ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

এ প্রজন্ম চিনে না মাতৃভক্ত সূফি সাধক বায়েজিদ বোস্তামিকে

মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১৫
এ প্রজন্ম চিনে না মাতৃভক্ত সূফি সাধক বায়েজিদ বোস্তামিকে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রামে নতুন আগতদের সিংহভাগ মানুষ বায়েজিদ বোস্তামির মাজারে যান। ধর্মীয় আবেগ, সাধারণ মানুষের অনুভূতি, কচ্ছপকে খাওয়ানোর মান্নত, উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বোস্তামির মাজারের গাছে সূতা বাঁধা, সফলতার জন্য মাজারে মোমবাতি-আগরবাতি জ্বালানো অনেকের কাছেই স্বাভাবিক বিষয়।

যদিও ইসলামি স্কলাররা এসব নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করে থাকেন।

কবি কালিদাস রায় তার ‘মাতৃভক্তি' কবিতায় বিখ্যাত সাধক বায়েজিদ বোস্তামির মাতৃভক্তির এক বিষ্ময়কর কাহিনী তুলে ধরেছেন। এক সময় কবিতাটি পাঠ্যভুক্ত থাকলেও এখন আর নেই। সাধারণ মানুষের মনে হজরত বায়েজিদ বোস্তামির ‘মাতৃভক্তির’ অনন্য নজির অমর হয়ে আছে সেটা অনস্বীকার্য। তবে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই মাতৃভক্ত সূফি সাধক বায়েজিদ বোস্তামি সম্পর্কে জানে না।

৩১ অক্টোবর (শনিবার) তার মাজারে গেলে আগতদের আলাপচারিতায় এমন বাস্তবতাই উঠে এলো। সুদূর শেরপুর থেকে আগত মরিয়ম বেগমের বয়স ষাটের উপর। তিনি এসেছেন অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে। কিন্তু তিনি জানেন না বায়েজিদ বোস্তামি সম্পর্কে কিছুই।

মূল মাজারের সামনে মোমবাতি ও আগরবাতি জ্বালাচ্ছিল কয়েকজন জেএসসি পরিক্ষার্থী। তারা ০১ নভেম্বর শুরু হওয়া পরীক্ষার সফলতার জন্য এখানে এসেছেন। তারাও বলতে পারলেন না বায়েজিদ বোস্তামিকে নিয়ে কিছু।

মাজারের উপরে টিলায় অবস্থিত একটি গাছে সূতা বাঁধছিল কয়েকজন কিশোর-কিশোরী। সঙ্গে তাদের অভিভাবক। সাতকানিয়ার বাসিন্দা তারা। বায়েজিদ বোস্তামি একজন বড় অলি-আল্লাহ শুধু এটাই জানেন।

মাজারের প্রধান খাদেম বসে আছেন মাজারের দরজা সংলগ্ন বিশেষ স্থানে। তাকে প্রশ্ন করা হলো, বায়েজিদ বোস্তামির মাতৃভক্তি সম্পর্কে। তিনি বললেন, আমরা তার সম্পর্কে জানাতে দু’টো ফেস্টুন মাজারের গেটে ঝুলিয়ে দিয়েছি। সেখান থেকে আগ্রহীরা কিছু জানার মওকা পাচ্ছেন। আরও বেশিকিছু জানতে হলে, আমাদের কাছে বায়েজিদ বোস্তামির জীবনীসমৃদ্ধ বই আছে, তা সংগ্রহ করতে পারেন।

হজরত বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) ৮০৪ সালে ইরানের বোস্তাম শহরে জন্মগ্রহণ করেন এক ধার্মিক পরিবারে। আগেকার দিনে কিছু কিছু দেশে নামের শেষে জন্মগ্রহণকারী অঞ্চলের নাম জুড়ে দেয়ার রীতি বেশ প্রচলিত ছিল। তারই ধারাবাহিকতায় তার নামের শেষে বসে যায় বোস্তামি শব্দটি। বোস্তামি মানে বোস্তাম শহরের বাসিন্দা। পিতা-মাতার দেয়া তার নাম ছিল আবু ইয়াজিদ বিস্তামি। তার পিতার নাম ছিল তয়ফুর। বাবার নামানুসারে আবার কেউ কেউ তাকে ডাকেন তায়ফুর আবু ইয়াজিদ আল বোস্তামি নামে।

