কিন্তু দুঃখজনক হলেও রূঢ় সত্য এটাই যে, এমনই একটি পবিত্র সময়েও আমরা বাংলাদেশে বৃহত্তম মুসলিম দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি আর ভেজাল খাদ্যের দাপটে প্রচণ্ডভাবে হিমশিম।
অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে, বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশ রমজান উপলক্ষ্যে জিনিসপত্রের দাম কমিয়েছে এবং সরবরাহ বৃদ্ধি করেছে।
রমজানের আরও কয়েকদিন বাকী। এর মধ্যে পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, ভেজাল ও অত্যন্ত ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থমিশ্রিত খেজুর আনা হচ্ছে। কিছু পাকড়াও করা হলেও অধিকাংশই বাজারে প্রবেশ করেছে। মুড়ি, ছোলা, ডাল ইত্যাদিতেও বিরাজ করছে একই অবস্থা। এতে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীর ধর্ম ও নৈতিকতা প্রশ্নের সম্মুখীন। ব্যবসার নামে যদি এহেন অনৈতিকতা ও অমানবিকতা প্রদর্শন করা হয়, তাহলে যে রমজান উচ্চ নৈতিক চরিত্র, উন্নত মানবতাবোধ, ত্যাগ, পরহিত, কৃচ্ছ্বতার শিক্ষা দেয়, সেই পবিত্র মাসের আমল-ইবাদতের সঙ্গে চরম অবমাননাই করা হয়।
পক্ষান্তরে, লক্ষ্য করলে দেখতে পাই, পবিত্র কোরআনের সূরা আল বাকারার ১৮৩-১৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘রমজান মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে আল কোরআন। যা মানবজাতির জন্য সঠিক পথপ্রদর্শনকারী। সঠিক পথে চলার জন্য সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী, হক বা সত্য ও বাতিলকে পরিষ্কারভাবে উপস্থাপনকারী। তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে পুরো মাসটিতে রোজা রাখবে। ’
পবিত্র কোরআনের সুস্পষ্ট ভাষ্য অনুযায়ী, মানুষের মধ্যে ‘তাকওয়া’র গুণ সৃষ্টির লক্ষ্যে রোজা পালনকে ফরজ বা অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। ‘তাকওয়া’র অর্থ হলো- আল্লাহতায়ালার প্রতি ভালোবাসা ও ভয়ের অনুভূতি। আল্লাহতায়ালার পূর্ণ বিশ্বাস এবং তার সীমাহীন অনুগ্রহের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তার প্রতি মানুষের ভালোবাসা জাগ্রত হয়। আর তার অন্যান্য গুণাবলী যেমন রাগ-ক্ষোভ ও শাস্তি দানের ক্ষমতার প্রতি বিশ্বাস লালনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে তার প্রতি ভয়ের ও মান্যতার অনুভূতি সৃষ্টি হয়। ভালোবাসা ও ভয়ের এ মিলিত মানসিক অবস্থার নাম- ‘তাকওয়া। ’
বস্তুতপক্ষে, ‘তাকওয়া’ হলো- সব ভালো কাজের উৎস; সব মন্দ কাজ থেকে বাঁচার সত্যিকার উপায়। ‘তাকওয়া’র গুণাবলী অর্জনকারী ‘মুত্তাকি’ নামে অভিহিত, যে নিজে সৎ কর্মশীল থেকে আপামর মানুষকে সৎ কাজের প্রতি আদেশে দিতে পারঙ্গম আর নিজে সর্ব প্রকার অসৎ থেকে বিরত থেকে তাবৎ মানব প্রজন্মকে অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকবার কাজে নিষেধ প্রদান করতে সক্ষম। সেই সঙ্গে তিনি মানুষকে আহ্বান জানাবেন কল্যাণের পথে। আর এ কথা তো সবারই জানা, প্রকৃত প্রস্তাবে মুসলমানদের সৃজন করা হয়েছে মানবজাতিকে সকল প্রকার অকল্যাণ থেকে বিরত রেখে কল্যাণের পথ দেখানোর জন্য। এ মহান কাজেই পুরোটা জীবন উৎসর্গ করে গেছেন রাহমাতুল্লিল আলামিন নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
