ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

আধ্যাত্মিক প্রশান্তি লাভের উপায় জিকির

মাওলানা আবদুর রহমান, অতিথি লেখক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪২ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৫
আধ্যাত্মিক প্রশান্তি লাভের উপায় জিকির

দ্বীন-দুনিয়ার আধ্যাত্মিক প্রশান্তি লাভের জন্য মুমিন-জীবনের অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে ‘আল্লাহর জিকির। ’ একজন মুসলমান বান্দা জিকিরের মাধ্যমে অতি সহজে আল্লাহর প্রিয়ভাজন হয়ে তার নৈকট্য অর্জনে ধন্য হতে পারে।

জিকির যে শুধু আত্মার খোরাক আর প্রশান্তির মাধ্যম তা নয়; বরং ইহকাল ও পরকালে মুক্তি লাভের অন্যতম পুঁজিও বটে।

জিকিরের প্রতি গুরুত্বারোপের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনের সূরা আল আহজাবের ৪১ ও ৪২ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অধিক পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ করো এবং সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহতায়ালার পবিত্রতা বর্ণনা করো। ’

এ বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করতে গিয়ে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তুমি আল্লাহর জিকির এত অধিক পরিমাণে করো যেন লোকে তোমাকে পাগল বলে আখ্যায়িত করে। ’  -মুসনাদে আহমদ ও ইবনে কাসির

জিকিরের নূর ও বরকত দ্বারা ব্যক্তি-হৃদয় যেমন আল্লাহ-প্রেমে উদ্বেল হয়ে তার হুকুম-আহকাম মেনে চলার প্রতি উৎসাহী হয়, ঠিক তেমনি সে ব্যক্তি দ্বারা দেশ, জাতি, সমাজ পর্যন্ত উপকৃত হয়ে থাকে। এটি কোনো সুনির্দিষ্ট ক্রিয়া বা কর্ম নয়, যা কোনো বিশেষ সময়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বরং একজন মুমিন ব্যক্তি ইচ্ছা করলে তার লেনদেন, আচার-ব্যবহার, চলাফেরা, খাওয়াদাওয়াসহ গোটা জিন্দেগির সব কর্মকাণ্ড আল্লাহর জিকিরে রূপান্তরিত করতে পারে শরিয়তসম্মত পন্থায়, রাসূলের নির্দেশিত সুন্নাহর অনুসরণে। তখন তার আল্লাহ আল্লাহ জিকির নামাজ-রোজার মতো প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বাইরে যাওয়া এবং দৈনন্দিন প্রয়োজন পূরণ ও বাজারে গমনও জিকিরে পরিগণিত হবে- ইনশাআল্লাহ।

উপরিউক্ত ব্যাপারে আল্লাহতায়ালার ভাষ্য হচ্ছে, বুদ্ধিমান হলো সেসব লোক, যারা আল্লাহতায়ালাকে দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে- সর্বাবস্থায় সর্বক্ষণ তার স্মরণে মশগুল থাকে। আসমান-জমিন সৃষ্টির ব্যাপারে চিন্তা ও গবেষণা করে। এবং তারা বলে, পরওয়ারদিগার, এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। সব পবিত্রতা তোমারই, আমাদিগকে তুমি জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। -সূরা আল ইমরান: ১৯

যার জিকিরের পরিমাণ যত বেশি হবে, আল্লাহর সঙ্গে তার সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা তত নিবিড় হবে। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বান্দা যতক্ষণ আমার স্মরণে নিমগ্ন থাকে, আমিও ততক্ষণ তার সঙ্গে থাকি। ’ প্রকৃত অর্থে আল্লাহর জিকির হলো যাবতীয় ইবাদতের প্রাণ। আর তাই তো সহিহ বোখারি ও মুসলিম শরিফের হাদিসে উল্লেখ আছে, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকির করে আর যে করে না, এদের উপমা হলো জীবত ও মৃত ব্যক্তির ন্যায়।

