পৃথিবীতে ইসলামের সুমহান স্বাতন্ত্র্য ও সুদূরপ্রসারী বৈশিষ্ট্য এর সামাজিকতায়।
সমাজ জীবনের প্রতিটি বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা ও আদর্শ চৌদ্দশ’ বছর পরও অন্য সব মত ও পথের চেয়ে অনেক বেশি সহজ ও কার্যকর।
ব্যক্তি ও পরিবার থেকে শুরু করে জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে- সম্মিলিত মানব সম্প্রদায়ের যে বন্ধনে আমাদের বসবাস, এর স্থিতি, শান্তি ও নিরাপত্তার প্রথম শর্ত হচ্ছে নিজেকে সংযত রাখা। যুগ যুগ ধরে এ পৃথিবীর ইতিহাসে ঝরে পড়া প্রতিটি রক্তফোটার উৎস মানুষের সীমালংঘন ও অসংযত আচরণ। যে যখন তার সীমা ছাড়িয়ে অন্যের সীমানায় আঘাত করেছে, চাই তা মুখের কথায় কিংবা শারীরিক শক্তি প্রদর্শনের বেলায়- সংঘাত ও দ্বন্দ্বের সূচনা সেখান থেকেই। একের অত্যাচারে তখন অন্যজন আহত হয়, অতিষ্ঠ হয়, বিক্ষুদ্ধ হয়। চারপাশের পরিবেশ হয়ে ওঠে অশান্ত। অস্থির হয়ে ওঠে চলমান সময়।
ইসলাম যে শুধু নামাজ-রোজা কিংবা ইবাদতের কিছু আদেশসমষ্টির নাম নয়, তা পবিত্র কুরআনের আয়াত ও নবীজি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত আমাদের পারস্পরিক আচার-আচরণের বিষয়ে অসংখ্য হাদীস থেকে খুব সহজেই স্পষ্ট হয়। আমরা কেউ যেন একে অপরের কষ্ট ও যন্ত্রণার কারণ না হই- এ নির্দেশ এবং এর বাস্তবায়ন দেখিয়েছে ইসলাম।
পবিত্র কুরআনের সূরা আহযাবের ৫৮ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন, যারা ঈমানদার পুরুষ এবং ঈমানদার নারীদের অযথা কষ্ট দেয়, তারা অপবাদ এবং সুস্পষ্ট পাপ বহনকারী। সূরা হুজুরাতের ১২ নং আয়াতে আল্লাহ পাক আরও বিস্তারিত আদেশ করছেন, হে ঈমানদাররা! তোমরা অহেতুক ধারণা করা থেকে বিরত থাকো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুমান পাপের অন্তর্ভূক্ত। তোমরা একে অপরের গোপন বিষয়গুলো খুঁজে বেড়াবে না এবং একে অন্যের আড়ালে নিন্দা করবে না।
ইমাম মুসলিম হিশাম বিন হাকিম রা. এর বর্ণনায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসে উল্লেখ রয়েছে, দুনিয়াতে যারা মানুষকে কষ্ট দেয় আল্লাহ পাক তাদের অবশ্যই শাস্তি দেবেন। অন্য বর্ণনায় এসেছে, নিজের গোলামকেও যদি বিনা কারণে সামান্য একবার লাঠি-চাবুক দিয়ে মারা হয়, তবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ পাক নির্যাতিতের পক্ষে তার অধিকার ওই অন্যায় প্রহারকারীর কাছ থেকে আদায় করে নেবেন।
দ্বন্দ্ব-বিবাদের প্রথম সূচনা মুখ থেকে। তিরস্কার-কটুক্তি কিংবা নিন্দা-অপবাদ থেকে অনেক নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে যায়। আর তাই এক ইসলামের পরিচয়ে সব মুসলমানকে এক বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য পবিত্র কুরআনের আয়াত, নিশ্চয়ই মুমিনরা পরস্পর ভাই। (সূরা হুজুরাত-১০)
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই একই কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, একজন মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। এক ভাই যেন অন্য ভাইয়ের ওপর জুলম না করে, অপমান না করে, তুচ্ছ মনে না করে। (মুসলিম, আহমদ)
পারস্পরিক ভালোবাসা ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতিতে মুসলমান সবাই যেন একটি দেহ। শরীরে একটি অঙ্গ অসুস্থ হলে পুরো শরীর এর ব্যথায় কাতর হয়। (বুখারী, মুসলিম)
এমন অনেক হাদীসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বপ্রথম আমাদের ভাই-ভাই পরিচয়ে এক সুতোয় গেঁথে দিয়েছেন।
