ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

ইসলামে ধর্ষণের শাস্তি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৮
ইসলামে ধর্ষণের শাস্তি ইসলামে ধর্ষণের শাস্তি

ইসলাম ধর্ষণকে ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেনি। কারণ বিবাহবহির্ভূত যেকোনো যৌন সঙ্গমই ইসলামে অপরাধ। তাই ধর্ষণও এক প্রকারের ব্যভিচার।

ইসলামি আইন শাস্ত্রে ধর্ষকের শাস্তি ব্যভিচারকারীর শাস্তির অনুরূপ। তবে অনেক ইসলামি স্কলার ধর্ষণের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কিছু শাস্তির কথা উল্লেখ করেছেন।

 

ব্যভিচার সুস্পষ্ট হারাম এবং শিরক ও হত্যার পর বৃহত্তম অপরাধ। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। ’ –সূরা আল ইসরা: ৩২

ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, ‘উলামায়ে কেরাম বলেছেন, ‘ব্যভিচার করো না’-এর চেয়ে ‘ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না’ অনেক বেশি কঠোর বাক্য। ’ এর অর্থ যেসব বিষয় ব্যভিচারে ভূমিকা রাখে সেগুলোও হারাম।  

হাদিস দ্বারা ধর্ষণের শাস্তির বিষয়টি নিশ্চিত হয়। যেমন- ১. হজরত ওয়াইল ইবনে হুজর (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে এক মহিলাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হলে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে কোনোরূপ শাস্তি দেননি, তবে ধর্ষককে হদের (কোরআন-হাদিসে বহু অপরাধের ওপর শাস্তির কথা আছে। এগুলোর মধ্যে যেসব শাস্তির পরিমাণ ও পদ্ধতি কোরআন-হাদিসে সুনির্ধারিত তাকে- হদ বলে) শাস্তি দেন। ’ -ইবনে মাজাহ: ২৫৯৮

২. সরকারি মালিকানাধীন এক গোলাম গণিমতের পঞ্চমাংশে পাওয়া এক দাসির সঙ্গে জবরদস্তি করে ব্যভিচার (ধর্ষণ) করে। এতে তার কুমারিত্ব নষ্ট হয়ে যায়। হজরত উমর (রা.) ওই গোলামকে কশাঘাত করেন এবং নির্বাসন দেন। কিন্তু দাসিটিকে সে বাধ্য করেছিল বলে তাকে কশাঘাত করেননি। ’ –সহিহ বোখারি: ৬৯৪৯

ব্যভিচারের শাস্তি
ইসলামে ব্যভিচারের শাস্তি ব্যক্তিভেদে একটু ভিন্ন। ব্যভিচারী যদি বিবাহিত হয়, তাহলে তাকে প্রকাশ্যে পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। আর যদি অবিবাহিত হয়, তাহলে তাকে প্রকাশ্যে একশ’ ছড়ি মারা হবে। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য একই শাস্তি।

কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিচারী পুরুষ, তাদের প্রত্যেককে একশ’ করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকর কারণে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকো। মুসলমানদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে। ’ –সূরা নূর: ২

হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘অবিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে শাস্তি একশ’ বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য দেশান্তর। আর বিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে একশ’ বেত্রাঘাত ও রজম (পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড)। ’ –সহিহ মুসলিম

এই হাদিসের আলোকে অন্য মাজহাবের ইসলামি স্কলাররা বলেছেন, ব্যভিচারী অবিবাহিত হলে তার শাস্তি দুটো। ১. একশ’ বেত্রাঘাত, ২. এক বছরের জন্য দেশান্তর।  

আর হানাফি মাজহাবের বিশেষজ্ঞরা বলেন, এক্ষেত্রে হদ (শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি) হলো- একশ’ বেত্রাঘাত। আর দেশান্তরের বিষয়টি বিচারকের বিবেচনাধীন। তিনি ব্যক্তি বিশেষে তা প্রয়োগ করতে পারেন।

ধর্ষণের শাস্তি
ধর্ষণের ক্ষেত্রে একপক্ষে ব্যভিচার সংগঠিত হয়। আর অন্যপক্ষ হয় নির্যাতিত। তাই নির্যাতিতের কোনো শাস্তি নেই। কেবল অত্যাচারি ধর্ষকের শাস্তি হবে।  

ধর্ষণের ক্ষেত্রে দু’টো বিষয় সংঘঠিত হয়। ১. ব্যভিচার, ২. বলপ্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন। প্রথমটির জন্য পূর্বোক্ত ব্যভিচারের শাস্তি পাবে। পরেরটির জন্য ইসলামি আইনজ্ঞদের এক অংশ বলেন, মুহারাবার শাস্তি হবে।

মুহারাবা হলো, পথে কিংবা অন্যত্র অস্ত্র দেখিয়ে বা অস্ত্র ছাড়া ভীতি প্রদর্শন করে ডাকাতি করা। এতে কেবল সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া হতে পারে, আবার কেবল হত্যা করা হতে পারে। আবার দু’টোই হতে পারে।  

