ক্ষুদ্র ও মাঝারি এন্টারপ্রাইজের (এসএমই) উন্নয়নে কাজ করছে এসএমই ফাউন্ডেশন। এ খাতের উদ্যোক্তা উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানটি প্রশিক্ষণ, পণ্য বাজারজাত এবং ক্ষেত্র বিশেষে ঋণও পাইয়ে দিতে সহায়তা করে।
বাংলানিউজ: মেলা শব্দটিকে আবহমান বাংলা সংস্কৃতিকে ধারণ করে উৎসবের পরিবেশে পণ্য উপস্থাপনে ব্যবহৃত হয়। যেখানে লৌকিক ব্যাপার থাকে। আপনারা উৎপাদনকারী ও পণ্যকে তুলে ধরতে এসএমই মেলা করছেন। এ বিষয়ে বলুন।
মফিজুর রহমান: এসএমই মেলাতেও আবহমান কাল থেকে ব্যবহৃত পণ্য, কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পণ্যসামগ্রী ব্যবহার করা হয়। যে ফ্যাশন ও তৈরি কৌশল ব্যবহার করা হয় তার উৎস আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশ। যা মেধাবী উদ্যোক্তাদের হাতের স্পর্শে তৈরি ও বাজারজাত করা হয়।
আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা চমৎকার মানের পণ্য উৎপাদন করে। তাদের সক্ষমতা দেশের ক্রেতা-দর্শনার্থীদের সামনে তুলে ধরতেই এ মেলা। এছাড়া যারা ক্রেতা, পাইকারি ক্রেতা পণ্য কিনে থাকেন, যাতে তারা নিজেরা এসে পণ্য দেখে ক্রয়াদেশ দিতে পারেন, যাতে তারা দেশীয় পণ্য চেনে এবং কিনে নিজেদের শোকেসে সাজিয়ে রাখে। অর্থাৎ আমাদের উদ্যোক্তা ও পণ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। এ জন্যই এসএমই মেলার আয়োজন।
অপরদিকে, উদ্যোক্তাদের নিজেদের মধ্যে কম্পিটিশন তৈরি করে দেওয়া। যাতে তাদের মধ্যে এমন প্রতিযোগিতা তৈরি হয়, একজনের ভালো মানের প্রোডাক্ট দেখে নিজেও তৈরি করতে পারে। এর মধ্য দিয়ে একজনের ক্রেতা, একজনের কাঁচামাল বিনিময় হয়।
সারকথা হলো-বিক্রির উদ্দেশ্যে প্রদর্শন। এর মাধ্যমে বাইরের ক্রেতা আসছে। আরও একটি উদ্দেশ্য হলো আমাদের দেশিও উদ্যোক্তাদের রপ্তারিকারক হিসেবে তৈরি করা। যাতে আমাদের রপ্তানি, রপ্তানি আয়ের বাস্কেটে বৈদেশিক মুদ্রা যোগ করতে ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলানিউজ: সে উদ্দেশ্য কী এসএমই মেলা পূরণ করতে পারছে?
মফিজুর রহমান: হ্যাঁ। মেলাতে নতুন ক্রেতা ও কার্যাদেশ পায়; নতুন নতুন ধারণা পায়। এসব কথা বিবেচনা করে মেলার পরিধি ও সময় বাড়ানো হয়েছে। গত মেলায় স্টলের সংখ্যা ছিল তিনশ’র মতো। স্টলের সংখ্যা বাড়িয়ে ৩৫১টি করা হয়েছে।
উদ্দেশ্য পূরণে এসএমই উদ্যোক্তাদের আমরা ট্রেনিং দিচ্ছি। টিএফও নামে কানাডিয়ান একটি প্রতিষ্ঠানের সহায়তার এ ট্রেনিং হচ্ছে। আগামী দুই বছরে ৩০ জন উদ্যোক্তা দেশীয় পাট থেকে পাটজাত পণ্য, বাঁশ ও বেত থেকে আড়াই মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করতে পারে, সে রকম করে প্রস্তুত করছি। এবং আগামী বছরে দুটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী একটি নিউইয়র্ক এবং আরেকটি টরেন্টোতে। এতে অংশগ্রহণ করবেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। এভাবে তারা রপ্তানিকারক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
বাংলানিউজ: আমাদের রপ্তানি আয় তৈরি পোশাক নির্ভর। এ উদ্দেশ্য সফল করতে পারলে একপণ্য রপ্তানি নির্ভরতা কমবে, রপ্তানি বহুমুখী করা যাবে?