বায়েজিদ বোস্তামির মাজার চট্টগ্রামের নাসিরাবাদের একটি পাহাড়ের উপর অবস্থিত। সমাধি পাহাড়ের পাদদেশে একটি তিন গম্বুজবিশিষ্ট মোগল রীতির আয়তাকার মসজিদ এবং একটি বিশালাকার দীঘি আছে। ওই দীঘিকে রয়েছে প্রচুর কচ্ছপ। মিথ প্রচলিত আছে যে, বায়েজিদ বোস্তামি নিজে এসব কচ্ছপ চট্টগ্রামে নিয়ে এসেছিলেন। এগুলোকে সাধারণ মানুষ ‘বোস্তামি কাছিম’ বলে ডাকে।

এই পুকুরে আসলে কচ্ছপগুলো কীভাবে এলো এতদিন পরে তা জানার কোনো উপায় নেই। তবে যেভাবেই আসুক না কেন মাজারের এই পুকুরে শত শত বছর ধরে বাস করা কাচ্ছপগুলো বিশ্বে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রজাতির, তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এ জাতীয় কচ্ছপ চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামি মাজার সংলগ্ন পুকুরেই টিকে আছে। পৃথিবীর কোথাও এই প্রজাতির কচ্ছপ আর দেখা যায় না বলে জানালেন ভক্তরা।

স্থাপত্যশৈলী থেকে ধারণা করা হয় মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে মসজিদটি নির্মিত। হজরত বায়েজিদের দাদা একজন ফার্সি ধর্মাবলম্বী ছিলেন। যিনি পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। সুফি সাধক ও আউলিয়ারা চট্টগ্রামে ইসলাম ধর্ম প্রচারের সময় সচরাচর পাহাড়ের উপর কিংবা জঙ্গলঘেরা অঞ্চলে আবাস স্থাপন করেন এবং এসব জায়গায় মাজার কিংবা এই ধরনের বিভিন্ন স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করেন। বেশিভাগ সময়ই তিনি নিজ বাড়ির নিভৃতে অথবা মসজিতে কাটিয়েছেন। নিভৃতচারী হওয়া সত্ত্বেও সুফি জগৎ থেকে তিনি কখনোই আলাদা থাকেননি।

অষ্টাদশ শতাব্দীর চট্টগ্রামের কিছু কবির কবিতার উল্লেখ করা হয়, যেখানে শাহ সুলতান নামক একজন মনীষীর নাম বর্ণিত আছে। বায়েজিদ বোস্তামিকে যেহেতু সুলতান-উল আরেফিন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, যেই সূত্রে এই শাহ সুলতান আর সুলতান-উল আরেফিনকে একই ব্যক্তি হিসেবে ধরে নেয়া হয়।

বলা হয়, ছোটবেলায় তার বেশিরভাগ সময় নাকি কাটত ঘর থেকে মসজিদ আর মসজিদ থেকে ঘরে যাওয়া-আসা করেই। তার জ্ঞান-বুদ্ধি তাতে কতটুকু বিকশিত হয়েছিল তা নিয়ে ঘোর সংশয় সৃষ্টি হয় কবি কালিদাস রায়ের ‘মাতৃভক্তি’ কবিতাটি পড়লেই। একদিন বায়েজিদ বোস্তামির মা গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে পানি খেতে চাইলেন। বালক বায়েজিদ পানি আনতে গিয়ে দেখলেন কলসিতে পানি নেই। অগত্যা তিনি রাত দুপুরে বহু দূরের ঝরনা থেকে পানি নিয়ে এসে দেখলেন মা আবারো ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু তিনি মায়ের ঘুম না ভাঙিয়ে সারারাত পানির গ্লাস হাতে মায়ের শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষায় রইলেন মায়ের ঘুম ভাঙার? এক সময় রাত কেটে সকাল হলো। মা জেগে দেখলেন বায়েজিদ তখনো দাঁড়িয়ে আছে গ্লাসে পানি নিয়ে। মায়ের প্রতি এই ভক্তি দেখে মা আবেগতাড়িত হয়ে কেঁদে ফেলেন। এ ঘটনার পর কান্নাভেজা চোখে মা সেদিন বায়েজিদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। আর মায়ের দোয়ার বরকতে হজরত বায়েজিদ বড় হয়ে বিশ্ববিখ্যাত আউলিয়াদের একজন হয়ে গেলেন।

বায়েজিদ বোস্তামির মতো এমন অনেক আউলিয়ার পূণ্যভূমি আমাদের বাংলাদেশ। ইসলামের প্রচার-প্রসারে তাদের অবদান প্রচুর। দুনিয়ার নিয়মে তারা আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তাদের জীবনাদর্শ ও শিক্ষা। আমরা যদি আমাদের জীবনে তার প্রয়োগ ঘটাতে পারি- তবেই স্বার্থক হবে তাদের সংগ্রাম-সাধনা।



বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৫, ২০১৫
এমএ

** বাংলায় ইসলামের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম
** ইয়ান ন জানি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।