অনেকে ধর্মপ্রাণ হিসেবে ধর্ম-কর্মে অগ্রগামী হলেও অন্যের ওপর অত্যাচারে পিছিয়ে নেই। বিশেষ করে সহজ-সরল মানুষ, ধার্মিক, ধর্ম পালনে সচেষ্ট ও সচেতন এবং দুর্বলদের ওপর অত্যাচারকে অনেকেই অপরাধ মনে করি না।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে তো আমরা এতে আনন্দও বোধ করি। মনে রাখা জরুরি প্রয়োজন যে, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন এমন এক অপরাধ-পাপ-গুনাহ, যা সাধারণত আল্লাহ মাফ করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত ওই অত্যাচারিত অত্যাচারী ব্যক্তিকে মাফ না করেন।
প্রকৃত ধার্মিকদের আরও মনে রাখতে হবে, শুধু নামাজ, জাকাত, রোজা ও হজের নামই ধর্ম নয়, ধর্ম হচ্ছে দুটো বিষয়ের সমষ্টি, যার একটি হচ্ছে পালন করা এবং অপরটি হচ্ছে বর্জন করা। কোরআন ও হাদিসের আদেশগুলো মেনে চললেই ধর্ম পালন হবে না, আদেশগুলো মেনে চলার পাশাপাশি কোরআন ও হাদিসের নিষেধগুলোও বর্জন করতে হবে।
কোরআন ও হাদিসে অত্যাচার সম্পর্কীয় বর্ণনা:
পবিত্র কোরআনে সূরা ইবরাহিমে বলা হয়েছে, অত্যাচারীদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আল্লাহকে কখনও উদাসীন মনে করো না। তবে তিনি তাদের শুধু একটি নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত অবকাশ দেন। তাদের চক্ষুগুলো বিস্ফোরিত হবে, তারা মাথা ঊর্ধ্বমুখী করে দৌড়াতে থাকবে, তাদের চোখ নিজেদের দিকে ফিরবে না এবং তাদের হৃদয় দিশেহারা হয়ে যাবে।
মানুষকে আজাব সমাগত হওয়ার দিন সম্পর্কে সাবধান করে দাও, যেদিন তাদের কাছে আজাব আসবে, সেদিন অত্যাচারীরা বলবে, হে আমাদের প্রভু! অল্প সময়ের জন্য আমাদের অবকাশ দিন, তাহলে আমরা আপনার ডাকে সাড়া দেব (অন্যের ওপর অত্যাচার করব না) এবং রাসূলদের অনুসরণ করব। তোমরা কী ইতোপূর্বে কসম খেয়ে বলতে না যে, তোমাদের পতন নেই! যারা নিজেদের ওপর অত্যাচার করেছে, তোমরা তো তাদের বাসস্থানেই বাস করছ এবং সেসব অত্যাচারীদের সঙ্গে আমি কেমন আচরণ করেছি, তা তোমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। উপরন্তু আমি তোমাদের জন্য বহু উদাহরণ দিয়েছি’। -আয়াত ৪২-৪৫
সূরা আশ-শুআরার শেষ আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘অত্যাচারীরা তাদের অত্যাচারের পরিণতি অচিরেই জানতে পারবে, তাদের গন্তব্যস্থল কেমন?’ রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ তায়ালা অত্যাচারীকে দীর্ঘ সময় দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন পাকড়াও করেন তখন তাকে আর রেহাই দেন না। অতঃপর তিনি এই আয়াত পাঠ করেন যে, তোমার প্রভুর পাকড়াও এ রকমই হয়ে থাকে, যখন তিনি অত্যাচারে লিপ্ত জনপদগুলোকে পাকড়াও করেন। তার পাকড়াও অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক, অপ্রতিরোধ্য। –সহিহ বোখারি ও মুসলিম
অত্যাচার করে থাকলে দুনিয়াতেই যা করা দরকার:
