে হবে। উৎপাদিত সেসব পণ্য সারাদেশে অর্গানিক কৃষির ৫০টি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মাধ্যমে বাজারজাত করতে চাই।  

 

“জৈব সার ব্যবহার করে উৎপাদন কমেনি বরং ১৫ শতাংশ বেড়েছে...
কৃষকরা বছরে রাসায়নিক সারের ব্যবহার
৩০% কমিয়ে দিয়ে ৩০% অর্গানিক সার ব্যবহার করে
মাত্র তিন বছরেই পুরোপুরি অর্গানিক কৃষক হয়ে উঠতে পারবে”

 

এছাড়াও আমার আরো দুটি ভিশন রয়েছে। একটা হলো প্রশিকা গঠনের শুরু থেকে এ পর্যন্ত বাস্তুভিটার পাশে, রাস্তার দু-ধারে, রেললাইন ও বাঁধের দু-পাশে এবং উজাড় হয়ে যাওয়া বনভূমিতে স্থানীয় সরকার, বনবিভাগ ও রেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি করে ১০ কোটির বেশি গাছ লাগানো হয়েছে। সমিতির সদস্যরা এসব গাছ লাগিয়েছে। পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণও তারাই করেছে। গাছগুলো বিক্রয়যোগ্য হলে চুক্তির আওতায় তারা ৬০% শেয়ারের টাকা পাবে। এতে করে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখা যেমন সম্ভব হয়েছে, পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনও করা গেছে। আগামী ১০ বছরে আরো ২০ কোটি গাছ লাগাতে চাই।

 

আর একটা ভিশন হলো, যারা আমাদের দেশের স্বল্পশিক্ষিত তরুণ, মানে ধরুন যারা এইট পাস বা এসএসসি পাস করেছে তাদের উচ্চশিক্ষার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের জন্য কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র করতে চাই৷ বর্তমানে সারাদেশে আমাদের ৪৫টি বড় মাপের প্রশিক্ষণকেন্দ্র রয়েছে। সেখানে ডাবল শিফটে এলাকার ছেলে-মেয়েদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দিতে চাই। যাতে তারা দেশের ভেতরেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে নিতে পারে। অথবা উদ্যোক্তা হতে পারে বা বিদেশে গিয়ে ভালো বেতনে চাকরি নিতে পারে। এই কাজটা আমরা করতে চাই।

আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ভবন রয়েছে, জমি রয়েছে। শুধু কিছু ফান্ড জোগাড় করতে পারলে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো চালু করতে পারব। এর ফলে দেশে দক্ষ জনবল গড়ে উঠবে। এই হচ্ছে আমার ভিশন। এই স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিয়েই যেন আমি মরতে পারি।

প্রথম পর্ব: প্রশিকা চেয়ারম্যান ড. কাজী ফারুকের সঙ্গে একটি সন্ধ্যা

তৃতীয় পর্ব পড়ুন মঙ্গলবার: প্রশিকা নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে, সরকারের সহযোগিতা চাই

বাংলাদেশ সময়: ১১৪৬ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০২২
এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।