পবিত্র শবে বরাত। আল্লাহপ্রেমিক মুসলমানদের জন্য অনেক আশা ও ভরসার রাত।
আল্লাহ পাক আমাদের সৃষ্টিকর্তা। মহান এ স্রষ্টা তার সৃষ্টজীব মানুষকে অনেক বেশি ভালোবাসেন। অথচ আমরা নিজেদের অপরাধ ও অবাধ্যতায় ডুবে গিয়ে তাকে ভুলে থাকি জীবনভর। দয়াময় আল্লাহ তবুও আমাদের তওবার অপেক্ষায় থাকেন। যে মানুষকে তিনি সাজিয়েছেন আপন দয়ার হাতে, ফেরেশতাদের আপত্তি সত্ত্বেও যাকে ভালোবেসে দিয়েছেন এ পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব, সেই পরম করুণাময় আমাদেরকে ডেকে বলছেন সূরা ইনফিতারের ৬ নং আয়াতে, ওহে মানুষ, কে তোমাদের এমন দয়াময় ও দয়ালু রবের কাছে আসতে তোমাদেরকে ধোকা দিয়ে সরিয়ে রাখছে?
এক হাদীসে কুদসিতে তিনি অভয় দিয়ে বলেছেন, ‘ও বান্দা! তুমি যদি এ আকাশ ও মাটিভরা গুনাহ নিয়ে আমার কাছে আত্মসমর্পণ করো এবং আমাকে ডেকে ক্ষমা চাও, আমি তোমার এ সব গুনাহ মাফ করে দেবো, এতে আমি কাউকেই পরোয়া করি না। ’ পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াতে তিনি বান্দাকে বারবার ডেকে ডেকে তওবা করতে বলেছেন, শয়তানের ধোকা থেকে সতর্ক করেছেন।
স্বার্থপরতার এ পৃথিবীতে লোভ ও হিংসার জালে বন্দি হয়ে আমরা এসব ভুলে যাই বারবার। তবুও তিনি সুযোগ দিয়ে চলেছেন অবিরাম, এই বুঝি তার কোন বান্দা এবার তার কাছে সত্যিই ফিরে আসবে, তাকে আপন করে ডাকবে।
শবে বরাত এমনই এক মহা মূল্যবান সুযোগ। দূর্ভাগা ছাড়া আর কেউ এ রাতের কল্যাণ ও বরকত থেকে বঞ্চিত হতে পারে না। এ রাতের পুরোটা সময়জুড়ে আমাদের জন্য আল্লাহপাকের বিশেষ রহমত ও তাওয়াজ্জুহের দুয়ার খোলা থাকবে। কাজেই হেলায় খেলায় যেন তা পার হয়ে না যায়। বায়হাকি শরিফে বর্ণিত হাদীসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মহান আল্লাহ শাবানের মধ্যাংশের রাতে বান্দাদের প্রতি মনোযোগী হন। তিনি ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং দয়া কামনাকারীদের দয়া করেন। তবে হিংসুকদের তিনি আপন অবস্থায় ছেড়ে দেন।
আর তাই এ পবিত্র ও মহিমান্বিত রজনীর পূর্ণ বরকত ও সাফল্য পেতে হলে কয়েকটি বিষয়ে আমাদেরকে সজাগ থাকতে হবে।
এ মহিমান্বিত রাতের ভাবগাম্ভীর্য যেন নষ্ট না হয়, সেদিকে সবার সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। আমাদের কেউ যেন আতশবাজি কিংবা রুটি-হালুয়ার আনন্দ উৎসবে মেতে না ওঠে, দল বেঁধে শহর ভ্রমণ কিংবা অন্য কোনো অনর্থক কাজে জড়িয়ে না পড়ে- এ দায়িত্বও আমাদের। ইসলাম কেবল স্বার্থপরের মতো নিজের ইবাদতে লিপ্ত হতে বলেনি, বরং অন্যকে সৎপথে ডাকা ও বোঝানোর দায়িত্বও দিয়েছে আপনাকে।
একটি বিষয় খুব ভালোভাবে আমাদের বোঝা উচিত, শবে বরাতের কোনো নির্দিষ্ট নামাজ কিংবা আমলের কথা কুরআন ও হাদিসের কোথাও নেই। বরং শবে বরাতে আপনি যেভাবে ভালোবাসেন সেভাবেই আল্লাহকে ডাকুন। কারণ এ রাত একান্তই আপনার। আপন স্রষ্টার কাছে নির্জনে প্রাণ খুলে নিবেদন করুন নিজের সব চাওয়া ও পাওয়ার কথা। দুঃখ ও বেদনা এবং কষ্ট ও ভালোবাসার সব আর্তি ও ফরিয়াদ তাঁকে জানান নিঃসঙ্কোচে, তিনিই তো পরম আপন আমাদের, এমন আর কে আছে যার কাছে না চাইলে তিনি অসন্তুষ্ট হন!