হজরত রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কেউ যদি তার কোনো ভাইয়ের সম্মানহানি কিংবা কোনো জিনিসের ক্ষতি করে থাকে, তবে আজই (দুনিয়াতেই) তার কাছ থেকে তা বৈধ করে নেওয়া উচিত (অর্থাৎ ক্ষমা চেয়ে নেওয়া উচিত, ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত) এবং সেই ভয়াবহ দিন আসার আগেই এটা করা উচিত, যেদিন টাকা-কড়ি দিয়ে কোনো প্রতিকার করা যাবে না। বরং তার কাছে কোনো নেক আমল থাকলে তার জুলুমের পরিমাণ হিসেবে মজলুমকে ওই নেক আমল দিয়ে দেওয়া হবে এবং তার কোনো অসৎ কাজ না থাকলেও ওই মজলুমের অসৎ কাজ তার ওপর বর্তানো হবে। -সহিহ বোখারি
মুসনাদে আহমদে বর্ণিত এক হাদিসে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহর বান্দারা খালি পায়ে নগ্ন দেহে ময়দানে সমবেত হবে। এ সময়ে গুরুগম্ভীর স্বরে একটি আওয়াজ ধ্বনিত হবে। যা দূরের ও কাছের সবাই শুনতে পাবে। বলা হবে, আমি সবার অভাব পূরণকারী রাজাধিরাজ, কোনো জান্নাতবাসীর পক্ষে জান্নাতে যাওয়া এবং জাহান্নামবাসীর পক্ষে জাহান্নামে যাওয়া সম্ভব নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত তার কৃত অত্যাচারের আমি প্রতিশোধ না নিই, এমনকি তা যদি একটি চড়-থাপ্পড় বা লাথির পর্যায়েও হয়ে থাকে। তোমার প্রভু কারও ওপর অত্যাচার করেন না। আমরা বললাম হে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! সেটা কীভাবে সম্ভব হবে, আমরা তো সবাই খালি পায়ে ও নগ্ন দেহে থাকব? তখন রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, প্রত্যেকের কৃত সৎ কর্ম ও অসৎ কর্মের আদান-প্রদান দ্বারাই প্রতিশোধ নেওয়া হবে। তোমাদের প্রতিপালক অত্যাচারী নন।
অপর এক হাদিসে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, একটি বেতের আঘাতের জন্যও কিয়ামতের দিন প্রতিশোধ নেওয়া হবে।
অত্যাচার থেকে বাঁচার উপায়:
অত্যাচার থেকে বাঁচার কার্যকর উপায় হচ্ছে- সব ধরনের লোভ, হিংসা, ধর্মীয় বিদ্বেষ, ক্রোধ থেকে আত্মসংবরণ করা এবং বেশি বেশি জনসেবা করা। ধর্মীয় সেবা ও পরোপকারমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করা আর হালাল ও বৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থে, হালাল টাকা-পয়সার মাধ্যমে পানাহারে, পোশাক-পরিচ্ছেদে ও আসবাবপত্রে সন্তুষ্ট থাকা। বিশেষ করে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা, কোরআন ও হাদিস পড়া এবং কোরআন ও হাদিসে অত্যাচার সম্পর্কে যেসব বর্ণনা আছে, তা জানা, মানা এবং অন্যকে জানানোর চেষ্টা করা।
আমরা প্রকৃতই আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হলে, জান্নাত ও জাহান্নামে বিশ্বাসী হলে, দুনিয়ার শান্তি ও পরকালীন মুক্তি পেতে চাইলে সব ধরনের অত্যাচার এবং জুলুমের সহযোগিতা করা থেকে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।
এক্ষেত্রে আরও মনে রাখতে হবে- স্ত্রী, ভাই, বোনসহ নিকটাত্মীয়দের প্রাপ্য হক (ধর্ম কর্তৃক নির্ধারিত) না দেওয়াও অত্যাচার।
মহান আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে সব ধরনের অত্যাচার থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়ার তৌফিক দান করুন, আল্লাহুম্মা আমিন।
লেখক: সাবেক ইমাম ও খতিব, কদমতলী মাজার জামে মসজিদ, সিলেট।
ইসলাম বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। বিষয়ভিত্তিক লেখা ও জীবনঘনিষ্ঠ প্রশ্ন পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৪, ২০১৯
টিএ