ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

হজ : তাওহিদবাদী বিশ্বমানবের ঐক্য

আফতাব চৌধুরী, অতিথি লেখক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৯, ২০১৫
হজ : তাওহিদবাদী বিশ্বমানবের ঐক্য

হজের তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিক হচ্ছে- এটি সমগ্র বিশ্ব মুসলিমের এমন এক মহাসম্মেলন যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের, বিভিন্ন বর্ণের, ভাষা এবং আকার-আকৃতির মানুষ একই ধরনের পোশাকে সজ্জিত হয়ে একই কেন্দ্রবিন্দুতে এসে সমবেত হন। সবারই লক্ষ্য বিশ্ব মানবের প্রথম উপাসনা কেন্দ্র কাবার জিয়ারত, সবার মুখে একই ভাষার একটিমাত্র কথা- লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক...।

যার বাংলা অর্থ: হাজির হয়েছি ওগো আল্লাহ! হাজির হয়েছি! এসেছি, তোমার ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য এসেছি। আমার সবকিছু তোমার কাছে সমর্পণ করতে এসেছি।

তাই বলতে হয়, হজের এ সফরে অন্য কোনো উদ্দেশ্য নয়, কোনো লক্ষ্য নয়, কোনো পার্থিব স্বার্থের আকর্ষণ নয়, শুধু আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের আকুতিটুকুই একান্ত কাম্য হয়ে দাঁড়ায়। আর এভাবেই হৃদয়ের গভীরে অঙ্কুরিত হয় বিশ্বভ্রাতৃত্বের এক শুচিশুভ্র ফল্গুধারা।

দ্বিতীয়ত, হজের এ মহাসমাবেশে সমগ্র বিশ্বমানব এমনই একটি কেন্দ্রবিন্দুতে এসে সমবেত হন, যা মানবজাতির প্রথম আবাস্থল। উম্মুলকোরা মক্কানগরীতেই যে আদি মানব হজরত আদম (আ.) প্রথম বসতি স্থাপন করেছিলেন এ তথ্য সন্দেহাতীত। সে আদি বসতির মধ্যই এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগির লক্ষ্যে স্থাপিত প্রথম গৃহ পবিত্র বায়তুল্লাহ। বর্ণিত আছে, হজরত আদম উম্মুলকোরা পবিত্র মক্কায় স্থিত হওয়ার পর প্রার্থনা করেছিলেন, ঊর্ধ্ব জগতে ফেরেশতাদের উপাসনাস্থল বাইতুল মামুরের অনুরূপ একখানা উপাসনালয় পাওয়ার জন্য। আল্লাহতায়ালা ওই প্রার্থনা মঞ্জুর করে ফেরেশতা হজরত জিবরাইল (আ.)-এর মারফতে বাইতুল মামুর বরাবর মাটির ওপর পবিত্র কাবাঘর নির্মাণের স্থান নির্দেশ করেন। এ ঘরের যে চৌহদ্দিটুকু হারাম বা পবিত্রতার সীমারেখায় চিহ্নিত সেটুকুও ফেরেশতার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ইতিহাসের সে প্রথম গৃহে, মানব সন্তানের জন্য সৃষ্ট প্রথম উপাসনালয়ে আদি মানবের বার্ষিক এ মহাসমাবেশে যে আবেগময় অনুভূতি সৃষ্টি করে সে অনুভূতি সমগ্র বিশ্বমানব তথা আদি সন্তানের একই রক্তের উত্তরাধিকার এবং আত্মীয়তার অবিচ্ছেদ্য বন্ধনকেই নবায়িত করার অনুভূতি। ইবাদতের লক্ষ্যেই গড়ে তোলা হয়েছিল সে ঘরটি। সুতরাং সে ঘরের প্রতি একটা আবেগপূর্ণ আকর্ষণ এক আল্লাহতে বিশ্বাসী প্রতিটি মানব সন্তানের মনমস্তিষ্ক সুপ্ত হয়ে থাকাটা নিতান্তই স্বাভাবিক।

