ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র ধর্ম। ইসলামের অন্তর্নিহিত সত্য সুফীবাদ।
সুফীবাদ চর্চার দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তরীকা বিকাশ লাভ করে, যেমন: কাদেরীয়া, চিশতিয়া, সোহরাওয়ার্দীয়া, নকশন্দীয়া, মুজাদ্দেদীয়া ইত্যাদি। হযরত শাহ সুফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (ক.) আল্লাহর নৈকট্য লাভের সহজ পন্থা মাইজভাণ্ডারী তরীকার প্রবর্তন করেন। এই তরীকা আচার ধর্ম পালনের সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক পরিশুদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়।
জন্ম ও বংশ পরিচয়: গাউছুল আজম হযরতশাহ সুফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (ক.) আওলাদে রাসুল ছিলেন। তার পূর্বপুরুষ সৈয়দ হামিদ উদ্দীন গৌড়ি ১৫৭৫ সালে ইসলাম প্রচারের মানসে চট্টগ্রামের পটিয়া থানার কাঞ্চননগরে এসে বসতি স্থাপন করেন। তারই বংশধর মওলানা সৈয়দ মতিউল্লাহর পবিত্র ঔরসে বাংলা ১২৩৩ সালের (হিজরী ১২৪৪ ও ইংরেজি ১৮২৬ সাল) পহেলা মাঘ বুধবার জোহর নামাজের সময় হযরতশাহ সুফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (ক.) জন্মগ্রহণ করেন। তার মায়ের নাম সৈয়দা খায়েরউন্নেছা বিবি।
বিদ্যার্জন: চার বছর বয়সে গ্রাম্য মক্তবে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। হিজরী ১২৬০ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার্থে কলকাতা যান। ১২৬৮ হিজরীতে তিনি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার শেষ পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করেন। এই সময় তিনি হাদিস, তাফসীর, ফেকাহ, মানতিক, বালাগাত, উছুল, আক্বায়েদ, ফালছাফা, ফরায়েজ ইত্যাদি শাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শীতা অর্জন করেন।
কর্মজীবন: হিজরী ১২৬৯ সালে তিনি যশোর জেলায় কাজী (বিচারক) পদে যোগদান করেন। ১২৭০ হিজরীতে কাজী পদ থেকে পদত্যাগ করে কলকাতার মুন্সি বু-আলী মাদ্রাসায় প্রধান মোদার্রেছের পদে যোগদান করেন। তার চারিত্রিক গুণাবলী ও জ্ঞানের ব্যাপকতায় মুগ্ধ কলকাতাবাসী তার ওয়াজ শোনার জন্য উন্মুখ থাকতো।
আধ্যাত্মিক জীবনের দীক্ষা: তার পীরে তরিকত ছিলেন পীরানে পীর দস্তগীর গাউছুল আজম মহি উদ্দীন আবদুল কাদের জীলানীর (রহ.) বংশধর শেখ সৈয়দ আবু শাহমা মুহাম্মদ ছালেহ আল কাদেরী লাহোরী (রহ.)।
অপরদিকে, পীরে তরিক্বতের বড়ভাই হযরতশাহ সৈয়দ দেলাওর আলী পাকবাজ (রহ.) এর কাছ থেকে কুতুবিয়তের ফয়েজ অর্জন করেন। তিনি বিল আছালত বা স্বভাব সিদ্ধ ওলী ছিলেন।
মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফ: হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী (ক.) তার পীরে তরীকতের নিদের্শে ১৮৫৭ সালে নিজ গ্রাম মাইজভাণ্ডারে ফিরে আসেন। কিছুদিনের মধ্যেই তার কামালিয়তের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ঐশী-প্রেম পিপাসু সাধক ও দোয়া প্রত্যাশী ফরিয়াদিদের ভীড়ে এই সাধকের পবিত্র বাসগৃহ বিশ্ব-মানবতার কল্যাণধারক এক উচ্চ পর্যায়ের আধ্যাত্বিক দরবারে পরিণত হয়। লোকসমাজে পরিচিতি পায় ‘মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফ’ হিসেবে।
ওফাতের পরও তার পবিত্র মাজার ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মিলন কেন্দ্র। আজও ফরিয়াদিরা তার মাজারে এসে আপন হাজত-মকসদ পূরণের জন্য নজর-মানতসহ আল্লাহর দরবারে মিনতি করেন। তাদের চাহিদাও পূর্ণ হচ্ছে নিয়মিতভাবে যা খোদার নেয়ামতের এক তুঙ্গীয় বহিঃপ্রকাশ।
অলৌলিক ঘটনা ও কারামাত: হযরত কেবলার (ক.) অসংখ্য কারামতের ঘটনা বিভিন্ন গ্রন্থে ও লোকমুখে প্রচারিত। এই কারামত সমুহ ছিল আল্লাহ তায়ালার এক বিশেষ দান। তার পক্ষ থেকে সংঘটিত কারামতের অন্যতম হচ্ছে-
ক) দুরারোগ্য রোগ থেকে মুক্তি।
