ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ইসলাম

বরেন্দ্র’র সেরা মুসলিম স্থাপত্য বাঘা মসজিদে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮০৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১৭
 বরেন্দ্র’র সেরা মুসলিম স্থাপত্য বাঘা মসজিদে বাঘা মসজিদ। ছবি: আসাদ জামান

বাঘা (রাজশাহী) ঘুরে: সকাল থেকে মুখ ভার করে থাকা আকাশ দেখে দেখে দিনের প্রায় অর্ধেকটা পেরিয়ে গেছে। আড়ানী থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশায় যখন বাঘায় পৌঁছুলাম তখন শ্রাবণদিনের জুম্মা দুপুর!

মূল সড়ক থেকে অনেকটা দূরে নামিয়ে দেওয়ায় ঠিক ঠাওরানো যাচ্ছিল না বাঘা মসজিদটা কোথায়। অথচ দুই ঘণ্টা আগে ‘দৌলা স্কুলের’ প্রাচীর ডিঙিয়ে বাঘা মসজিদের গম্বুজগুলো দৃষ্টিসীমায় চক্কর দিয়ে গেছে।


 
অটোরিকশা চালককে জিজ্ঞেস করতেই বলল-ওই তো….ওদিকে যান! আজ শুক্রবার। জুম্মার নামাজটাও পড়তে পারবেন!

কিন্তু কই? সকালে এ পথ দিয়ে আড়ানী যাওয়ার সময় সড়কপ্রান্ত থেকে খয়েরি রংয়ের যে গম্বুজ দেখা গিয়েছিল, এখন তো তা দেখা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে কেবল ত্রিপলের নিচে অসংখ্য দোকান-পাট। চটপটি-ফুসকা, কাঠ-বেত-লোহা-প্লাস্টিকের গৃহস্থালি জিনিসপত্রের পসরা! বস্তুত, অটোরিকশা চালক বাঘা মসজিদের উল্টা পাশের রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে।
 
একটু অগ্রসর হতেই সব পরিষ্কার হয়ে গেল। ছয়/সাত ফুট উঁচু টিলার ওপর নির্মিত ৫শ’ বছরের পুরনো মসজিদ প্রাঙ্গণে কয়েক শ’ মুসল্লি সিজদারত। ভেতরে আরো কয়েক শ’। অর্থাৎ ভেতরে জায়গা হয়নি বলেই লাল, নীল, হলুদ ত্রিপল দিয়ে মসজিদের সামনের অংশে জুম্মার নামাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
 
আর মসজিদের তিন পাশ জুড়ে ত্রিপলের নিচে প্রায় স্থায়ী রকমারি দোকান-পাট। বাঘা দরবারের চারপাশে হাজারো নর-নারীর ‘মানত’ রান্নার হিড়িক! বাচ্চাদের চ্যাচামেচি! ভিক্ষাজীবীদের কাতর প্রার্থনা, ফিকিরবাজদের দৌড়-ঝাঁপ, একপেট খেতে আসা মানুষের ব্যস্ততা!

বাঘা মসজিদ।  ছবি: আসাদ জামান ঘণ্টা দুয়ের মধ্যে বাঘা মসজিদ ঘিরে এতোগুলো অনুষঙ্গ যোগ হওয়ায় এবং দূর থেকে কেবল উঁচু গম্বুজ দেখে অন্য গন্তব্যে চলে যাওয়ায় শ্রাবণের মেঘযুক্ত দুপুরে চেনা যায় নি বাঘা মসজিদ।
 
দেশের সব প্রান্তেই মনের খোরাক, চিত্তের বিনোদন ও চোখের তৃপ্তির জন্য বাংলার বুক জুড়ে কিছু না কিছু মিলবেই। আর সেটি যদি হয় উত্তরবঙ্গ, তাহলে তো কোনো কথাই নেই!
 