এমন নবীর উম্মত হয়েও আজকের অশান্ত পৃথিবীর অস্থির এ সময়ে আমরা নিজেদের কথা ও কাজে অনেক বেশি উদাসীন। সামান্য কিছুতেই মুখের গালিগালাজ থেকে আমরা জড়িয়ে পড়ি কিল-ঘুষি মারামারিতে। আমাদের দেশের পথে-ঘাটে রিকশাওয়ালা থেকে অফিস-আদালতসহ সমাজের সর্বস্তরে এমন দৃশ্য অহরহ।
জীবন সংগ্রামের ব্যস্ততায় দিনদিন আমরা হারিয়ে ফেলছি ধৈর্য, উদারতা, ভালোবাসা এমনকি একটু মুচকি হাসির সামান্য সরলতাও। নগরজীবনে বাসের কাউন্টারে টিকেটের লাইন থেকে মসজিদে নামাজের কাতারেও সামান্য কারণে আমরা উত্তেজিত হয়ে পড়ি। অশালীন ভাষায় অন্যকে আক্রমণ করি। পথে ঘাটে আমাদের একটু উদাসীনতা অন্যের জন্য দুর্ভোগ ও যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এই সব লাগামহীন বাক্য বিনিময় কিংবা নিয়ন্ত্রণহীন আচরণের দায়ে আমাদের ইসলাম ও মুসলমান পরিচয় যে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে- তা নিয়ে আমরা কি কখনও ভেবেছি?
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুস্পষ্টভাবে এসব ব্যাপারে আমাদের সতর্ক করেছেন। সংযত কথা ও শোভন আচরণকে ঈমানের পূর্ণতার মাপকাঠি বলেছেন। বিখ্যাত সাহাবী হজরত আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. এর বর্ণনায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে মুসলমানের মুখের কথা ও হাতের কর্মকাণ্ড থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদে থাকে- সে-ই তো প্রকৃত মুসলমান। (বুখারী ও মুসলিম)
অন্যত্র বলেছেন, তোমরা নিজেদের জন্য যা ভালোবাসো তা যদি অন্যের বেলায় না দেখাতে পারো- তবে তো তুমি ঈমানদার হতে পারলে না। (বুখারী ও মুসলিম)
প্রকাশ্য কথা কিংবা কাজ তো অবশ্যই- মনের গোপনে কারোর ব্যাপারে কুধারণা কিংবা খারাপ সন্দেহ যেন জায়গা না পায়- সে ব্যাপারেও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সতর্ক করেছেন। সূরা হুজুরাতের ১২ নং আয়াতে আল্লাহ পাক নির্দেশ দিচ্ছেন, হে ঈমানদাররা! তোমরা অযথা সন্দেহ করা থেকে বেঁচে থাকো।
জীবনযাপনের এমন যে কোনো বিষয় যা অন্যকে আহত কিংবা দুঃখিত করতে পারে, সেসব থেকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের নিষেধ করেছেন। একজনের বিয়ের প্রস্তাব ডিঙিয়ে অন্য কেউ যেন প্রস্তাব না পাঠায়, একজনের কেনা-বেচার সময় আরেকজন যেন ওখানে দরদাম না করে- দৈনন্দিন এবং সামাজিক এ বিষয়গুলোও বাদ যায়নি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুপম আদর্শ ও অমূল্য নির্দেশনা থেকে।
মুখ থেকে উচ্চারিত কোনো কথায় যেন অন্যের কষ্ট না হয়- সেজন্য তিনি পরনিন্দা-অপবাদ থেকে গালিগালাজ পর্যন্ত সব মন্দ বিষয় চর্চা করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। রাস্তাঘাটে আবর্জনা ফেলা কিংবা মলত্যাগ থেকে শুরু করে যুদ্ধের উত্তেজনায়ও নিরাপরাধ কাউকে আঘাত করা থেকে বিরত থাকার জন্য আদেশ করেছেন।
একই ভিত্তিতে অন্যের সম্পদ চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই, দুর্নীতিকে ইসলাম জঘন্য ও ভয়াবহ অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করেছে- কারণ এ বিষয়গুলো অন্যদের জন্য ক্ষতি ও দুর্দশার কারণ হচ্ছে।
