ঢাকা, শনিবার, ১৩ পৌষ ১৪৩১, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

কোরআনে কারিম তেলাওয়াতের আদব

মাহফুজ আবেদ, অতিথি লেখক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৬
কোরআনে কারিম তেলাওয়াতের আদব

পৃথিবীর বুকে মানুষের জন্য আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার হচ্ছে কোরআনে কারিম। কোরআন তেলাওয়াত শোনার মানে হলো শ্রেষ্ঠ বাণী শোনা।

কোরআনে কারিমের তেলাওয়াত স্বতন্ত্র ইবাদত হিসেবে গণ্য। এর ফজিলত অনেক বেশি।

তবে কোরআন তেলাওয়াত করাই উম্মতের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয় বরং তেলাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার আদেশ-নিষেধগুলোর সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং সে অনুযায়ী আমল করা। কোরঅান তেলাওয়াত করে ক্বারি হিসেবে খ্যাতি লাভ করার উদ্দেশ্যে কোরআন তেলাওয়াত করা ঠিক নয়। অনেকে আবার দুনিয়ার স্বার্থ সিদ্ধির লক্ষ্যে কোরআন তেলাওয়াত করে। এ ধরনের তেলাওয়াতে কোনো কল্যাণ নেই। তবে, নিজ জীবনে কোরআন বাস্তবায়নের পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার জন্য তেলাওয়াত করাটা একটা ক্রমধারা।

কোরআনে কারিম তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে শিষ্টতাপূর্ণ কিছু নিয়ম-কানুন রয়েছে। এগুলোর কোনোটা বাহ্যিক আবার কোনো কোনোটা অভ্যন্তরীণ। কোরআন তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে বিষয়গুলো অনুসরণ করা জরুরি।  

বাহ্যিক সৌন্দর্যের মাঝে রয়েছে তেলাওয়াতের জন্য অবস্থান নির্ণয় করা। কোরআন সর্বাবস্থায় তেলাওয়াত করা যায়। দাঁড়িয়ে, বসে কিংবা শুয়েও কোরআন পড়া যায়।

এই যে আমরা কোরআন তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে নিয়ম-শৃঙ্খলার কথা বললাম- কোরআনের আলোকে সেদিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক। সূরা ওয়াকিয়ার ৭৯ নম্বর আয়াতে কোরআনের পবিত্রতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। ইরশাদ করা হয়েছে, ‘পবিত্র সত্তা ছাড়া কেউ এ কোরআন স্পর্শ করতে পারে না। ’

এ আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গে কোনো কোনো মুফাসসির বলেছেন, ‘পাক-পবিত্র নয় এমন কোনো ব্যক্তি যেন তা স্পর্শ না করে। ’ তার মানে অজু গোসল ছাড়া কোরআন স্পর্শ করা ঠিক নয়।

কোরআন তেলাওয়াত করার সময় পবিত্র থাকা শরিয়তের বিধান মতে মোস্তাহাব। অনেক আলেম তো এটাও বলেছেন যে, কোরআন তেলাওয়াতের আগে মুখটাকে পরিষ্কার করো। কেননা মানুষের মুখ হলো কোরআনের পথ। তার মানে কোরআনের আধ্যাত্মিক গুণে যিনি সমৃদ্ধ হতে চান তার উচিত আত্মিক পবিত্রতা এবং আন্তরিক বিশ্বাস স্থাপন করা।

কোরআন তেলাওয়াতের শুরুতে এস্তেআজা বাক্যটি পড়ে নিতে হবে। এস্তেআজা বলা হয়, আউজুবিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজিম বলাকে। এর উদ্দেশ্য হলো, কোরআন তেলাওয়াতের শুরুতে আল্লাহতায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা। এ প্রসঙ্গে সূরা নামলের ৯৮ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন কোরআন পাঠ করবে, তখন অভিশপ্ত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে। ’

এরপর ‘তাসমিয়া’ মানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম পড়ে কোরআন তেলাওয়াত শুরু করবে। কোরআন তেলাওয়াতের শুরুতে এস্তেআজার মাধ্যমে গুনাহের দরজাগুলো বন্ধ করে রেখে তাসমিয়ার মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্যের দ্বার উন্মোচন করা হয়।

কোরআনে কারিম নীরবে শোনাও তেলাওয়াতের একটি শিষ্টাচার। সূরা আরাফের ২০৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যখন কোরআন তোমাদের সামনে পড়া হয়, তা মনোযোগ সহকারে শোনো এবং নীরব থাকো, হয়তো তোমাদের প্রতিও রহমত বর্ষিত হবে। ’