এ বিষয় উপলব্ধি করেই যুগে যুগে বুজুর্গ আলেম-ওলামা, সুফিয়ায়ে কেরাম জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত থেকে নিয়ে শেষ সময় পর্যন্ত আল্লাহর জিকিরে নিমগ্ন ছিলেন নিজের অন্তরকে জিন্দা রাখার জন্য। বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির অন্যতম পুরোধা হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর দুই ঠোঁট রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা নড়াচড়া করত। আর হজরত জুরজানী (রহ.) তো ৪০ বছর পর্যন্ত পানি দিয়ে ছাতু গুলিয়ে খেয়েছেন এ জন্য যে রুটি খাওয়া থেকে ছাতুতে ৭০ বার বেশি আল্লাহর জিকির করা যায়। সুবহানাল্লাহ! কেমন ছিল তাদের চিন্তাচেতনা।

শুধু পারলৌকিক কল্যাণ এবং আধ্যাত্মিক প্রশান্তি লাভের জন্যই যে জিকিরের প্রয়োজন রয়েছে এমনটি নয়; বরং পার্থিব প্রয়োজনীয়তা এবং সুখশান্তিও নির্ভর করে আল্লাহর জিকিরের ওপর। একবার আল্লাহর জিকিরের এত বেশি প্রভাব যে এর দ্বারা শুধু অন্তরের ময়লা আর বদ-খাসলতই দূর হয় না; ববং জিকিরকারীর শরীর-মন থেকে শুরু করে সব সৃষ্টিজীবে এর প্রাণের সঞ্চার হয়। এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করতে গিয়ে উদাহরণস্বরূপ যুগশ্রেষ্ঠ ওলি মহিউস সুন্নাহ শাহ আবরারুল হক (রহ.) বলতেন, ‘সামান্য ওষুধ সেবনে যদি পুরো শরীর ঘর্মাক্ত হয়ে যেতে পারে, তাহলে আল্লাহর জিকিরের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটবে না এমনটি হতেই পারে না। ’

এ কথা আমাদের সুস্পষ্টভাবে মনে রাখতে হবে যে শান্তির উপকরণ আর আধ্যাত্মিক প্রশান্তি দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। আধ্যাত্মিক প্রশান্তির বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করে অধিক পরিমাণে জিকিরের আধিক্যের অনুপাতের ওপর। কেননা আত্মার সঙ্গে শরীরের রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন গভীর যোগাযোগব্যবস্থা। কেউ একজন সুখের জন্য অঢেল টাকা-পয়সা, ধনদৌলত জমা করতে পারে, গগনচুম্বী অট্টালিকায় রাত যাপন করতে পারে; কিন্তু আল্লাহর জিকির ব্যতীত কিছুতেই সে আধ্যাত্মিক প্রশান্তিতে থাকতে পারে না। কোরআনের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা মুমিন মুসলমানদের সতর্ক করে দিয়ে সুরা রাদ-এর ২৮ নম্বর আয়াতে জোর তাগিদ দিয়ে ইরশাদ করেছেন, ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; সাবধান! জেনে রেখো, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তর আধ্যাত্মিক প্রশান্তি পেয়ে থাকে। ’ দুনিয়ার মানুষ তার বিবেক-বুদ্ধি, চেষ্টা-ক্লেশ, জ্ঞান-বিজ্ঞান দ্বারা যতই উৎকর্ষ সাধন করুক না কেন; আধ্যাত্মিক প্রশান্তির একমাত্র উপায় আল্লাহপাকের ধ্যান-জ্ঞান, জিকির-আজকারের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। সন্তানের সঙ্গে মায়ের যেমন নাড়ির সম্পর্ক, বান্দার সঙ্গে আল্লাহর তার চেয়ে শত কোটি গুণ বেশি আত্মার সম্পর্ক। মায়ের সঙ্গে সন্তান যেমন সম্পর্ক ছিন্ন করে তাকে অবহেলা করে শান্তিতে থাকতে পারে না, ঠিক তদ্রূপ আল্লাহর জিকির-আজকার ত্যাগ করে এর থেকে উদাসীনতা প্রদর্শন করে বান্দাও সুখে-শান্তিতে থাকতে পারে না।

আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম (রহ.) জিকিরের ১০০টি উপকারের কথা উল্লেখ করেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ‘শয়তানকে দূর করে তার শক্তি বিনষ্ট করে দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সাহায্য করে, দেহমনে প্রশান্তি আনয়ন করে এবং সবচেয়ে বড় চিন্তা রিজিকের অভাব দূর করে ইমানি মৃত্যু নসিব করে। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৪ ঘন্টা জুলাই ২৭, ২০১৫
এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।