দেশের এ অঞ্চলটিতে প্রত্নসম্পদ’র ছড়াছড়ি। বহু যুগের পুরনো রাজপ্রাসাদ, প্রাচীন মঠ-মন্দির, মসজিদ, গির্জা, দিঘী, রাজবাড়ি- মোট কথা পুরাকীর্তির এক বিশাল সমারোহ এই উত্তরবঙ্গে।
 
সঙ্গত কারণেই, ‘শিক্ষানগরী’ রাজশাহী আসার পর যে কারো মনে বাঘা মসজিদ ও দরগাহ শরিফ এবং পুঠিয়ার জমিদার বাড়িতে ঢুঁ মারার আকাঙ্খা জাগতেই পারে।
 
রাজশাহী শহর থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে বাঘা মসজিদের অবস্থান। তাতে কী? আম বাগানের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া ছবির মতো সড়কে বাস চড়ে অম্রকানন দেখতে দেখতে এগিয়ে যান। রাজশাহী শহর থেকে দেড় ঘণ্টার যাত্রা শেষে পৌঁছে যাবেন ঐতিহাসিক বাঘা মসজিদে।
 
আপনার ভেতরে যদি প্রত্নপিপাসা থাকে তাহলে ইট ও পোড়ামাটির অলংকরণে সজ্জিত পুরনো এ মসজিদ দেখে তৃপ্তি পাবেন। মসজিদের চারকোণে চারটি বিরাট আকারের অষ্টাকোণাকৃতির কারুকায খচিত বুরুজ (টারেট) আপনাকে বিস্মিত করবে। মধ্যযুগের মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের এ অনন্য নিদর্শন দেখে আপনি পুলকিত হবেন নি:সন্দেহে। ইটের তৈরি মসজিদটি বর্তমানে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংরক্ষিত স্থাপনা।

মসজিদটি সম্পূর্ণ বরেন্দ্র অঞ্চলে তৈরি ইটে দেশজ টেরাকোটায় নির্মিত। মুঘল ভারতে প্রস্তরের নকশী কাজ এ অঞ্চলের নকশী ইটে রূপান্তরিত হওয়ায় শিল্প ও শিল্পী নিয়োগে এটিকে বরেন্দ্র অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ মুসলিম ইমারত বলা হয়।  

ইটের দেওয়াল ঘেরা বর্গাকার চত্বরে বিরাট এক পুকুরের পশ্চিম পাড়ে মসজিদটির অবস্থান। প্রবেশপথের খিলানের উৎপত্তিস্থল থকে শুরু করে মসজিদের চতুর্দিকে পাথরখণ্ড বসানো থাকায় মসজিদটিকে বাইরে থেকে দ্বিতল বলে মনে হয়।

মসজিদের মাঝখানে দুই সারিতে পাঁচটি করে মোট দশটি গম্বুজ। মসজিদের পূর্বপাশে পাঁচটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালের দু’টি করে চারটি দরজাই প্রাচীন স্থাপত্য শিল্পের শৈল্পিক গুণে ঠাসা।
 
প্রায় ২২.৯২ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১২.৭৮ মিটার প্রস্থের আয়তাকার এই মসজিদের পশ্চিম দেওয়ালে আছে কারুকায খচিত চারটি মিহরাব। মিহরাবের দুপাশে ও উপরের ফ্রেমে নানা রকম লতাপাতা ও ফুলের প্রতিকৃতি অঙ্কিত। মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোণে নারী মঞ্চ।
 
এ ছাড়া বাইরের চার পাশের দেওয়ালে বিভিন্ন প্যানেলে লতা, পাতা, ফুল, ফল ও টবে ফলন্ত বৃক্ষের প্রতিকৃতি অত্যন্ত শৈল্পিকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মসজিদের মূল প্রবেশ পথের ওপরে একসময় গাঁথা ছিলো খুব সম্ভবত আরবী ভাষার লেখা কষ্টি পাথরের এক শিলালিপি। পাকিস্তান আমলে যেটা পাচার হয়ে যায় করাচীতে। ওই শিলালিপিতে লেখা আছে, সুলতান নাসির উদ্দিন নুসরত শাহ ১৫২৩-২৪ খ্রিস্টাব্দে এ মসজিদ নির্মাণ করেন।  

বস্তুত বাংলার  স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ-এর পুত্র নাসির উদ্দিন নুসরত শাহ মসজিদের সাথে এখানে ৫২ বিঘার বিশাল দিঘীটিও খনন করেন। শীতকালে অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে দিঘীর চারপাশ।