কয়েকদিনের হজের সফর প্রতিটি হজযাত্রীকে নিয়ে যায় মানুষের এ জন্মপ্রবাহ শুরুর সে প্রথম দিনগুলোতে। আজকের ভাষা, বর্ণ ও ভৌগোলিক সীমারেখা কণ্টকিত মানুষগুলো যখন কিছুদিনের জন্য সহজ-সরল পোশাক মাত্র দু’টুকরো কাপড় পরিধান করে হজের অনুষ্ঠানগুলো পালন করেন, তখন তার মধ্যে যে উপলব্ধি জন্ম হয়, সেটা সব মানুষের প্রতি সহোদরপ্রতিম মমত্ব ছাড়া আর কি হতে পারে!

ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে হজ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত। অন্যান্য প্রার্থনা কোনোটা শারীরিক, কোনোটা মানসিক এবং কোনোটা আর্থিক। নামাজ, রোজা, প্রধানত শারীরিক শ্রম প্রধান। জাকাত, সদকা অনেকটা অর্থনির্ভর। কিন্তু হজের মধ্যে মানসিক, শারীরিক এবং আর্থিক- এ তিন প্রকার ইবাদতের এক অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছে। এ তিনটি ক্ষেত্রেই যার সমান সামর্থ্য রয়েছে, তার ওপরই হজ অবশ্যকর্তব্য করা হয়েছে। ফলে শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিক দিক দিয়ে সামর্থ্যবান লোকগুলোই হজ করতে যাবেন এটাই প্রত্যাশিত। এদিক দিয়ে হজের সমাবেশকে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ তওহিদবাদী বিশ্বমানবের একটা সর্ববৃহত্ এবং সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিনিধিত্বশীল বিশ্ব সম্মেলন বলা যায়।

এ মহাসম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে বাংলাদেশের লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান মক্কা শরিফে হজ করতে যান। এ সম্মেলনের প্রধান শিক্ষাই হচ্ছে আল্লাহর সামনে বান্দার সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ। একই সঙ্গে সমগ্র বিশ্বমানবের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য এক ভ্রাতৃত্ববন্ধন গড়ে তোলার জন্য ব্রতী হওয়া। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সর্বশেষ হজের ভাষণের মধ্যে এ শিক্ষাই সর্বপেক্ষা গুরুত্বের সঙ্গে প্রদান করা হয়েছে।

যে ভাষণে উদাত্তকণ্ঠে তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন- লোকসব, তোমাদের সবার প্রভু এক, তোমাদের সবার আদি পিতাও এক ব্যক্তি। সুতরাং কোনো আরব-অনারবের ওপর, কোনো কৃষ্ণাঙ্গের শ্বেতাঙ্গের ওপর কিংবা কোনো কৃষ্ণাঙ্গের ওপর কোনো শ্বেতাঙ্গের জন্মগত কোনো প্রাধান্য নেই। সম্মানযোগ্য হবে সে ব্যক্তি যে একনিষ্ঠ খোদাভীরু। মনে রেখ, প্রত্যেক মুসলমান একে অন্যের ভাই।

হারামের সীমারেখার মধ্যে বন্যপ্রাণী শিকার অবৈধ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য এ সফর হিংস্রতার নয়, এ সফর ভ্রাতৃত্বের-মমত্ববোধের। মানুষের সৃষ্ট কৃত্রিম ভেদরেখার সব প্রাচীর ধসিয়ে দিল এক সৃষ্টিকর্তার জীব হয়ে জীবনযাপন করার। হাদিস শরিফের ভাষায়- তোমরা পরস্পর বিদ্বেষপোষণ করো না, একে অন্যের মর্যাদাহানির চেষ্টা করো না। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ো না। আল্লাহর সব অনুগত ব্যক্তি মিলে ভাই-ভাই হয়ে বাস কর। -বায়হাকি

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৭ ঘন্টা, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৫
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।