খ) অভাব-অনটন থেকে মুক্তিদান ও অর্থনৈতিক সাফল্য।
গ) নিঃসন্তানকে সন্তান দান।
ঘ) হাকিমের ওপর আধ্যাত্মিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে ফরিয়াদির স্বপক্ষে মোকাদ্দমার রায় প্রদান।
ঙ) হযরতের আধ্যাত্মিক প্রভাবে অনভিজ্ঞ হেকিমের হেকিম হিসেবে সুনাম অর্জন।
চ) তার শুভ দৃষ্টিতে মৃত্যুকষ্ট লাঘব ও মৃত্যুকালে ঈমান রক্ষা।
ছ) পথহারা, সহায়-সম্বলহীন হাজী সাহেবকে অলৌকিকভাবে গৃহে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ করে দেওয়া।
হযরত মহিউদ্দীন ইবনুল আরাবীর ভবিষ্যতবাণী: বিশিষ্ট সুফী তাত্ত্বিক গবেষক ও বুযুর্গ হযরত মহিউদ্দীন ইবনুল আরাবী তার ‘ফছুছুল হেকম’ গ্রন্থের ‘ফচ্ছে শীচি’ অধ্যায়ে হযরত গাউছুল আজম সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (ক.) এর আগমনের ও তার গাউছুল আজম হওয়ার শুভ সংবাদ ও ভবিষ্যৎ বাণী করে গেছেন। এছাড়া সমসাময়িক ওলী-বুযুর্গগণ তাকে ‘গাউছুল আজম’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন।
আউলিয়া কেরামের লিখনীতে তার মাহাত্ব: সমসাময়িক ও পরবর্তী সুফী ওলামায়ে কেরাম তার প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা নিবেদন ও তার গাউছে আজমিয়তের আন্তরিক স্বীকৃতি দিয়েছেন।
ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদীয়া সুন্নীয়া আলীয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা, ওলীকুল শিরোমনি হাফেজ মাওলানা হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ ছিরিকোটি (রহ.) এর বর্ণনামতে, গাউছুল আজম হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) এই জামানার আওলিয়াদের সম্রাট। হুকুমত তারই।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আমীর মাওলানা সৈয়দ আজিজুল হক শেরে বাংলা (রহ.) তার ‘দিওয়ানে আজিজ’ গ্রন্থে হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারীর (ক.) শানে যে প্রশংসাবাক্য লিখেছেন, হযরত শাহ আহমদ উল্লাহ কাদেরী পূর্বাঞ্চলে প্রকাশিত কুতুবুল আকতাব। তিনি মাইজভাণ্ডারী সিংহাসনে অধিষ্ঠিত গাউছুল আজম (লকবধারী) বাদশাহ, যিনি উম্মতে আহমদীর জন্য হেদায়তের আলোকবর্তিকা। তার অনুগ্রহের ছায়াকে হুমা পাখির ছায়ার মতো জানো (যা দুর্ভাগাকে ভাগ্যবানে পরিণত করে), তিনি বিশ্ববাসীর জন্য লাল পরশমনি সদৃশ। পয়গম্বর (দ.) এর কাছে (বেলায়তে ওজমা বা শ্রেষ্ঠ বেলায়তের) দু’টি তাজ ছিল, তার একটি হযরত শাহ আহমদ উল্লাহর মাথায় সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত। এই কারণেই তিনি পূর্বাঞ্চলে অবস্থানরত গাউছুল আজম, তার রওজা জিন, পরি, মানব (সকল) এর জন্য খোদায়ী অনুগ্রহের উৎস।
মাইজভাণ্ডারী তরীকা প্রতিষ্ঠা: হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডরী (ক.) মাইজভাণ্ডারী তরীকা প্রতিষ্ঠা করেন। মাইজভাণ্ডারী তরীকা কোরআন ও হাদিস ভিত্তিক ইসলামের মৌলিক ভাবাদর্শের অনুসরণে প্রতিষ্ঠিত। অন্যান্য তরীকার আত্মীক ও আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্যগুলো মাইজভাণ্ডারী তরীকায় একত্রিত হয়েছে।
এই তরীকা ছিলছিলার দৃষ্টিতে কাদেরীয়া তরীকা সম্পর্কিত। তাই এই তরীকার বায়াত প্রদানের সময় কাদেরিয়া তরীকার উসুল অনুসরণ করা হয়। এই তরীকার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে এ তরীকা ইসলামী ভাবাদর্শকে পরিপূর্ণভাবে আত্মস্থ করার পাশাপাশি অসাম্প্রদায়ীক, উদার ও সংস্কারমুক্ত, নৈতিক ধর্ম-প্রাধান্য সম্পন্ন, শ্রেণী-বৈষম্যহীন ও মানবদরদী।
পরবর্তী রূহানী উত্তরাধীকার: হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী (ক.) তার ওফাতের পূর্বে আপন নাতি হযরত শাহ সুফী সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারীকে (রহ.) নিজের গদী শরীফের উত্তরাধিকারী সাজ্জাদানশীন নির্ধারণ করে যান। হযরত কেবলা (ক.) এই প্রসঙ্গে বলেন, আমার ‘দেলাময়না’ বালেগ। দেলাময়নাই আমার গদীতে বসবে।