মফিজুর রহমান: আমরা এসএমই-এর কথা বলছি। আমাদের মেলায় তৈরি পোশাক আসে না। সবই এসএমই উদ্যোক্তা, যারা ঘরে বসে ফ্যাশন ডিজাইন করে, বুটিক করে, লেদার পণ্য তৈরি করে, পাট ও পাটজাত পণ্য তৈরি করে। তারা খুবই ভালো মানের পণ্য তৈরি করে। এ সব পণ্য রপ্তানি উপযোগী করাই আমাদের লক্ষ্য।
আমরা এখন যে দোকানেরে সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বাঁশ তৈরি পণ্যের দোকান। বাঁশের ব্যবহার করে এত সুন্দর পণ্য হতে পারে, আমরা না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না। এসব পণ্য রপ্তানি করতে আমরা উৎসাহিত করবো। রপ্তানি বহুমুখীকরণে এভাবে আমরা এসএমইকে তৈরি করছি।
বাংলানিউজ: এসএমই খাতের নতুন উদ্যোক্তাদের দীর্ঘদিনের সমস্যা পণ্য উৎপাদনের পর বাজারজাত সমস্যা। বাজারজাতকরণে উদ্যোগ কি?
মফিজুর রহমান: বাজারজাতকরণে আমরা কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। একটি হলো- ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করি। এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তিনটি মেলা করেছি। উদ্যোক্তারা পণ্য নিয়ে আসে; কর্পোরেট-ক্রেতা স্বপ্ন আসে, আড়ং আছে, এছাড়াও আরও যেসব চেইন সুপার থাকে তারা এসব মেলায় উপস্থিত থাকে। পণ্য ক্লাস্টারের লোকজনও মেলায় থাকে। একটি ক্লাস্টারের লোকজন আরেকটি ক্লাস্টারের লোকজনের সঙ্গে মিলিত হয়। তারা পারস্পারিক যোগাযোগের মাধ্যমে পণ্য ও কাঁচামাল দেখে, দরদাম ঠিক করে, বেচা-কেনা করে। জাতীয় ও আঞ্চলিক মেলার মাধ্যমে এগুলো করে থাকে। এটা হলো তার একটি।
আরেকটি আন্তর্জাতিক হলো ব্যবস্থা। আন্তর্জাতিক যেসব এসএমই পণ্যের মেলা অনুষ্ঠিত হয় সেখানে আমাদের উদ্যোক্তাদের পণ্য প্রদর্শনের জন্য সুযোগ করে দেই। এটা হয়তো বেশি না। বাছাই করা উদ্যোক্তার পণ্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা করি। যেসব পণ্যের সম্ভাবনা আছে, ব্যতিক্রমী সেগুলো আন্তর্জাতিক মেলাগুলোতে প্রদর্শনের মাধ্যমে মার্কেটিংয়ের ব্যবস্থা করি। এবারও ২০ জনকে পাঠানো হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে যাওয়ার কথা কোলকাতায়। এভাবে উদ্যোক্তাদের পণ্য বিদেশি ক্রেতাদের কাছে উপস্থাপনের মাধ্যমে ক্রেতা অনুসন্ধানে সহায়তা করা হয়। এক্ষেত্রে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোও সহযোগিতা করে থাকে। এভাবে আমরা উদ্যোক্তাদের পণ্য বাজারজাত ও রপ্তানিকারক হিসেবে তৈরি করার জন্য কাজ করছি।
বাংলানিউজ: এবার মেলাতে ১১টি ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্টল আছে। উদ্যোক্তাদের অভিযোগ হলো, প্রয়োজনে ঋণ পাওয়া যায় না, নানা রকম প্রতিবন্ধকতার তৈরি করে? এ বিষয়ে কি বলবেন?
