ঢাকা, শনিবার, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

সত্য ও সততা

তামীম রায়হান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৩
সত্য ও সততা

বক্তৃতা করছেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। অথচ নামাজের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।

শ্রোতাদের একজন দাঁড়িয়ে বলল, মহামান্য মহারাজ! এখন নামাজ। আপনার কিংবা আমার কারোর জন্যই সময় অপেক্ষা করবে না। আর নামাজ আদায়ে অবহেলা আল্লাহ পাকও ক্ষমা করবেন না।

ভরা সমাবেশে হাজ্জাজের মুখের ওপর তাকে উপদেশ! হাজ্জাজ লোকটিকে বন্দি করার আদেশ দিলেন।

বন্দি লোকটির স্বজনরা হাজ্জাজের সঙ্গে এসে দেখা করে মিনতি জানাল, এ লোকটির মাথায় কিঞ্চিত দোষ আছে। তাই এমন বেয়াদবি করেছে। হাজ্জাজ তাদের জানালেন, সে যদি আমার সামনে নিজের পাগলামির কথা স্বীকার করে, তবে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। স্বজনরা দৌড়ে গিয়ে বন্দি লোকটিকে এ প্রস্তাবের কথা জানাল। কিন্তু বন্দি লোকটি এমন সুযোগের কথা শুনে বেঁকে বসল। বললো, না না আমি পারবো না। আল্লাহ আমাকে সম্পূর্ণ সুস্থ রেখেছেন। সুস্থতার এমন নেয়ামতকে লুকিয়ে মিথ্যা বলে আমি মুক্তি চাইনা হাজ্জাজের কাছ থেকে। হাজ্জাজের কাছে বেচারার সরল সত্যবাদিতার খবর পৌঁছলো। প্রজার এমন সততা তাকে মুগ্ধ করলো। তিনি তাকে মুক্ত করে দিলেন।

সত্য কথায় মুক্তি মেলে-যুগ যুগ ধরে প্রচলিত প্রবাদ বাক্যের পেছনে এটিও ছোট্ট একটি ঘটনা। যদিও আজ থেকে চৌদ্দশ’ বছর আগে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে গেছেন, সত্য মানুষকে পূণ্যের দিকে ধাবমান করে, আর পূণ্য তাকে জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। মিথ্যা পাপাচারকে ডেকে আনে আর পাপাচার জাহান্নামে পৌঁছে দেয়। কোনো মানুষ যখন অনবরত মিথ্যা বলে তখন আল্লাহ পাকের কাছে সে মিথ্যাবাদী হিসেবে লিখিত হয়ে যায়। (বুখারি ও মুসলিম)

হজরত হাসান ইবনে আলী (রা.) বলেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে শিখেছি, সন্দেহযুক্ত বস্তু ছেড়ে দিয়ে সন্দেহমুক্ত বিষয়ের প্রতি আগ্রহী হও। কারণ সত্যে প্রশান্তি আর মিথ্যায় অস্বস্তি। (তিরমিযি)
সত্য, সততা ও সত্যবাদিতার প্রতি আদেশ করে আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে বলেছেন, হে ঈমানদাররা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো। (তওবা-১১৯)

আমাদের এ সমাজ-সংসারে শান্তি, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে হাতেগোনা যে কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে সবার নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে হবে, সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে সততা। শুধু ইসলাম বলে নয়, সব ধর্মে এ সততা এবং সত্যবাদিতার প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে। সর্বকালে সর্বত্র মিথ্যা নিন্দিত ও পরিত্যজ্য। এমনকি কোনো জঘন্য মিথ্যাবাদীও তার সঙ্গে কেউ মিথ্যা বলুক, তা মেনে নিতে চায় না। ইসলাম গ্রহণের আগে মক্কার আবু সুফিয়ান যখন শামে ব্যবসার কাজে অবস্থান করছিলেন, তখন রোমের বাদশাহ হিরাকল তাকে তার সঙ্গীসহ ডেকে পাঠান। আবু সুফিয়ান সেখানে উপস্থিত হওয়ার পর বাদশাহ হিরাকল তার কাছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে নানা প্রশ্ন জানতে চাইলেন। হিরাকল আবু সুফিয়ানের সঙ্গীদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে আবু সুফিয়ান কোনো মিথ্যা বললে তোমরা আমাকে জানাবে। পরবর্তীকালে আবু সুফিয়ান এ ঘটনা উল্লেখ করে বলতেন, সেদিন যদি মিথ্যা কোনো লজ্জার বিষয় না হতো তবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে হিরাকলের কাছে ইচ্ছাকৃত অসত্য তথ্য বলে আসতাম।