মসজিদের কার্নিস নমনীয়ভাবে বাংলারীতিতে বক্রাকারে তৈরি করা হয়েছিল। মসজিদের অভ্যন্তরভাগকে চারটি প্রস্তরস্তম্ভের একটি সারি দ্বারা দুটি লম্বালম্বি আইল ও পাঁচটি ‘বে’-তে বিভক্ত করা হয়েছে। এর ফলে মসজিদের অভ্যন্তরভাগ দশটি স্বতন্ত্র অংশে বিভক্ত হয়েছে। এর প্রত্যেক ভাগ উল্টানো পেয়ালা আকৃতির গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল।

মসজিদের ভেতরে উত্তর-পশ্চিম কোণে উঁচু ভিটিতে নির্মিত অতিরিক্ত নামাজ কক্ষ শুধু সুলতানের প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত গভর্নরের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল বলে মনে হয়। এ ধরনের বিশেষ নামাজ কক্ষ বাংলার আর কোনো মসজিদে দেখা যায়নি। ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ের মসজিদ স্থাপত্যের এই বৈশিষ্ট্য খলিফার নিরাপত্তার জন্য প্রবর্তন করা হয়েছিল।

১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে আদি ছাদ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বর্তমানের গম্বুজটি পুনঃনির্মাণ করে। পরবর্তীতে ঢাকার নয়াটোলায় এ মসজিদের আদলে আর একটি মসজিদ (বর্তমানে শাহ নূরী মসজিদ নামে পরিচিত) নির্মাণ করা হয় বলে জানা যায়।    

মসজিদের উত্তর-পূর্বকোণে বেশ কয়েকটি কবর। যেখানে চির নিদ্রায় শায়িত আছেন কয়েকজন বুজুর্গ ব্যক্তি। জনশ্রুতি অনুযায়ী, ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দে বাঘের পিঠে চড়ে হযরত শাহ দৌলা দানেশ মান্দ (র.) পাঁচজন সঙ্গীসহ ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাগদাদ থেকে এখানে আসেন। সে কারণে এ জায়গাটির নাম হয় ‘বাঘা’। মসজিদের পাশের কবরগুলো দানেশ মান্দ ও তার সঙ্গীদের বলে ধারণা করা হয়।

বর্তমানে কলেজ, মাদ্রাসা, স্কুল ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ২০১৬ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত দর্শনীয় এক জাদুঘরও আছে বাঘা মসজিদ চত্বরে।
 
বাঘা দরবার শরীফ।  ছবি: আসাদ জামান কীভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে সড়ক, রেল ও আকাশ পথে রাজশাহী যাওয়া যায়। ঢাকার কল্যাণপুর ও গাবতলী থেকে দেশ ট্রাভেলস, গ্রীন লাইন, শ্যামলি পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, ন্যাশনাল ট্রাভেলস, বাবলু এন্টারপ্রাইজ প্রভৃতি পরিবহন প্রতিষ্ঠানের বাস যায় রাজশাহী।
 
ঢাকার কমলাপুর থেকে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে প্রতিদিন ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন সিল্কসিটি, পদ্মা ও ধূমকেতু এক্সপ্রেস।
 
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস ও নভোএয়ার চলাচল করে রাজশাহীতে।
 
আর রাজশাহী থেকে বাঘা যাওয়ার সহজ উপায় হল বাস। রাজশাহী সদর বাস টার্মিনাল থেকে বাঘার বাস ছাড়ে। ভাড়া ৫০ থেকে ৬০ টাকা। চমৎকার পিচঢালা রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়েও যেতে পারেন।
 
কোথায় থাকবেন?
থাকতে হবে রাজশাহীতে। শহরে বিভিন্ন মানের হোটেল আছে। চিড়িয়াখানার পাশে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মোটেল, গণকপাড়ায় হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনাল, শিরোইলে হোটেল হকস্ ইন্, সাহেব বাজারে হোটেল মুক্তা ইন্টারন্যাশনাল, বিন্দুর মোড়ে হোটেল ডালাস ইন্টারন্যাশনাল, মালোপাড়ায় হোটেল শুকরান ইত্যাদি।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৩১০ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১৭
এজেড/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।