তাই সারা রাত কিংবা অর্ধরাত, নামাজ কিংবা শুধু তিলাওয়াত অথবা জিকির, যেভাবে আপনি ভালোবাসেন এবং যা আপনি নিজে শুদ্ধভাবে করতে জানেন, সেটুকুই করুন। পরম করুণাময় আল্লাহ তো আপনার অন্তর পর্যবেক্ষণ করছেন, কয় রাকাত নামাজ পড়ছেন কিংবা কতো টাকা দান করছেন, সেটি তার কাছে মোটেও বিবেচ্য নয়।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এ রাতে দুই শ্রেণির লোকের ডাকে আল্লাহ পাক সাড়া দেন না। প্রথমত ওই মুশরিক যে আল্লাহর সঙ্গে অন্যকে শরিক করে এবং দ্বিতীয়ত ওই মুসলমান ব্যক্তি যার সঙ্গে অন্য কোনো মুসলমানের ঝগড়া-বিবাদ রয়েছে এবং তারা পরস্পরে সম্পর্কহীন। এমন সম্পর্কচ্ছেদে লিপ্ত দুজন নিজেদের মধ্যকার বিবাদ না মেটানো পর্যন্ত আল্লাহ পাক তাদের সব প্রার্থনাকে অপেক্ষার তালিকায় রেখে দেন।
আজকের এ স্বার্থপরতা ও অস্থির সময়ে এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামান্য তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কর্মস্থল কিংবা পাড়া-মহল্লা অথবা আত্মীয়-স্বজনের কারো সঙ্গে হয়তো আপনার দ্বন্দ্ব হয়েছে এবং আপনারা একে অপরের মুখ দেখা থেকে এড়িয়ে চলছেন। বিষয়টি সমাজের দৃষ্টিতে খুব সাধারণ মনে হলেও মহান আল্লাহর কাছে মোটেও তুচ্ছ নয়। তাই বিবাদমান এমন দুজনের দুআ তিনি গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। বরং তিনি অপেক্ষায় থাকেন, কবে তার এ দুজন বান্দা সব বিবাদ ভুলে বুকে বুক মিলিয়ে একই কাতারে এসে দাঁড়াবে, সেদিনই তিনি তাদের প্রার্থনার ডাকে সাড়া দেবেন। নিজের দ্বীন ও দুনিয়ার অসামান্য সফলতা এবং কল্যাণের জন্য এ পৃথিবীর সামান্য স্বার্থের সংঘাত ভুলে গিয়ে আল্লাহর জন্য ওই মানুষটিকে বুকে মিলিয়ে নেওয়াই তো প্রকৃত মুসলমানের পরিচয়।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ রাতে কবর জিয়ারত করেছেন বলে হাদিসের কিতাবসমূহে উল্লেখ রয়েছে। আপনিও নিজের মৃত মা বাবা কিংবা কোন স্বজন অথবা যে কোনো মুসলমানের কবর যিয়ারত করুন। তার আত্মার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা এবং কিছু সওয়াব তার নামে উৎসর্গ করুন। কবরবাসী প্রতিজন মুসলমান জীবিতদের সামান্য দুআর জন্য চাতকের মতো চেয়ে থাকেন পিপাসার্ত হয়ে।
সবশেষে আরেকটি বিষয়, এ রাতকে কেন্দ্র করে বাড়াবাড়ি কিংবা ছাড়াছাড়ির কোনোটিই ভালো নয়। যারা এ রাতের ফজিলত নিয়ে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়, তারা মূলত আল্লাহর ইবাদত থেকে করুণ উদাসীনতার পরিচয় দিচ্ছেন। আবার এ রাতকে রসম রেওয়াজে পরিণত করাও উচিৎ নয়। তাই এ দুটোর মাঝামাঝি থেকে এ রাতকে পূণ্যময় মনে করে নিজের সাধ ও সাধ্যের সমন্বয়ে আমল করার মাধ্যমেই আপনি পূর্ণ ভাগ্যবান হতে পারেন।
ভুলে যাবেন না, মহান আল্লাহ পাক এ রাতের পুরো প্রহরজুড়ে বান্দাদের দিকে তার রহমতের দৃষ্টি দিয়ে থাকেন। মানুষের চাওয়া ও প্রার্থনাগুলো তিনি গ্রহণ করেন। তাই পূর্ণ একনিষ্ঠ হয়ে সমর্পিত প্রাণে আল্লাহকে ডাকুন, তার ইবাদতে আত্মনিয়োগ করুন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ পাক কোনো উদাসীন হৃদয়ের প্রার্থনা কবুল করেন না। তাই তার অসীম দয়া ও অপরিসীম শক্তির ওপর পূর্ণ ঈমান ও বিশ্বাস রেখে জীবনের সব প্রয়োজন তাকেই খুলে বলুন। কোনো অন্য মাধ্যম কিংবা ব্যক্তিকে ধার করে নয়, সরাসরি তিনি আপনাকে দেখছেন ও শুনছেন, তাই নিজেই নিজের মিনতি পেশ করুন।
চারিদিকে নিরাশা ও বিপদের এ কঠিন দুঃসময়ে বারবার অনুভূত হচ্ছে আল্লাহকে ডাকার ও তার কাছে আত্মসমর্পণের প্রয়োজনীয়তা। তিনি ছাড়া তো আমাদের আর কোনো সহায় নেই। শক্তি কিংবা বুদ্ধি দিয়ে নয়, তার সামান্য করুণার বর্ষণে ভেসে যাবে আমাদের সব মনোবেদনা ও জীর্ণতা। পবিত্র শবে বরাতের এ কল্যাণময় প্রহরে আমাদের এটুকু আত্মোপলদ্ধিই হতে পারে এক বিশুদ্ধ ও আলোকিত জীবনের নতুন সূর্যোদয়।
বাংলাদেশ সময়: ২১০৪ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০১৪