জাগতিক ধন-সম্পদ আহরণ বা পদ-পদবী গ্রহণের বদলে তিনি জীবন উৎসর্গ করে গেছেন আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা কর্তৃক একমাত্র মনোনীত পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা ইসলামকে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজের কল্যাণকামী কাঠামোতে উপস্থাপনের ঐশী দায়িত্ব পালণের কাজে।
নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিষ্ঠাবান অনুসারী সাহাবারাও (রা.) একই কল্যাণব্রতী পথে চলে একদার অন্ধকারাচ্ছন্ন আরব ও আজমে শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। এ কাজে তাদের সামনে ছিল মাত্র দু’টি অবলম্বন।
১. আল্লাহতায়ালার প্রেরিত কিতাব আল কোরআন; এবং ২. নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন-কর্ম-কথার সমষ্টিতে বিনির্মিত তার অনুসৃত আদর্শ বা সুন্নত। মাত্র দু’টি অবলম্বন নিয়েই ইসলাম তার প্রাথমিক যুগে সকল প্রকার আক্রমন ও প্রতিকূলতাকে পরাভূত করতে সক্ষম হয় এবং নিজেদেরকে বিশ্বের বুকে শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত করতেও সমর্থ হয়।
আর এখন বিশ্বের দেশে দেশে মুসলমানরা নিপীড়িত, নির্যাতিত ও সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ কবলিত। কুশাসন, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, পশ্চাদপদতা, অশিক্ষা- এশিয়া ও আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোর নিত্যসঙ্গী। দুর্নীতি, মজুদদারি, মূল্যবৃদ্ধি, ভেজালসহ শত অনৈতিকতায় ছেয়ে গেছে মুসলমান সমাজ ও সম্প্রদায়। এই বাস্তব চিত্রকে আড়াল না করে একে অপসারণে সচেষ্ট হওয়াই জরুরি। সেই সঙ্গে রমজানের শিক্ষায় স্ব স্ব তাকওয়া ও নৈতিকতাকে বিকশিত করার প্রচেষ্টা নেওয়াই কাম্য।
ইতিহাস থেকে আমাদেরকে এই সত্য মনে রাখতে হবে যে, ইসলামের আবির্ভাবের পর প্রথম যে রমজান মাস এসেছিল, তার ১৭ তারিখ আরবের কাফেররা হামলা চালায় নতুন ধর্মকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে। বদরের ময়দানে আগ্রাসী-আক্রমাণকারী সুসজ্জিত কাফের বাহিনীকে মাত্র ৩১৩ জন মুসলমান সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করে ইসলামের শান্তি ও কল্যাণের ঝাণ্ডাকে সমুন্নত রেখেছিলেন এই ‘তাকওয়া’ বা খোদাপ্রেম ও ভীতির মিলিত শক্তিতে। এই তাকওয়া অর্জিত হলেই নৈতিক ও জাগতিক ক্ষেত্রে বিজয় অর্জন করা সম্ভব। সম্ভব অনৈতিকতার দুষ্টচক্র ছিন্ন করা এবং বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন অন্যায়-অনিয়ম মোকাবেলায় সমুন্নত চিত্তে আত্মমর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে টিকে থাকা।
রমজানের পবিত্র দর্পণে আত্মসমালোচনা করে এবং রমজানের পবিত্র শিক্ষায় আত্মসংশোধনের মাধ্যমেই জাগতিক ও পারলৌকিক সাফল্য ও কল্যাণের পথ সন্ধান করতে হবে প্রতিটি মুসলমানকে। ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের পবিত্রতা অটুট রাখতে হবে এবং মানুষের জন্য ক্ষতিকর ও অকল্যাণকর পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে হবে। ব্যবসা ও জাগতিক জীবন যেন লাভ ও লোভে কবলিত হয়ে আমাদের ধ্বংসের কারণ না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখাও জরুরি।
আসন্ন রমজানকে পালনের জন্য স্ব স্ব ক্ষেত্র থেকে নৈতিক প্রস্তুতি নিয়ে নিজেকে আলোকিত ও শুদ্ধ করার পথে অগ্রসর হওয়াই হোক আমাদের লক্ষ্য।
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি ও লেখক, অধ্যাপক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২০০৫ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১৭
এমএইউ/