মফিজুর রহমান: একটি ভালো প্রসঙ্গ তুলেছেন। এ মেলাতে উদ্যোক্তা দেখছেন, এখানে ৬০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা। ব্যাংকের বেশি কমপ্লায়েন্টের কারণে নারী উদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণ পায় না। এখানে ব্যাংকগুলোতে রাখার উদ্দেশ্য হলো কোনো উদ্যোক্তা বা নারী উদ্যোক্তার ঋণের প্রয়োজন হলে যাতে ব্যাংকের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতে পারে। কোন ব্যাংকে বলতে পারে আমাদের স্টলে আসেন, আমাদের পণ্য দেখেন। প্রয়োজনে ঋণের কথা বলবে। এভাবে আমরা এ মেলাতে ব্যাংকারের সঙ্গে উদ্যোক্তাদের সম্পর্ক তৈরি করে দিচ্ছি। মেলায় ব্যাংক থাকার কারণে বেশি সংখ্যক উদ্যোক্তা ঋণ সম্পর্কিত সেবার আওতায় আসবে।
বাংলানিউজ: উদ্যোক্তা তৈরি এসএমই কতটুকু ভূমিকা রাখছে, প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে বলেন মনে করছেন?
মফিজুর রহমান: আমাদের সীমিত সাধ্য। ২০০৭/৮ সালে আমাদের ২০০ কোটি টাকা দিয়েছিল। সে টাকা বিনিয়োগ করে সেখান থেকে যে বেনিফিট আসে তা দিয়ে আমাদের রাজস্ব ব্যয়সহ বিভিন্ন ধরনের ব্যয় সামাল দিতে হয়। সীমিত সাধ্য দিয়েই আমরা চেষ্টা করছি। প্রশিক্ষণ দেই, উদ্যোক্তা তৈরি হয়। কিছু কিছু এক্সপোর্টার হিসেবেও বের হয়ে আসছে।
বাংলানিউজ: মেলা উদ্যোক্তারা কিভাবে নেয় ?
মফিজুর রহমান: মেলে দেখেই বুঝতে পারছেন একটা সাজ সাজ রব। উৎসবের পরিবেশ বিরাজ করছে। সারাদিনেই ক্রেতারা আসছে। বিকেলে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেলা প্রাঙ্গণ ভরে যায়। শুক্রবার মেলায় তিল ধরার ঠাঁই থাকে না। আর উদ্যোক্তারা এসএমই মেলার জন্য মুখিয়ে থাকে। তারা সারা বছর মেলার জন্য প্রস্তুত করে। মেলায় নিজেদের শ্রেষ্ঠ পণ্যটি উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত হয়। যার মধ্য দিয়ে যেমন ক্রেতা পায়, অন্যান্য পণ্যের সঙ্গেও নিজেদের সক্ষমতার তুলনা করার সুযোগ তৈরি হয়।
বাংলানিউজ: মেলায় বিক্রি বা ক্রয়াদেশের ব্যাপারে কি বলবেন ?
মফিজুর রহমান: গতবার মেলাতে ১৭কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছিল। ক্রয়াদেশ পাওয়া গিয়েছিল ১১ কোটি টাকার। ২০২০ ও ১০২১ সালে বাধা নিষেদের মধ্যেও এ বিক্রি ও ক্রয়াদেশ পাওয়া গিয়েছিল। এবার স্বাভাবিক পরিবেশে মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আশা করছি গত বছরের দ্বিগুণ বিক্রি ও কার্যাদেশ পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৮ ঘণ্টা, ২৬ নভেম্বর , ২০২২ :
জেডএ/জেএইচ