বুখারি ও মুসলিমের হাদীসে রাস্তাঘাট থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলাকে ঈমানের ক্ষুদ্রতম শাখা এবং অন্য বর্ণনায় সদকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীসে নববীর অন্যান্য কিতাবে বিভিন্ন অধ্যায়ে পারস্পরিক কুৎসা রটানো অথবা কারো দোষ খুঁজে বেড়ানো কিংবা অন্যের সম্পর্কে গুজব ছড়ানোসহ সামাজিক সম্প্রীতির জন্য ক্ষতিকর সব ধরনের বিষয় ও আচরণকে ভয়াবহ অপরাধ এবং এসবের জন্য কঠিন শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে।
বুখারি ও মুসলিম শরীফের এক হাদীসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কোনো মুসলমানকে গালি দেওয়া ফাসেকের কাজ এবং কোনো মুসলমানকে হত্যা করা কুফুরীর নামান্তর। তিনি এমনও বলেছেন, তোমাদের কেউ যেন একে অন্যের দিকে অস্ত্র দিয়ে ইশারা না করে।
শুধু আদেশ কিংবা নিষেধের বেড়াজালে নয় বরং পারস্পরিক ভালোবাসার মায়াবন্ধনে মুসলমানদের একতা ও অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক ছোট ও সামান্য বিষয়ের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অন্য মুসলমানের জন্য তোমার মুখের সামান্য মুচকি হাসি আল্লাহর কাছে সদকা হিসেবে গণ্য। অন্যের সাথে ভালোভাবে কথা বলা কিংবা তার বোঝা একটু এগিয়ে দিলে সেটিও সদকা হিসেবে বিবেচ্য। (বুখারী ও মুসলিম)
বিখ্যাত সাহাবী হজরত আবু যর রা. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি যদি কিছু আমল করতে ব্যর্থ হই- তবে আমার জন্য কী উপায়? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, অন্তত তোমার অনিষ্ট থেকে অন্যদের নিরাপদ রাখো। এটি তোমার পক্ষ থেকে তোমার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য। (বুখারী ও মুসলিম)
হজরত আবু হুরাইরা রা. বলেন, এক লোক এসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানালো, এক মহিলা নামাজ-রোজা এবং দান-সদকার ব্যাপারে খুব আলোচিত কিন্তু তার বিভিন্ন কথায় প্রতিবেশীরা কষ্ট পায়। রাসুল বললেন, এই মহিলা জাহান্নামী। লোকটি আবার বললো, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আরেকজন মহিলা ইবাদত ও দানের বেলায় দুর্বল কিন্তু সে কাউকে কটু কথা বলে না। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সে জান্নাতী। (আহমদ)
একদিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞেস করলেন, বলোতো কে সবচেয়ে বেশি অসহায় এবং হতভাগা? সাহাবারা বললেন, যার পয়সা নেই, সম্বল নেই- সে। রাসুল তাদের বললেন, না, আমার উম্মতের সবচেয়ে হতভাগা ওই লোক যে কিয়ামতের মাঠে অনেক নামাজ এবং ইবাদতে ভরা আমলনামা নিয়ে হাজির হবে, কিন্তু দেখা গেল- সে অমুককে গালি দিয়েছিল, আরেকজনকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল, অন্যের সম্পদ দখল করেছিল, কাউকে সে হত্যা করেছিল অথবা আঘাত করেছিল- এর বিচারে এই লোকটির সব পূণ্য ওসব নির্যাতিতদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে, যদি তার নেকি শেষ হয়ে যায়, তখন তাদের পাপসমূহ তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হবে এবং এরপর তাকে জাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে। (মুসলিম)
তাই শুধু ইবাদত নয়, আমাদের ব্যক্তিগত স্বভাব ও আচরণের মধ্যেও লুকিয়ে আছে ঈমানের আসল পরিচয়- মহান আল্লাহ এবং তার রাসুলের এই এতগুলো আলোকিত নির্দেশনা কি এটুকু বোধের জন্য পর্যাপ্ত নয়?
লেখক- শিক্ষার্থী, কাতার ইউনিভার্সিটি
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৩ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০১৪