মক্কার জাহেলি যুগেও ইসলামপূর্ব সময়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুমহান ব্যক্তিত্ব সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল কেবল তার সততা ও বিশ্বস্ততার গুণে। নবুওয়াত প্রাপ্তির পরও মক্কার লোকেরা তাঁর কাছে নিজেদের আমানত গচ্ছিত রাখত এবং সেসব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আসার জন্যই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরতের রাতে হজরত আলীকে (রা.) তার বিছানায় রেখে এসেছিলেন। আমৃত্যু তিনি তার সঙ্গী-সহচর সাহাবায়ে কেরামকে জীবনের সর্বত্র সত্য ও সততার অনুশীলনের প্রতি তাগিদ দিয়ে গেছেন।

ইমাম আহমদের বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা আমাকে ছয়টি বিষয়ের নিশ্চয়তা দাও, বিনিময়ে আমি তোমাদের জান্নাতের নিশ্চয়তা দিচ্ছি। এ ছয়টি বিষয় হলো-কথা বলার সময় সত্য বলবে, ওয়াদা করলে তা রক্ষা করবে, কেউ আমানত রাখলে তা ফেরত দেবে, নিজেদের লজ্জাস্থানকে সংযত রাখবে, দৃষ্টি অবনত রাখবে ও অন্যায় থেকে হাত গুটিয়ে রাখবে।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পবিত্র জীবনের প্রতিটি কথা ও কাজে সততা বজায় রেখে চলেছেন। এমনকি হাসি-কৌতুকেও তিনি কখনো কোনো মিথ্যার আশ্রয় নেননি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কোনো অবস্থাতেই মিথ্যা বলেননি। সিরাতের কিতাবসমূহে বর্ণিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যবাদিতার অজস্র বিস্ময়কর ঘটনা আজও আমাদের জন্য সততার অনুপম অনুপ্রেরণা।
 
বর্তমানে অফিস-আদালত থেকে শুরু করে বাজারের পান দোকানেও মিথ্যার ছড়াছড়ি। মিটিং-সমাবেশ থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লার আড্ডায়ও অহরহ মিথ্যা গালগল্প বলা হচ্ছে, শোনা হচ্ছে। সামান্য দু’পয়সা লাভের জন্য দেদারসে মিথ্যা কথা বলছে ব্যবসায়ীরা। ভোটের জন্য মিথ্যা বলছে রাজনীতিবিদরা। মামলায় মক্কেলকে জেতাতে মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন উকিলরা, সেবাপ্রার্থীকে ফাঁসাতে ফাইল আটকে রেখে মিথ্যা অজুহাত দেখাচ্ছেন অফিসকর্মীরা। একটি মিথ্যা থেকে জন্ম নিচ্ছে অজস্র মিথ্যা। মিথ্যার এমন কদর্য সয়লাবে ভেসে যাচ্ছে সত্যের সৌন্দর, শান্তি ও নিরাপত্তা।

যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে আমরা উম্মতে মুহাম্মদী, যে ইসলামের নামে আমরা মুসলমান, আমরা কি পারি না- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুপম চরিত্র ও আদর্শের অসংখ্য গুণাবলী থেকে এ ছোট্ট গুণটির প্রতি যত্নবান হতে? সত্যের শপথে বলীয়ান হয়ে সততায় ঘেরা সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখতে? মুসলমান বলে নয়, মানুষ হিসেবে স্বস্তি ও প্রশান্তির জন্য আজকের অস্থির সময়ে সত্যবাদিতার যে ভীষণ প্রয়োজন!

লেখক-শিক্ষার্থী, কাতার
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ০৮০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৩
সম্পাদনা: শিমুল সুলতানা, অ্যাক্টিং কান্ট্রি এডিটর
ইসলাম ডেস্ক মেইল: [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।