ইসলাম মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। সাধারণভাবে ইসলাম নিজের বা অন্যের ব্যক্তিগত তথ্য গোপন করার নির্দেশ দেয়।
তথ্য আমানত: তথ্য মানুষের পারস্পরিক আমানত। সুতরাং মুমিনের উচিত সেই আমানত রক্ষায় মনোযোগী হওয়া। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সব বৈঠক আমানতস্বরূপ। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৬৯)
কোনো তথ্যই গুরুত্বহীন নয়: মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের কোনো তথ্যই মূল্যহীন নয়, বরং সময়ের ব্যবধানে সামান্য তথ্য মানুষকে ঘায়েল করার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) বলেন, তোমার গোপন তথ্য তোমার বন্দিস্বরূপ। যখন তুমি তা প্রকাশ করে দিলে, তখন তুমি তার বন্দিতে পরিণত হলে। (আদাবুদ দুনিয়া ওয়াদ দ্বিন, পৃষ্ঠা ৩০৬)
ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করা: ইসলাম সাধারণভাবে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও তা প্রচারের অনুমতি দেয় না। তবে আইন-শৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা যদি অপরাধী শনাক্ত করতে, সমাজের অপরাধপ্রবণতা দূর করতে এবং দেশ-জাতির বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র রুখে দিতে কারো ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করেন, তবে প্রয়োজনমাফিক তার অনুমতি আছে।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমরা বেশির ভাগ অনুমান থেকে দূরে থাকো। কেননা অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপ। তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় সন্ধান কোরো না এবং একে অপরের পেছনে নিন্দা কোরো না। ’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১২)
একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশযোগ্য নয়: একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য চাই সেটা নিজের হোক বা অন্যের, তা প্রকাশযোগ্য নয়। যেমন মানুষের দাম্পত্যজীবন একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়।
ইসলাম ব্যক্তিকে তার দাম্পত্যজীবনের তথ্য প্রকাশের অনুমতি দেয়নি। রাসুল (সা.) বলেন, নিশ্চয়ই কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাধিক নিকৃষ্ট ব্যক্তি সেই পুরুষ, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে একান্তে মিলিত হয় এবং স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে মিলিত হয়, অতঃপর তার রহস্য প্রকাশ করে দেয়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৪৩৭)
পাপের প্রচার নিষিদ্ধ: পাপকাজ, তাই সেটা নিজের হোক বা অন্যের হোক, ইসলাম তা প্রচার করতে নিষেধ করেছে। যেমন নিজের পাপ প্রকাশের ব্যাপারে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তাআলা মুমিনের নিকটবর্তী হবেন, অতঃপর তার ওপর পর্দা ফেলে তাকে ঢেকে নেবেন এবং বলবেন, মনে পড়ে অমুক পাপ, মনে পড়ে অমুক পাপ? সে বলবে—হ্যাঁ, হে আমার প্রতিপালক, অবশেষে সে যখন তার সব পাপ স্বীকার করবে এবং নিজেকে মনে করবে যে সে ধ্বংস হয়ে গেছে, আল্লাহ বলবেন— তোমার ওপর দুনিয়ায় এসব গোপন রেখেছি, আজ আমি তা তোমার জন্য ক্ষমা করে দিচ্ছি। অতঃপর তাকে তার নেক আমলের দপ্তর দেওয়া হবে, পক্ষান্তরে অবিশ্বাসী ও মোনাফেক সম্পর্কে সাক্ষীরা বলবে, এরা তাদের রবের ওপর মিথ্যারোপ করেছিল, জেনে রেখো জালিমদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৪৪১)
অন্যের তথ্য প্রকাশের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যেকোনো মুসলমানের দোষ গোপন করে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন করবেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৫)