এ আয়াতের দাবি অনুযায়ী কোরআন তেলাওয়াতের সময় নীরবে আল্লাহর ওহির মর্যাদাময় বাণী মনোযোগ সহকারে শুনতে হবে। বলা হয়ে থাকে, কোরআন তেলাওয়াত করার সময় আল্লাহতায়ালা তেলাওয়াতকারীর সঙ্গে কথা বলেন। সেজন্য খুব ভালোভাবে শোনা উচিত এবং শুনে মনোযোগের সঙ্গে আয়াতের বক্তব্য নিয়ে চিন্তাভাবনা করা উচিত। যাতে করে মহান আল্লাহতায়ালা ঐশী বাণী থেকে বেশি করে উপকৃত হওয়া যায়।

‘তেলাওয়াত’ এমন একটি শব্দ বা পরিভাষা- যার অর্থ অনেক ব্যাপক। সাধারণ অর্থে যে কোনো তেলাওয়াতকে ‘পড়া’ বোঝায়। কিন্তু যেকোনো জিনিস বা বই পড়াকে তেলাওয়াত বোঝায় না। তেলাওয়াত হলো- আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ গ্রন্থ বিশেষ করে পবিত্র কোরআন পড়া। এই কোরআন পড়ার জন্য কিছু নিয়ম-কানুন যাকে ব্যাকরণ বলা হয়, সেগুলো মেনে চলতে হবে। কোরআনের পরিভাষায় এই নিয়ম-কানুনকে বলা হয় তারতিল।

‘তারতিল’ মানে কোরআন থেমে থেমে পাঠ করাকে বোঝায়। তাই কোরআন তাড়াতাড়ি বা দ্রুতগতিতে না পড়াই শ্রেয়। ধীরে ধীরে প্রতিটি শব্দ সুন্দরভাবে মুখে উচ্চারণ করে কোরআন তেলাওয়াতের বিশেষ মাহাত্ম রয়েছে। তা হলো, এক একটি আয়াত পড়ে থামলে বা বিরতি নিলে মন আল্লাহর বাণীর অর্থ ও তার দাবীকে পুরোপুরি উপলদ্ধি করতে পারবে এবং তার বিষয়বস্তু দ্বারা প্রভাবিত হবে।  

তারতিলের ভেতর কোরআনের প্রতিটি শব্দের বিশুদ্ধ উচ্চারণ করার বিষয়টিও রয়েছে। উচ্চারণের ক্ষেত্রে দু’টি বিষয়ের ওপর খেয়াল রাখতে হবে। একটি হলো মাখরাজ বা উচ্চারণ স্থান। প্রতিটি ধ্বনি বাক প্রত্যঙ্গের ঠিক কোন স্থান থেকে উচ্চারিত হবে সেটি জানতে হবে।

আরেকটি হলো- সিফাত বা শব্দের অবস্থা ও গুণাবলি অনুযায়ী উচ্চারণ করা। কোরআন তেলাওয়াতের এই ব্যাকরণকে তাজবিদ বলা হয়। তাজবিদ জানার কোনো বিকল্প নেই।

কোরআনকে সুন্দর করে সুরেলা কণ্ঠে পড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে কোরআন দেখে দেখে পড়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কারণটা হলো, কোরআনের আয়াতের দিকে তাকালে এবং কানে সেই দেখা আয়াতের তেলাওয়াত শুনলে চোখ এবং কানের ওপর তার প্রভাব পড়ে। সেই প্রভাব চূড়ান্তভাবে অন্তরে গিয়ে আসন গাড়ে। সূফি আলেমরা বলেছেন, দেখে দেখে কোরআন তেলাওয়াত করলে চোখের অসুখ বা ব্যাথা বেদনা ভালো হয়ে যায়।

এবার কোরআন তেলাওয়াতের বাতেনি বা অদৃশ্য শিষ্টাচারের কথা আলোচনা করা যাক।

একজন ক্বারি কতটুকু তেলাওয়াত করবেন সেটা বিবেচ্য বিষয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ... তাই কোরআনের যতটা পরিমাণ সহজেই পড়া যায়- ততটাই পড়তে থাকো! নামাজ কায়েম করো, জাকাত দাও।

ইসলামি স্কলারদের অভিমত হচ্ছে, কোরআন নিয়মিত তেলাওয়াত করা। ধীরে ধীরে তেলাওয়াতের পরিমাণ বাড়াতে থাকা। নিজে নির্ধারণ করে নেওয়া, প্রতিদিন কতটুকু করে তেলাওয়াত করবে সে বিষয়ে। আল্লাহতায়ালা সবাইকে নিয়ম করে, যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে প্রতিদিন কোরআন তেলাওয়াত করার তওফিক দান করুন। আমিন।

বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৬
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।