মালেকি মাজহাবের আইনজ্ঞরা মুহারাবার সংজ্ঞায় সম্ভ্রম লুট করার বিষয়টি যোগ করেছেন। তবে সব ইসলামি স্কলারই মুহারাবাকে পৃথিবীতে অনাচার সৃষ্টি, নিরাপত্তা বিঘ্নিতকরণ ও ত্রাস সৃষ্টি ইত্যাদি অর্থে উল্লেখ করেছেন।  

মুহারাবার শাস্তি আল্লাহতায়ালা এভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের সঙ্গে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলিতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্তপদসমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেওয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটি হলো- তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্চনা আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি। ’ –সূরা মায়িদা: ৩৩

এখানে হত্যা করলে হত্যার শাস্তি, সম্পদ ছিনিয়ে নিলে বিপরীত দিক থেকে হাত-পা কেটে দেওয়া, সম্পদ ছিনিয়ে হত্যা করলে শূলিতে চড়িয়ে হত্যা করার ব্যাখ্যা আইনজ্ঞরা দিয়েছেন। আবার এর চেয়ে লঘু অপরাধ হলে দেশান্তরের শাস্তি দেওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।  

মোটকথা, হাঙ্গামা ও ত্রাস সৃষ্টি করে করা অপরাধের শাস্তি ত্রাস ও হাঙ্গামাহীন অপরাধের শাস্তি থেকে গুরুতর।

বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ষোল বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া, অথবা ষোল বৎসরের কম বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন। ’

ইসলামের সঙ্গে এই সংজ্ঞার তেমন কোনো বিরোধ নেই। তবে এতে কিছু অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। ইসলাম সম্মতি-অসম্মতি উভয় ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বিবাহ বহির্ভূত দৈহিক মিলনকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এই আইনে কেবল অসম্মতির ক্ষেত্রে তাকে অপরাধ বলা হয়েছে।  

সম্মতি ছাড়া বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ইসলাম ও দেশীয় আইন উভয়ের চোখে অপরাধ।  

বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের কারণে মৃত্যু না হলে তার মৃত্যুদণ্ড নেই। কেবল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড। পক্ষান্তরে ইসলামে বিবাহিত কেউ ধর্ষণ বা ব্যভিচার করলে তার শাস্তি পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ডের কথা বলেছে।  

আইনে ধর্ষণের কারণে মৃত্যু হলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর ইসলামে ধর্ষণের কারণে মৃত্যু হলে সে প্রথমে ব্যভিচারের শাস্তি পাবে। পরে হত্যার শাস্তি পাবে। হত্যা যদি অস্ত্র দিয়ে হয় তাহলে কেসাস বা মৃত্যুদণ্ড। আর যদি অস্ত্র দিয়ে না হয়, এমন কিছু দিয়ে হয়- যা দিয়ে সাধারণত হত্যা করা যায় না। তাহলে অর্থদণ্ড। যার পরিমাণ একশ’ উটের মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ (প্রায় কোটি টাকা)।

ধর্ষণের সঙ্গে যদি আরও কিছু সংশ্লিষ্ট হয়- যেমন ভিডিওধারণ, ওই ভিডিও প্রচার ইত্যাদি; তাহলে আরও শাস্তি যুক্ত হবে।  

ইসলামে ধর্ষণ প্রমাণের নীতিমালা
ব্যভিচার প্রমাণের জন্য ইসলামে দু’টোর যে কোনোটি জরুরি। ক. ৪ জন সাক্ষী, খ. ধর্ষকের স্বীকারোক্তি।

তবে সাক্ষী না পাওয়া গেলে আধুনিক ডিএনএ টেস্ট, সিসি ক্যামেরা, মোবাইল ভিডিও, ধর্ষিতার বক্তব্য ইত্যাদি অনুযায়ী ধর্ষককে দ্রুত গ্রেফতার করে স্বীকার করার জন্য চাপ দেওয়া হবে। স্বীকারোক্তি পেলে তার ওপর শাস্তি কার্যকর করা হবে।  

ইসলামে ধর্ষণ ও ব্যভিচার, সম্মতি-অসম্মতি উভয় ক্ষেত্রেই পুরুষের শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। তবে নারীর ক্ষেত্রে ধর্ষিতা হলে কোনো শাস্তি নেই, সম্মতিতে হলে শাস্তি আছে। যৌন অপরাধ নির্ণয়ে ইসলাম নির্ধারিত বিভাজনরেখা (বিবাহিত-অবিবাহিত) সর্বোৎকৃষ্ট।

বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে যতটুকু শাস্তি রয়েছে, তা প্রয়োগে নানাবিধ বিলম্ব আর বিভিন্ন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক চাপের কারণে ধর্ষণের উপযুক্ত শাস্তি হয় না।  

উপরন্তু ধর্ষিতাকে একঘরে করে রাখা হয়, তাকে সমাজে বাঁকা চোখে দেখা হয়। তার পরিবারকে হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়। ইসলাম এসব সমর্থন করে না।

তবে এসব শাস্তি কেবল রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের অনুমোদনপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট দপ্তর প্রয়োগ করবে, ব্যক্তি পর্যায়ের কেউ নয়।  

ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ২১৪৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৮
এমএইউ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।