অন্যের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন নয়: ইসলাম কারো ব্যক্তিগত জীবনের সুরক্ষা ও গোপনীয় লঙ্ঘনের ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। এমন কাজ থেকে নিষেধ করেছে, যাতে অন্যের ব্যক্তিগত গোপনীয় লঙ্ঘিত হয়। যেমন ইসলাম অনুমতি ছাড়া অন্যের ঘরে প্রবেশ করতে নিষেধ করে। বিশেষত বিশ্রামের সময়ে যখন মানুষ ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ব্যাপারে অসতর্ক থাকতে পারে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীরা এবং তোমাদের মধ্যে যারা বয়ঃপ্রাপ্ত হয়নি, তারা যেন তোমাদের কক্ষে প্রবেশ করতে তিন সময়ে অনুমতি গ্রহণ করে—ফজরের নামাজের আগে, দ্বিপ্রহরে যখন তোমরা তোমাদের পোশাক খুলে রাখো তখন এবং এশার নামাজের পর; এই তিন সময় তোমাদের গোপনীয়তার সময়। ’ (সুরা : নুর, আয়াত : ৫৮)
সাহাল ইবনে সাদ (রা.) বলেন, একবার এক লোক রাসুল (সা.)-এর কোনো এক কক্ষে উঁকি দেয়। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে একটা ‘মিদরা’ (চিরুনিবিশেষ) ছিল, যা দিয়ে তিনি তাঁর মাথা চুলকাচ্ছিলেন। তখন তিনি বলেন, যদি আমি জানতাম তুমি উঁকি দিচ্ছ, তাহলে এটা দিয়ে তোমার চোখ ফুঁড়ে দিতাম। তাকানোর জন্য অনুমতি গ্রহণের বিধান দেওয়া হয়েছে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬২৪১)
যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য প্রকাশ: কখনো কখনো মানুষকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে, সমাজ ও জাতির স্বার্থে তথ্য প্রকাশের প্রয়োজন হয়। ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থার বিধান অনুসারে কারো ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করতে হবে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বা সরাসরি বিষয়টির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কাছে। সাধারণ সমাজে তা প্রচার করা যাবে না। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন শান্তি বা শঙ্কার কোনো সংবাদ তাদের কাছে আসে, তখন তারা তা প্রচার করে থাকে। যদি তারা তা রাসুল বা তাদের মধ্যে যারা ক্ষমতার অধিকারী তাদের গোচরে আনত, তবে তাদের মধ্যে যারা তথ্য অনুসন্ধান করে, তারা তার যথার্থতা নির্ণয় করতে পারত। তোমাদের প্রতি যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকত, তবে তোমাদের অল্পসংখ্যক ছাড়া সবাই শয়তানের অনুসরণ করত। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৮৩)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বলল, আমি একজন আনসারি মেয়েকে বিয়ে করতে চাচ্ছি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, মেয়েটিকে দেখে নাও। কেননা আনসারিদের চোখে আবার সমস্যা থাকে। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৩২৪৭)
ব্যক্তিগত তথ্য গ্রহণে আদালতের সতর্কতা: মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য গ্রহণে আদালতকে সর্বোচ্চ সতর্কতার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। যদি কেউ কোরো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেশ করে এবং যথাযথভাবে তা প্রমাণ করতে না পারে, তবে তার ব্যাপারে কোরআনের নির্দেশ হলো, ‘যারা সাধ্বী রমণীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে এবং চারজন সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদের ৮০টি বেত্রাঘাত করবে। কখনো তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না; এরাই সত্যত্যাগী। ’ (সুরা : নুর, আয়াত : ৪)
ভিত্তিহীন তথ্যের প্রচার নয়: কোনো তথ্য সমাজে প্রচার পেয়ে গেলেই তা প্রচার করা উচিত নয়। কেননা সমাজে প্রচারিত বহু তথ্যই ভিত্তিহীন হয়ে থাকে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন তারা এটা শুনল, তখন মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা আপন লোকদের সম্পর্কে কেন ভালো ধারণা করল না এবং বলল না, এটা তো সুস্পষ্ট অপবাদ। ’ (সুরা : নুর, আয়াত : ১২)
আল্লাহ সবাইকে অন্যের তথ্য প্রকাশের প্রবণতা থেকে রক্ষা করুন, আমিন।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩২ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৩, ২০২৪
এএটি