অছীয়ে গাউছুল আজম খ্যাত হযরত সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (রহ.) তার ওপর অর্পিত এই গাউছিয়ত ক্ষমতায় মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের সাজ্জাদানশীন সাব্যস্ত হয়ে মাইজভাণ্ডারী পরিমণ্ডলে আবির্ভূত হয়েছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী এক নতুন সত্ত্বা নিয়ে। সব্যসাচীর মতো যুগপৎভাবে রূহানি হেদায়েত আর মানবতার কল্যাণে তিনি সর্বদা নিয়োজিত ছিলেন।
গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর (ক.) দরবারের বর্তমান সাজ্জাদানশীন: খেলাফত প্রদানের মাধ্যমে গাউছিয়ত জারি রাখার এই নিয়মের অনুসরণে হযরত শাহ সুফী সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারীও (রহ.) তার তৃতীয় পুত্র হযরত শাহ সুফী সৈয়দ এমদাদুল হক মাইজভাণ্ডারীকে (ম.) নিজ গদীর উত্তরাধিকারী ও দরবারে গাউছুল আজমের সাজ্জাদানশীন সাব্যস্ত করে যান।
তিনি শাহ সুফী সৈয়দ এমদাদুল হককে (ম.) সাজ্জাদানশীনের দায়িত্ব অর্পনের বিষয়টি জরূরি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও তার লিখিত ‘মানব সভ্যতা’ নামক বইয়ের ভূমিকায় উল্লেখের মাধ্যমে প্রামাণ্যকরণ করেন।
তিনি জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, সৈয়দ এমদাদুল হক হানাফী মজহাব সুন্নতে এজমা বিধি ফতোয়া মতে আমার মনোনীত সাজ্জাদানশীন সাব্যস্ত। আমি ঘোষণা করিতেছি যে আমার অবর্তমানে হযরতের হুজুরা শরীফে আমার গদীর উত্তরাধিকারী বর্তমান নায়েব সাজ্জাদানশীন সৈয়দ এমদাদুল হককে আমি মনোনীত করে আমার স্থলাভিষিক্ত করিলাম। শিক্ষা দীক্ষা শজরা দান ও ফতুহাত নিয়ন্ত্রণ অধিকার সম্পন্ন, এই গাউছিয়ত জারি-সফলতাদানকারী সাব্যস্ত করিলাম। ”
খেলাফত প্রদানের মাধ্যমে সাজ্জাদানশীন মনোনয়নের বিষয়টি চলতি সময়ের প্রেক্ষপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাইজভাণ্ডারী তরীকার সঠিক আঙ্গিক ও ফয়েজ লাভের স্থান ও মূল মাইজভাণ্ডারী পীর-মুর্শিদের আঙ্গিক সর্ম্পকে অবগত হওয়া জরুরি।
এ প্রসঙ্গে হযরত শাহ সুফী সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (রহ.) বলেন, বিশেষত পীর ছাড়া পীর, ধর্মীয় বন্ধন হারা ফকির, কোরান-হাদিস, ছুফী মতবাদ জ্ঞানহীন ফিকিরবাজ লোকের কাজ কারবারের ফলে ফকিরীর নামে যে উশৃঙ্খলতা দেখা দিয়েছে তার প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। কামেল পীর, বুজুর্গানের নামে হুকুম, স্বপ্ন ইত্যাদি উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা কথা প্রচার করে যারা এই ব্যবসা চালায় ও সরল বিশ্বাসী লোককে ঠকায় তারা অনেকেই নিজের কোনো ছিলছিলা দেখাতে না পারায় নিজেকে মাইজভাণ্ডারী বা আজমিরী বলে পরিচয় দেয়। কারণ এই দেশে ওই দুই দরবারের নাম শান অতি প্রসিদ্ধ।
ওফাত ও ওরস: গাউছুল আজম হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (ক.) ৭৯ বছর বয়সে বাংলা ১৩১৩ সালের (ইংরেজি ১৯০৬ সাল) ১০ মাঘ সোমবার রাতে ইন্তেকাল করেন। তার ওফাত দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর ৮, ৯ ও ১০ মাঘ (২১, ২২ ও ২৩ জানুয়ারি) তিন দিনব্যাপী ওরস শরীফ অনুষ্ঠিত হয়। দেশ-বিদেশের লাখ লাখ আশেক ভক্তের ওরস শরীফে অংশগ্রহণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। ওরস শরীফে সমাজের সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণের ব্যাপকতা গাউছুল আজম হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) এর আধ্যাত্মিক মাহাত্ব ও তার তরীকার সার্বজনীনতা ও ক্রমপসারমানতারই অনুপম স্বাক্ষর।
লেখক-প্রধান, পোর্টস মাউথ ইসলামিক সেন্টার, ইউকে; খতিব, পোর্টস মাউথ জামে মসজিদ, ইউকে
ভক্ত আশেকের পদচারণায় মুখর মাইজভান্ডার
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৪